ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

অনলাইন

কাশ্মীরে ভঙ্গুর শান্তি কি টিকিয়ে রাখা সম্ভব? পর্যটক হত্যাকাণ্ডের পর সংকটের মুখোমুখি মোদি সরকার

মানবজমিন ডিজিটাল

(১৬ ঘন্টা আগে) ২৪ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৮:৩৮ অপরাহ্ন

mzamin

কাশ্মীরে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘরে-বাইরে প্রচণ্ড চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে এই ঘটনাটি পাকিস্তানের সাথে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবার জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওতে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা পর্যটকদের একটি দলের উপর গুলি চালালে কমপক্ষে ২৬ জন নিহত এবং ১৭ জন আহত হন। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত মনোরম এই শহরটি দেশীয় ভ্রমণকারী এবং চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে  কাছে বেশ জনপ্রিয়।

সাম্প্রতিককালের মধ্যে ভয়াবহ এই সহিংসতা দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের কবলে থাকা এই অঞ্চলের আপেক্ষিক শান্তিকে বিঘ্নিত করেছে। দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অধ্যয়নের অধ্যাপক অজয় ​​দর্শন বেহেরা বলেছেন-' এটি এমন কোনও ঘটনা নয় যেখানে  ভারত সরকার চুপ করে থাকবে। 'যদিও এই ঘটনার সাথে কোনও রাষ্ট্রীয় পক্ষের আনুষ্ঠানিকভাবে জড়িত থাকার কথা বলা হয়নি, তবে বেহেরা মনে করেন যে 'জঙ্গিদের এই অভিযানের নেপথ্যে  পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাত রয়েছে। যে পেশাদার পদ্ধতিতে গোটা অপারেশন পরিচালনা করা  হয়েছিল তাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছাপ রয়েছে। কোথায় হামলা করা হবে, পালানোর পথ এবং সময় স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর সামর্থ্যের বাইরে সূক্ষ্ম পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়।'

এই হামলাটি কাশ্মীর সম্পর্কে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বক্তব্যের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে মোদির সরকার ২০১৯ সালে এই অঞ্চলের আধা-স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা বাতিল করে এবং তারপর থেকে কাশ্মীরে নিরাপত্তা ও উন্নয়নের প্রচার চালিয়ে এটিকে একটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু করে তুলেছে। এটি মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জে.ডি. ভ্যান্সের উচ্চ-পর্যায়ের সফরের মাঝে করা হয়েছে। লক্ষ্য হলো -ভারত যখন বিশ্বব্যাপী অংশীদারদের সাথে দেখা করছে, তখন কাশ্মীরের দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতাকে তুলে ধরা। বেহেরা দাবি করেছেন -'এই আক্রমণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি সংকেত যে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়নি। '

কাশ্মীর- একটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল যা সম্পূর্ণরূপে দাবি করা হলেও আংশিকভাবে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ১৯৮৯ সালে ভারত-বিরোধী বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর থেকে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে এই উপত্যকা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সহিংসতা কমে গেলেও হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। ২০১৯ সালে ভারত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে, রাজ্যটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে- জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ। এই পদক্ষেপের ফলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বহিরাগতদের বসবাসের অধিকার প্রদান করতে সক্ষম হয়, যার ফলে তারা এই অঞ্চলে চাকরি পেতে এবং জমি কিনতে পারে। এর ফলে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।  এই বিরোধ পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তীব্র শত্রুতা এবং সামরিক সংঘাতের জন্ম দিয়েছে।

"কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স" নামে একটি স্বল্প পরিচিত জঙ্গি গোষ্ঠী সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি বার্তায় এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছে যে ৮৫,০০০ এরও বেশি "বহিরাগত" এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে, যা এই অঞ্চলে জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের কারণ। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তিন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। হামলার পর সৌদি আরব সফর সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত ভারতে ফিরে আসেন মোদি, বুধবার নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য তার শীর্ষ সহযোগীদের সাথে একটি বৈঠক করেন। স্বাধীন রাজনৈতিক ভাষ্যকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলছেন-"এটি মোদির  জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হবে। এই আক্রমণের জন্য একটি নিরাপত্তামূলক প্রতিক্রিয়া থাকা উচিত। এটি দেশের রাজনৈতিক আখ্যানের উপরও বড় প্রভাব ফেলবে। 'তিনি বলেন, 'এই ঘটনা বিজেপির দাবিকে দুর্বল করে দেয় যে সীমান্তের ওপারে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক সহ তাদের শক্তিশালী নিরাপত্তা  আন্তঃসীমান্ত জঙ্গিবাদকে সফলভাবে দমন করেছে।'

২০১৯ সালে, ভারত বালাকোটে জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে বলে দাবি করে পাকিস্তানের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছিল। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মীদের একটি কনভয়কে লক্ষ্য করে আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রতিশোধ হিসেবে এই বিমান হামলা চালানো হয়েছিল। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সেনা কমান্ডোদের একটি দল পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে প্রবেশ করে  আক্রমণ করার পর এই আক্রমণটি ছিল দ্বিতীয়বারের মতো বড় হামলা। উরিতে ভারতীয় সেনা চৌকিতে চার জঙ্গি হামলা চালানোর ১০ দিন পর এই আক্রমণটি ঘটে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে যে সর্বশেষ হামলার পেছনে থাকা জঙ্গিরা ক্ষতিগ্রস্তদের ইসলামী আয়াত পাঠ করতে বাধ্য করেছিল এবং তাদের মোদি  সরকারকে সমর্থন করার জন্য দোষারোপ করেছিল। কারণ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনসংখ্যার একটি মূল অংশ থেকে সমর্থন পায় বিজেপি। নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলছেন-' একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে মোদি কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া দেখান তা দেশে আরও বড় ধর্মীয় মেরুকরণের উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এটি ভারতের অর্থনীতির ক্ষতি করতে পারে বিশেষত এমন এক সময়ে যখন পুরো বিশ্ব বাণিজ্য উত্তেজনায় জর্জরিত। '

বিশ্বের দুটি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে পারস্পরিক শুল্ক আরোপ বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক ভাষ্যকার নীলাঞ্জনের কথায় - ' "কাশ্মীরের মাটিতে এই আক্রমণ ভারতের ইতিহাসে বছরের পর বছর ধরে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। মোদিকে এ ব্যাপারে কিছু করতে হবে, তা তাৎক্ষণিকভাবে হোক বা আগামী কয়েক দিনের মধ্যে। "কাশ্মীরে পর্যটকদের লক্ষ্য করে হামলার ঘটনা বিরল। সর্বশেষ প্রাণঘাতী ঘটনাটি ঘটে ২০২৪ সালের জুনে, যখন জঙ্গি হামলায় হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি বাস খাদে পড়ে যাওয়ার পর কমপক্ষে নয়জন নিহত এবং ৩৩ জন আহত হন।

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির কাশ্মীরকে ইসলামাবাদের "গলার শিরা" বলে মন্তব্য করার এক সপ্তাহ পর এই হামলাটি ঘটল। এই বক্তব্য ভারতে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বুধবার, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ হামলায় ইসলামাবাদের কোনও সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন। লন্ডন-ভিত্তিক লেখক এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বিশেষজ্ঞ প্রিয়জিৎ দেবসরকার বলেন, মুনিরের মন্তব্য হিন্দু ও মুসলিম যে একসাথে থাকতে পারে না সেই বিভাজনমূলক ধারণাটিকে উস্কে দিয়েছে। এই বিশ্বাসটি ১৯৪৭ সালে বৃটিশ ভারতের বিভাজনের সময় রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় ইন্ধন জুগিয়েছিল। দেবসরকার উল্লেখ করেছেন যে, পাকিস্তান তার অশান্ত বেলুচিস্তান অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী সহিংসতার কারণে ইতিমধ্যেই অস্থিতিশীলতার সাথে লড়াই করছে।

তিনি পরামর্শ দেন যে, পহেলগাঁওয়ে হামলাটি হয়তো ইসলামাবাদের কাশ্মীর বিরোধের প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের একটি প্রচেষ্টা ছিল, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন মূলত বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছে। দেবসরকার বলেন, এই হামলার ফলে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী আত্মতুষ্টির অনুভূতিতে ধাক্কা খেয়েছে। তাদের ধারণা ছিল এই অঞ্চলে অনেক দেশী-বিদেশী পর্যটকের আগমনের সাথে সাথে জীবন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। পহেলগাঁওকে প্রায়শই তার মনোরম দৃশ্যের জন্য 'মিনি সুইজারল্যান্ড' হিসাবে বর্ণনা করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে বলিউডের সিনেমাগুলোর জন্য এটি একটি প্রিয় পটভূমি। দেবসরকারের কথায় -  'এই ঘটনাটি পহেলগাঁওয়ের ক্রমবর্ধমান পর্যটন অর্থনীতিতে একটি কালো দাগ হয়ে থেকে যাবে। '

সূত্র : সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট

অনলাইন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

অনলাইন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status