শেষের পাতা
সিলেটে পাথর লুট বন্ধে পথ খুঁজছেন ডিসি
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
২৫ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবারদেরি হয়ে গেছে অনেক। এরই মধ্যে লুটের মহোৎসব চলছে। সিলেটে পাথররাজ্য এখন পাথরশূন্য। মাটির উপরে কোনো পাথর দৃশ্যমান নেই। যন্ত্রদানব বোমা মেশিন দিয়ে মাটির ৪০ থেকে ৫০ ফুট গভীর পর্যন্ত পাথর লুটে নেয়া হচ্ছে। বোমা মেশিনের তাণ্ডবে বদলে যাচ্ছে মানচিত্রও। প্রশাসন সবই
দেখছে। কিন্তু অসহায়। স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে বিজিবি ও পুলিশের মাঠ সদস্যরা। টানা ৮ মাসে সিলেটের তিনটি পাথর কোয়ারি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। এর আগে বালুও লুট করা হয়।
দেরিতে হলেও সিলেটের পাথর লুট বন্ধে সক্রিয় হয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। ইতিমধ্যে তিনি একটি অভিযানিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। এতে শুরু হয়েছে বিতর্ক। আর এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে তিনি আলোচনা শুরু করেছেন। গতকাল বিকালে পাথর লুট প্রসঙ্গে মানবজমিনের প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক জানান, পাথর লুট হচ্ছে না, চুরি হচ্ছে। তার এই বক্তব্য নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মহা আয়োজনে সিলেটের জাফলং, ভোলাগঞ্জ ও বিছনাকান্দিতে পাথর লুট হচ্ছে। সিলেটের সব মানুষ সেটি জানেন। হাজার হাজার শ্রমিক নিয়োগ করে পাথরখেকোরা প্রতিদিন শ’ শ’ ট্রাক দিয়ে পাথর লুট করে চলেছে। এ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ত্যক্ত-বিরক্ত। পরিবেশ অধিদপ্তর ৮টি মামলা করেছে। আসামি হাজারো। সবকিছুই জেলা প্রশাসকের নোটিশে আছে। একাধিক দপ্তর থেকে সেনাবাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু নীরব ছিলেন ডিসি।
তবে একটি অভিযান পাথর লুট বন্ধে জেলা প্রশাসকের পথকে সুগম করে দিচ্ছে। সেটি হচ্ছে স্টোন ক্রাশার মিলের রাজ্য ধোপাগুলের অভিযান। গত ১৩ই এপ্রিল জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে স্টোন ক্রাশার মিলে অভিযান চালান। সেখানেই হামলার মুখে পড়ে প্রশাসনের অভিযানিক টিম। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- ধোপাগুলে জেলা প্রশাসনের টিম অভিযান চালিয়ে অন্তত ৩০টি’র মতো স্টোন ক্রাশার মিল ভাঙচুর করে। জাফলং ক্রাশার মিল একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভাঙচুরের সময় মালিক ঘটনাস্থলেই হার্ট অ্যাটাক করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে অভিযানিক টিমের ওপর হামলা চালায় ক্রাশার মিল ও শ্রমিকরা। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। বাধার কারণে অভিযান শেষ না করে টিম ফিরে আসে সিলেটে। এ ঘটনায় পুলিশের এক কর্মকর্তা বাদী হয়ে এয়ারপোর্ট থানায় এসল্ট মামলা করেন। হামলাকারী কারও নাম না থাকলেও অজ্ঞাত আসামি আড়াইশ’। তবে ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ আসামিদের শনাক্ত করেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
ধোপাগুলে দেড়শ’র মতো স্টোন ক্রাশার মিল রয়েছে। কাছাকাছি কোনো পাথর কোয়ারি নেই। ট্রাকযোগে ভোলাগঞ্জ ও বিছনাকান্দি কোয়ারি থেকে উত্তোলিত পাথর আসে এখানে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিলেও এই পাথরগুলো প্রশাসনের নজরে পড়ে না। ধোপাগুল ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন, ভোলাগঞ্জে কয়েক হাজার ক্রাশার মিল। পাশের কোয়ারিতে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রশাসন ওখানে কিছু না করে ধোপাগুলে কেন অভিযান চালায়। এ নিয়ে তারা ক্ষুব্ধ। ইতিমধ্যে বিএনপি’র চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে নিয়ে তারা ধোপাগুলে মতবিনিময় করেছেন। সর্বশেষ গত বুধবার নগর বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী ও সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরীকে নিয়ে মতবিনিময় করেছেন। এ নিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি নেতারা। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই অবস্থায় গতকাল দুপুরে সম্মেলন কক্ষে সিলেটের বিভিন্ন জোনের স্টোন ক্রাশার মিল মালিক ও ট্রাক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জেলা প্রশাসক নিজেই। সেখানে তিনি দুটি অপশন দিয়েছেন। একটি হচ্ছে; কোয়ারি থেকে চোরাই পাথর ক্রাশার মিল মালিকরা ভাঙতে পারবেন না। অন্যদিকে হচ্ছে সওজের ভূমি দখল করে ক্রাশার মিলের পাথর রাখা যাবে না। তবে এলসির পাথর ভাঙতে প্রশাসনের কোনো আপত্তি নেই। তার এই অবস্থানে শঙ্কায় পড়েছেন ক্রাশার মিল মালিক ও পরিবহন শ্রমিক নেতারা।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসে ক্রাশার মিল মালিকরা জানিয়েছেন- জেলা প্রশাসকের এই সিদ্ধান্ত তারা মানবেন। তবে তার আগে পাথর লুট বন্ধ করতে হবে। তারা যখন যে পাথর পান সেটি ভাঙেন। তবে ভারত থেকে আমদানি করা এলসি’র পাথরই বেশি ভাঙেন তারা। ধোপাগুলের ক্রাশার মিল ব্যবসায়ীদের পক্ষে রয়েছে খাদিমনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। তিনি বৈঠকে ছিলেন না। তবে বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে মানবজমিনকে বলেন- পাথর কোয়ারিতে উৎসব করে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। সেই পাথর ক্রাশার মিল মালিকরা টাকা দিয়ে কিনে ভেঙে বিক্রি করছেন। যদি পাথর না উঠে তাহলে তারা কিনবে না। আগের মতো এলসি পাথর এনে ভাঙবেন। সুতরাং পাথর উত্তোলন বন্ধ না করে ব্যবসায়ীদের ক্ষতির মুখোমুখি করায় বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ধোপাগুল ক্রাশার মিল মালিক সমিতির একাংশের সভাপতি নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন- ক্রাশার মিল তো শুধু ধোপাগুলে নয়, অন্য জায়গায়ও আছে। সব সময় কেবল ধোপাগুলেই অভিযান চালানো হয়। প্রশাসনের ভেতরে থাকা একটি পক্ষ পুরো জেলা প্রশাসনকে বিতর্কিত করতে বার বারই ধোপাগুলে হাত দিচ্ছে। এতে প্রশাসন বিতর্ক হচ্ছে এবং মূল উদ্দেশ্যও ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে।
ধোপাগুলে ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি: সিলেটে সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ অগ্রাহ্য করে ক্রাশার মিল ভাঙচুর ও ক্ষতিসাধনের অভিযোগ তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। সিলেট সদরের এয়ারপোর্ট এলাকাধীন ধোপাগুল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী মো. নাছির উদ্দিন এ অভিযোগ করেন। তিনি জানান- সিলেট এয়ারপোর্ট থানার ৩নং খাদিমনগর ইউনিয়নের ধোপাগুল মহালদিক আটকিয়ারি লালবাগ ছালিয়া এলাকায় পাথর ব্যবসায়ীদের বহু স্টোন ক্রাশার মিল রয়েছে। এসব মিলের মালিকরা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা করছেন। সিলেটের বিভিন্ন কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় তারা আমদানি করা বোল্ডার কিনে ব্যবসা করছিলেন। তাদের এই পাথর ব্যবসা বন্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন (৭৫৫২/২০১৫) দাখিল করলে হাইকোর্ট পাথর ভাঙার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ব্যবসায়ীরা এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে সিভিল পিটিশন (৩৩২/২০১৭) দায়ের করলে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা স্থগিত ঘোষণা করেন। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশের ভিত্তিতে ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রাশার মিল ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ লংঘন করে গত ১৩ই এপ্রিল জেলা কালেক্টরেট ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে এলাকার সবক’টি ক্রাশার মিল ভেঙে ফেলেন। এতে ব্যবসায়ীদের প্রায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করা হয়।