শেষের পাতা
রানা প্লাজা ধসের এক যুগ
নিহত-নিখোঁজদের চোখের জলে স্মরণ
স্টাফ রিপোর্টার, সাভার থেকে
২৫ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবার
সাভারে ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল পোশাক শিল্পের ইতিহাসে ভয়াবহ রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির এক যুগ পূর্ণ হলো। দিনটিকে চোখের জলে স্মরণ করেছে ভবন ধসে আহত শ্রমিক, নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকের স্বজনসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের শ্রমিক ও নেতৃবৃন্দ। ট্র্যাজেডির এক যুগ পার হলেও এখনো সেদিনের ভয়ঙ্কর স্মৃতি তাড়া করে ফেরে প্রাণে বেঁচে যাওয়া সেইসব শ্রমিকদের। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং চিকিৎসাসেবা না পেয়ে অনেকেই ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে। বেশির ভাগ শ্রমিকই দুর্বিষহ বেকার জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন। অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে খেয়ে না খেয়ে আশায় বুক বেঁধে অনেক কষ্টে দিন পার করছেন ভুক্তভোগী শ্রমিকরা। গতকাল এক যুগ পূর্তিতে নিহত ও নিখোঁজদের স্মরণে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে এসে ক্ষোভে এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই। স্বজন হারানোর বেদনা, অঙ্গহানিসহ চিকিৎসার অভাবে ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা শ্রমিকরা মরার আগে ভবন মালিকসহ দোষীদের বিচার দেখে যেতে চান। পাশাপাশি সুচিকিৎসা, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনও দাবি করেন তারা। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টায় রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নিহত ও আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসাসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের নেতাকর্মীরা। মিছিলটি বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে শুরু হয়ে ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে এসে শেষ হয়। পরে সংগঠনের পক্ষ থেকে অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক মারা গেছেন। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কিন্তু এক যুগেও এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শেষ হয়নি, যা দুঃখজনক।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের আইন বিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ১২ বছর পূর্ণ হলেও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা হয়নি। এটাকে দুর্ঘটনা বললে ভুল হবে, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। ক্ষতিগ্রস্ত সবার প্রয়োজনীয় সহায়তা, পুনর্বাসন এবং আহতদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা দিতে হবে। ভবন মালিক এক যুগ ধরে জেলে আছেন, বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু কারখানার মালিকরা দিব্যি বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সাভারের রানা প্লাজা ধসের এক যুগেও জড়িতদের শাস্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নারী শ্রমিক শিলা বেগম। তিনি বলেন, ২৩ তারিখ বিল্ডিংয়ে ফাটল দেখা দিলে একজন ইঞ্জিনিয়ার এসে বলেন, ভবন ঝুঁকিপূর্ণ’। পরে ব্যানার ও তালা লাগিয়ে দিলেও রানা এবং গার্মেন্টস মালিকরা জোর করে ভয় দেখিয়ে শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। তাদের কারণে এতগুলো মানুষ প্রাণ হারালো, পঙ্গু হলো কিন্তু তাদের কোনো শাস্তি হলো না। সেদিন ভবন ধসের ঘটনায় শিলার ডান হাতের রগ কেটে যায়, পেটে ভিম পড়ে নাড়িভুড়ি বের হয়ে গেছে। ভেঙে গেছে মেরুদণ্ড। এখন অন্যের সহায়তায় যন্ত্রণা নিয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকলেও অর্থের অভাবে নিজের চিকিৎসা কিংবা একমাত্র মেয়ের পড়াশোনা কোনোটাই করাতে পারছেন না। মেধাবী মেয়ে তানজিলা আক্তার ক্লাস ফাইভে, এইটে গোল্ডেন এ প্লাস, এসএসসিতে এ, এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। বর্তমানে বরিশাল মহিলা কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়লেও টাকার অভাবে পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। সমাজের বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, নিজে তো চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পড়ে আছি। খেয়ে না খেয়ে সময় যাচ্ছে। অনেক স্বপ্ন ছিল, মেয়েটা বড় অফিসার হবে তাও শেষ হয়ে গেল। কেউ সহযোগিতা করলে মেয়েটাকে পড়ালেখা করাতে পারতাম। ক্ষুব্ধ শিলা জানায়, এক যুগ ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছি, কেউ কথা শোনে না। সরকার আমাদের পুনর্বাসন করে কিছু করে খাওয়ার ব্যবস্থা করে না দিলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আমরণ অনশনে বসবো বলে হুঁশিয়ারি দেন। দোষীদের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে অপর শ্রমিক ইয়ানুর বলেন, যাদের কারণে এতগুলো মানুষের ক্ষতি হলো, তারা তো বুক ফুলিয়ে হাঁটছে। আমরা তো বিচার পেলাম না। সহযোগিতাও পেলাম না। কয়েক মাস আগে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ আমাদের ডেকে নিয়ে কথা বলেন। আমরা এক জীবন পরিমাণ ক্ষতিপূরণ ৪৫ লাখ টাকা দাবি করি। এরপর আর কোনো খোঁজ নেই। ১২ বছর ধরে এর জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের কথা কেউ শোনে না। আমরা আর্থিক সহযোগিতা, সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন চাই। বাংলাদেশ টেক্সটাইল-গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি এডভোকেট মাহবুব আলম ইসমাইল বলেন, রানা প্লাজার জায়গা ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে আহত এবং নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে পুনর্বাসন, আহতদের সুচিকিৎসা, সোহেল রানাসহ দায়ী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতসহ ২৪শে এপ্রিলকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণার দাবি জানান। অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টির আয়োজনে ‘নিরাপদ কর্মস্থল এবং ন্যায্য মজুরি’ স্লোগানকে ধারণ করে ১৩ থেকে ২৪ স্মরণে ও সংস্কারে শ্রমিকের বন্দোবস্ত শিরোনামে রানা প্লাজার সামনে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, রানা প্লাজা ভবন ধসের আগের দিন ফাটল দেখা গেলেও সেটিকে গুরুত্ব না দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে ভবন মালিক সোহেল রানা পরের দিন গার্মেন্টস খোলা রাখে। আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফাঁদে পড়ে রানা প্লাজায় শ্রমিকদের জীবন দিতে হয়েছিল। যদি রানা প্লাজার মালিক রানার কাছে আওয়ামী ক্ষমতা কুক্ষিগত না থাকতো, তাহলে সেই দিনের মতো করে শ্রমিকদের আর থরে থরে জীবন দিতে হতো না। বিদেশি সংস্থাগুলো যখন ভবন ধসের পর উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাইলো তখন শেখ হাসিনা সরকার বিদেশি সংস্থাগুলোকে উদ্ধারকাজ পরিচালনায় বাধা প্রদান করলো। কারণ আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে যে দুর্বৃত্তায়ন করেছিল রানা প্লাজার ঘটনার মধ্যদিয়ে সে দুর্বৃত্তায়ন যাতে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ না পায়, সেজন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেয়া হয়নি। এ সময় রানা প্লাজা ধসের দিনকে জাতীয় শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানান। এ ছাড়া রানা প্লাজার ঘটনায় যেসব অনুদান এসেছে সেই অনুদান যারা কুক্ষিগত করেছে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের অনুদানের টাকা তাদের মধ্যে ভাগ করে দেয়াসহ রানা প্লাজার ঘটনায় যেসব মামলা হয়েছে সেইসব মামলার আসামিদের অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানান। জাতীয় নাগরিক পার্টি সবসময় শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলবে এবং সকল অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পাশে থাকবে জানিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার যাতে আর কেউ ক্ষুণ্ন্ন করতে না পারে, সোহেল রানাদের মতো গং যাতে তৈরি হতে না পারে সেই শপথ ব্যক্ত করেন। সকাল থেকে রাষ্ট্র সংস্কার শ্রমিক আন্দোলন, গার্মেন্টস টেক্সটাইল শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন ও গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন রানা প্লাজার সামনে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।