শেষের পাতা
ধানমণ্ডিতে চাঁদাবাজি
আটক সেই যুবক ইজারাদারের লোক
সুদীপ অধিকারী
১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার
রাজধানীর ধানমণ্ডির জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পার্কিং করা এক প্রাইভেটকার চালকের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগে মো. আশরাফুল ইসলাম (২৩) নামে এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার রাত ১টার দিকে হাজারীবাগ এলাকা থেকে তাকে আটক করে ধানমণ্ডি থানা পুলিশ। এ ঘটনার ভুক্তভোগীদের হদিস না পাওয়ায় বুধবার দুপুরে পুলিশ বাদী হয়ে ওই যুবকসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৪ থেকে ৫ জনকে আসামি করে ধানমণ্ডি থানায় মামলা করে। সেই মামলাতেই ৩ দিনের রিমান্ডে রয়েছে আশরাফুল। তবে- সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্টদের দাবি- বিনা অপরাধে তাকে আটক করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। সে কোনো চাঁদাবাজ নয়। সে মূলত ধানমণ্ডি-৭ নম্বর সেক্টরের আওতায় সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে লেকের পাড়ের পার্কিং এর জায়গা ইজারা নেয়া জেড.এস এন্টারপ্রাইজের একজন বেতনভুক্ত কর্মী।
এর আগে পহেলা বৈশাখের আগের রাতে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড এলাকার ইবনে সিনা মেডিকেল ইমেজিং এর সামনে পার্ক করা একটি গাড়ি থেকে রসিদ দেখিয়ে টাকা আদায়ের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, সাদার ওপর কালো রঙের একটি শার্ট পরে হাতে সিটি করপোরেশনের ইজারাদার কোম্পানি জেডএস এন্টারপ্রাইজের রসিদ নিয়ে একটি প্রাইভেটকারের চালকের কাছে টাকা চাচ্ছেন আশরাফুল। ওই সময় প্রাইভেটকার মালিকের সঙ্গে ওই যুবকের কথা-কাটাকাটি হয়। প্রাইভেটকারের চালকের আসনে বসা ব্যক্তিটি ওই যুবককে বলছে- মাস্তানি করো। উত্তরে যুবক বলেন, ‘হ করতাছি, কোনো সমস্যা?’ এ সময় পাশে প্রাইভেটকারের মধ্যে থাকা এক মহিলা ওই যুবকের নাম জানতে চান। ?উত্তরে যুবক বলেন, ‘নাম দিয়ে কী হবে?’। এরপর প্রাইভেটকার চালক আবার বলছেন, রাস্তার উপর গাড়ি রাখছিলাম, ওরে চাঁদা দিলাম। ওর নাম দিয়ে কী হবে, এরপর আমি দেখতেছি। তখন ওই যুবক বলে, এরপর আসলে চেহারাটা সুন্দর করে আইসো, চুল নাড়িয়ে বলে- আমার একটা চুলও বাঁকা করতে পারবা না। ওই সময় ওই গাড়ির মধ্যে একটি বাচ্চার আওয়াজও পাওয়া যায়। ১৩ই এপ্রিল রাতের ওই ঘটনার ভিডিও মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। অনেকেই ওই যুবকের শাস্তি দাবি করেন। কেউ আবার ওই গাড়িচালকদেরও আচরণের সমালোচনা করেন। এরপরই মঙ্গলবার রাতে ধানমণ্ডি থানার একটি মোবাইল টিম হাজারীবাগ থানা পুলিশের সহায়তায় হাজারীবাগ এলাকা থেকে আশরাফুলকে আটক করে। পরদিন ধানমণ্ডি থানায় দায়ের করা চাঁদাবাজি মামলায় তাকে আদালতে হাজির করে রিমান্ড চাওয়া হয়। এরই প্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর হাকিম এম এ আজহারুল ইসলাম আশরাফুলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বর্তমানে ধানমণ্ডি থানায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
গতকাল সরজমিন জিগাতলার ওই আলোচিত লেকপাড়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে লোহার দণ্ডায়মান খাম্বাতে লাল বোর্ডে স্থায়ীভাবে উল্লেখ করা রয়েছে- এটা সিটি করপোরেশনের ইজারাকৃত নির্ধারিত গাড়ি পার্কিং এর জায়গা। ওই বোর্ডের নিচে হলুদ সাইনবোর্ডের ভেতরে লাল কালি দিয়ে বড় করে লেখা হয়েছে পার্কিং। তাতেও সিটি করপোরেশনের লোগো ও ইজারাদার ‘জেড.এস এন্টারপ্রাইজের’ নাম উল্লেখ করা রয়েছে। শুধু একটা জায়গায় নয় একাধিক জায়গায় এমনকি গাছেও টানানো রয়েছে পার্কিং এর সাইনবোর্ড। আর ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায় ওই গাড়িটি এই পার্কিং এর জায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। গতকাল ওই পার্কিং এর দায়িত্বে থাকা আব্দুর রহমান বলেন, চাঁদাবাজির অভিযোগে আটক আশরাফুল মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতনে জেড.এস এন্টারপ্রাইজে চাকরি করে। ওকে রসিদ বুঝিয়ে দেয়া হয়। সেই রসিদ দিয়ে পার্ক করা গাড়ি থেকে আশরাফুল ঘণ্টা প্রতি ৩০ টাকা ও মোটরসাইকেল থেকে ২০ টাকা আদায় করতো। সে কোনো চাঁদাবাজ নয়। আব্দুর রহমান বলেন, মানুষ শুধু ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটাই দেখেছে। কিন্তু ভিডিওর আগে-পরের কিছুই জানে না কেউ। হ্যাঁ- আশরাফুল চুল ছেঁড়ার কথা বলে অবশ্যই অন্যায় করেছে। কিন্তু তাকে যে আগে আজেবাজে কথা বলে উত্তেজিত করা হলো, সেটাতো কেউ বললো না। ভিডিও ধারণকারীরা যে তাকে দেখে নেয়ার কথা বললো, মাস্তান বললো সে বিষয়ে কেউ কিছু বলে না। কোনো অপরাধ ছাড়াই তাকে আটক করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এমন কী আমাদের সঙ্গে তার দেখা করতে পর্যন্ত দিচ্ছে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে ধানমণ্ডি ৭ নম্বর সেক্টরের পার্কিং জায়গা ইজারা নেয়া জেড.এস এন্টারপ্রাইজের মো. ওমর ফারুক ও মো. রিপন বলেন, আমরা যথাযথ প্রক্রিয়ায় সিটি করপোরেশন থেকে এই জায়গা ইজারা নিয়েছি। এখানে আজকে নয় অনেক আগে থেকেই সিটি করপোরেশন ইজারা দেয়। আগের সরকারের সময় যারা ইজারা নিয়েছিল সেই ফোর আর ট্রেডিং এর গোলাম রব্বানী হিরুর সাইনবোর্ড টানানো রয়েছে। এরপর গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে আমরা ইজারা নিয়েছি। সেই সাইনবোর্ডও সব জায়গায় টানানো রয়েছে। এগুলো কী কারোর চোখে পড়েনি? সেদিন রাতে আমাদের ওই ছেলেটার ব্যবহার খারাপ ছিল সেটা আমরাই বলছি। কিন্তু সে কোনো চাঁদাবাজ নয়। এখন পর্যন্ত সেই ভিডিও করা লোকগুলোরও কোনো খোঁজ নেই। তারা অভিযোগ পর্যন্ত করেনি। এরপরও কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করেই চাঁদাবাজি মামলা দিয়ে তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। আমরা ওকে আটকের পর বারংবার কাগজপত্র নিয়ে থানায় গিয়েছি। সিটি করপোরেশন থেকে ইজারার কাগজ পাঠিয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো ফল পাইনি। এমনকি আমাদের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। এখন আমরা আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি। কিন্তু রিমান্ড শেষ না হওয়ায় কিছুই করা যাচ্ছে না। এ সময় দক্ষিণ সিটির কাছ থেকে ইজার নেয়ার কাগজও দেখায় তারা। গত বছরের ২৮শে নভেম্বর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা উপ-সচিব কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী স্বাক্ষর করা ওই কাগজে দেখা যায়- ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ধানমণ্ডি লেক ও লেক সংলগ্ন সেক্টর-৭ হতে ইজারা কার্যক্রম গ্রহণের পূর্ব সময় পর্যন্ত খাস আদায়ের জন্য গত বছরের ৪ঠা সেপ্টেম্বর এই বিষয়ে ১৫ নম্বর ওয়ার্ড সচিব, সার্ভেয়ার ও সম্পত্তি কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিই খাস আদায়ের জন্য জেড. এস এন্টার প্রাইজের কাছে টাকা উঠানোর জন্য ইজারা দেন। ওই খাস টাকা বাবদ ১২ই মার্চ ৯ লাখ ৭ হাজার ২শ’ টাকা সিটি করপোরেশন বরাবর সোনালী ব্যাংকে জমা করার একটি চালানের কপিও মানবজমিনের কাছে রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী মানবজমিন’কে বলেন, আসলে দেশের পটপরিবর্তনের পর আমাদের সিটি করপোরেশনে বেশ কিছু অস্থিরতা বিরাজ করছিল। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের কিছু টেন্ডার আটকে রয়েছে। আলোচিত ধানমণ্ডি-৭ নম্বরের সেক্টরের জায়গাটিও তারই আওতায়। মূলত ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর, জিগাতলা ওই সবই ৭ নম্বর সেক্টরের আওতায়। আমরা আশা করছি কিছুদিনের মধ্যে ওই জায়গার টেন্ডার হয়ে যাবে। আর এই টেন্ডার না হওয়া পর্যন্ত ওই জায়গাটি জেড.এস এন্টার প্রাইজের কাছে ইজারা দেয়া হয়েছিল। আটক ওই যুবক ওই কোম্পানির লোক।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি’র ধানমণ্ডি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) শাহ মোস্তফা তারিকুজ্জামান মানবজমিন’কে বলেন, চাঁদা আদায়ের ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর তা আমাদেরও নজরে আসে। পরে আমাদের থানা পুলিশ অভিযুক্ত আশরাফুলকে আটক করে। তাকে আটকের পর আমরা প্রাইভেটকারের চালকদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু তাদের হদিস না পাওয়ায় এ বিষয়ে আশরাফুলসহ আরও ৪/৫ অজ্ঞাতনামা আসামি করে পুলিশ বাদী হয়ে ধানমণ্ডি থানায় একটি চাঁদাবাজি মামলা করে। যেহেতু সে আমাদের কাছে স্বীকার করেছে তার সঙ্গে আরও ৪/৫ জন জড়িত আছে সেই তথ্য জানতেই তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশনের ইজারার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরাও বিষয়টি শুনেছি। পুরো বিষয় নিয়েই আমাদের তদন্ত চলছে। এখানে দেখার বিষয়- কতোটুকু জায়গা সিটি করপোরেশনের। তারা কী বাসস্ট্যান্ডের পাশে ইজারা দিতে পারে কিনা? ওই গাড়িটি কি ওই পার্কিং এর জায়গায় ছিল কিনা? সবই যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, এখানে আমাদের সঙ্গে কারোর তো কোনো শত্রুতা নেই। পুলিশ তার নিজের কাজ করছে। তদন্ত করে যা পাওয়া যাবে তা আদালতে পেশ করা হবে। আদালত সেই তদন্ত রিপোর্টের প্রেক্ষিতে কি আদেশ দিবেন সেটা আদালতের এখতিয়ার। এখানে আমাদের তেমন কিছুই করণীয় নয়। তাই সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করবো তারা যেন আদালতের দ্বারস্থ হন। সবকিছু বিচারের ক্ষমতা একমাত্র আদালতের।
পাঠকের মতামত
ইজারার নামে চাঁদা বাজি বন্ধে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনতে হবে।
একটা ভিডিও একটা ছেলের জীবন শুধু নষ্টই করেনি,একটা পরিবারকে করেছে অসহায় আর একটা দলকে করেছে ক্ষতিগ্রস্ত। এভাবে ৫ আগষ্টের পর একদল শয়তান সেজেছে সাধু আর অন্যায় না করার পরও একদল মানুষকে বানানো হচ্ছে দেশ ও মানুষের শত্রু।আল্লাহ একমাত্র ন্যায় বিচারক।তিনি যথাসময়ে সবকিছুর বিচার করবেন ইনশাআল্লাহ।
পুলিশও কি পপুলিস্ট হওয়ার চেষ্টা করতাছে? ইজারাদারী বৈধ হলে, ইজারাদার কোম্পানী এবং ভুক্তভোগী কর্মচারীর উচিত পুলিশের বিরুদ্ধে, আর পুলিশের উচিত সেলিব্রেটির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা, ক্ষতিপূরন দাবী করা।
রাস্তা কিভাবে পার্কিং হিসাবে ইজারা দেয় সিটি কর্পোরেশন??? এষনও কি হাসিনা সরকারের ভুত দূর হয়নি? ইজারা দেয়ার বিষয়টি বৈধ আইনি ভিত্তি নেই। এটা আওয়ামী গুন্ডা তাপস গায়ের জোরে করেছিল। এই ইজারা বাতিল করা হোক। রাস্তাকে পার্কিং হিসাবে দেখতে চাই না।
Firstaple he has no identity card, no uniform and his behavir was not good, i appritiate car passenger and police.
লেকের পাড় ও সরকারি রাস্তা কিভাবে ইজারা হয়? এটা যখন যে সরকার খমতায় থাকে তাদের দলীয় লোক গুলো এটা করে। অবিলম্বে এই সব ইজারার নামে চাঁদা বাজদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
এগুলো পুলিশের অতি উতসাহ দেখানো।আসল চাদাবাজদের আড়াল করতেই এই মামলা।ভুক্তভোগীর খবর নাই পুলিশ বাদি হয়েই মামলা করলো কেন?
ইজারা কত হবে সেখানে ও ঝামেলা আছে, আমাদের নারায়ণগঞ্জ এর নবীগঞ্জ এ প্রতি ট্রিপে ১০ টাকা নিচ্ছে মানে সে লাইন গাড়ি যত বার যাবে তত বার টাকা দিতে হয়, একটি সি ন জি ১০ ট্রিপ গেলে ১০০ টাকা দিতে হবে, এটা কি যুলুম না