শেষের পাতা
একদিনে রেকর্ড ৪২৯ ডেঙ্গু রোগী
পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
১ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার
সারা দেশে দ্রুত বাড়ছে ডেঙ্গু। ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ৪২৯ রোগী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এবার রাজধানী ঢাকার পর বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় জেলা বরগুনায় ডেঙ্গু রোগী বেশি শনাক্ত হচ্ছেন। উপকূলীয় এই জেলাটি এখন ডেঙ্গুর হটস্পট। গত বছরের চেয়ে এ বছর দেশ জুড়ে ডেঙ্গুর তাণ্ডব অনেকটাই বেশি। এর মধ্যে আবার মৃত্যুর দিক থেকে ঢাকা এবং আক্রান্তের দিক থেকে বরিশাল রয়েছে শীর্ষে। এখনই পরিস্থিতি সামাল না দিলে সামনের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে আরও বাড়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
চলতি বছরের ৩০শে জুন পর্যন্ত এডিস মশাবাহিত রোগটিতে ৪২ জনের মৃত্যু হলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯ জন মারা গেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। যা মোট মৃত্যুর ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি বছর ডেঙ্গুতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২৯৬ জনে। এবার সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার ৫৯২ জন আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন বরিশাল বিভাগে, যা মোট রোগীর ৪৫ শতাংশ। এরমধ্যে বরগুনা জেলায় রয়েছেন ২ হাজার ৭৪৬ জন।
কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার এ বিষয়ে বলেন, চলতি বছরে বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ। বাস্তবচিত্র আরও ভয়াবহ বলে তিনি মনে করেন। কারণ অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছে বাসায় বা এমন হাসপাতালে, যেগুলোর রিপোর্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে যায় না। এই পরিসংখ্যানগুলো আমাদের সামনে এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদি এখনই মোকাবিলা করা না যায়, তাহলে আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশের অনেক জেলায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। আমাদের গবেষণা ফোরকাস্টিং মডেলের ভিত্তিতে বলা যায়, আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কক্সবাজার, গাজীপুর, পিরোজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাঁদপুর ও মাদারীপুর জেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক রূপ নিতে পারে। মে মাসের তুলনায় জুন মাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই প্রবণতার ভয়াবহতা নির্দেশ করে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ডেঙ্গু প্রবৃদ্ধি জ্যামিতিক হারে বাড়বে, যা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে লার্ভা ধ্বংস সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলেও দেশে অনেক এলাকায় নিয়মিত মনিটরিং বা লার্ভা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। জনবল সংকট, প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা এবং কার্যকর পরিকল্পনার অভাবে পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনগুলো এ কাজে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। এর ফলে অনেক এলাকায় নিভৃতে লার্ভা বেড়ে উঠছে এবং তা ডেঙ্গুর বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে। এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবও ডেঙ্গু মোকাবিলায় বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই জানে না কোথায় মশা ডিম পাড়ে, কীভাবে লার্ভা ধ্বংস করতে হয় কিংবা এডিস মশা কখন কামড়ায়। কেউ কেউ জানলেও দায়িত্ববান আচরণ করে না, বাড়ির ছাদ, বারান্দা বা আঙিনায় জমে থাকা পানির প্রতি সতর্কতা অবলম্বন করে না। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তন এখন এডিস মশার বিস্তারকে আরও ত্বরান্বিত করছে। ডেঙ্গুর বর্তমান এই পরিস্থিতি শুধু একটি রোগ নয়, বরং এটি জলবায়ু, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের সম্মিলিত সংকট, যার সমাধান জরুরি। এই সংকট মোকাবিলায় ব্যাপক ও সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া সম্ভব নয়।
একদিনে রেকর্ড ৪২৯ রোগী হাসপাতালে ভর্তি: ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৪২৯ জন রোগী। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪৯ জন আক্রান্ত বরিশাল বিভাগে। জুন মাসে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ৯৫১ জন এবং মারা গেছেন ১৯ জন। মে মাসে এই সংখ্যা ছিল ১৭৭৩ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, হাসপাতালে নতুন ভর্তিদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১৪৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৭ জন, ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় ৬১, ঢাকা উত্তর সিটিতে ৪২ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৪৫ জন, খুলনা বিভাগে ২১ জন এবং রাজশাহী বিভাগে ৫৪ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ১০ হাজার ২৯৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৪২ জনের। বরিশাল বিভাগে আক্রান্ত এবং ঢাকার দক্ষিণ সিটিতে মৃত্যু বেশি হওয়ার কারণ সম্পর্কে কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট দুই এলাকাতেই অনুকূল আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে এডিস মশার বংশবিস্তার বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটি করপোরেশনে বসবাসকারী একাধিক বাসিন্দার অভিযোগ, রাজধানীর প্রায় বেশির ভাগ ওয়ার্ডের বড় সমস্যা অভ্যন্তরীণ খালের দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানি। শহরের আবর্জনা ও ড্রেনের পানি নির্বিচারে খালে ফেলায় এসব খালের পানি দীর্ঘ বছর দূষিত কালচে দুর্গন্ধযুক্ত। এ ছাড়া অনেক এলাকায় ডোবানালাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় মশার উৎপাত বেড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডে অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীন উন্নয়নের ফলে মশার উপদ্রব বেশি। বাড়ির মালিক ও বসবাসকারীদের অবহেলায় বাসাবাড়ির ভেতরেও এডিস লার্ভা জন্ম নিচ্ছে। সিটি করপোরেশন চাইলেও যেখানে মশকনিধন সম্ভব নয়। আবার এডিস মশার লার্ভা নিধনে চিহ্নিত হটস্পটগুলোতে প্রয়োজনীয় মশক নিধন কার্যক্রম কম হচ্ছে। সবমিলিয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে।
এদিকে, আইডিসিআর সম্প্রতি গবেষণায় উঠে এসেছে বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় জেলা বরগুনায় ডেঙ্গু রোগী বেশি শনাক্ত হচ্ছে। জেলাটিতে সুপেয় পানির অভাব। বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখেন বাসিন্দারা। তাতে পুরনো পানি থেকেই যায়। এতেই মূলত মশা ডিম পাড়ে। প্রজনন বাড়ে। বরগুনার ৯ ওয়ার্ডের ৫টি ওয়ার্ডই ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। সদর উপজেলায় লার্ভার ঘনত্ব মিলেছে স্বাভাবিকের অন্তত সাড়ে ৮ গুণ বেশি। প্রভাব বিস্তার করছে ডেঙ্গুর ডেন-৩ ও ডেন-২ ধরন। আইইডিসিআর’র প্রিন্সিপাল বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. রত্না দাস বলেন, উপকূলীয় এলাকাটিতে সুপেয় পানির অভাব। বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখেন তারা। এতে ঢাকনাও দেন না। শুধু পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন। পুরনো পানি পরিবর্তন বা ফেলে দেন না। ব্যবহার শেষ হওয়ার আগেই এতে নতুন পানি যুক্ত করেন, তাতে পুরনো পানি থেকেই যায়। এতেই মূলত মশা ডিম পাড়ে। প্রজনন বাড়ে। এতে বেশি আক্রান্ত হওয়ার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে আক্রান্ত হয়েছে তাকে মশারির মধ্যে রাখা যায় না, বেরিয়ে যায়। বিশেষ করে বাচ্চারা খেলতে বেরিয়ে পড়ে। স্থানীয় সরকারের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুললে এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় সরকারের জনবলের অভাব আছে।