ঢাকা, ২২ জুন ২০২৫, রবিবার, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৪ জিলহজ্জ ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল

শাবিতে অজ্ঞান করে ছাত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ

ওয়েছ খছরু, সিলেট ও নাঈম শুভ, শাবি থেকে
২১ জুন ২০২৫, শনিবার
mzamin

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তো দূরের কথা। ওরা মানুষ না। নরপশু। এমন ঘটনা ক্যাম্পাসে সচরাচর ঘটেই না। নিজ সহপাঠীকে কোল্ড ড্রিংসের সঙ্গে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে অজ্ঞান করে রাতভর পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে দুই নরপশু। শুধু ধর্ষণই করেননি ওরা ধর্ষণের সময়কার ভিডিও ছবি তুলে রাখে মোবাইল ফোনে। এরপর ওই ভিডিও এবং ছবি দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে ফের মেসে আসার জন্য ডাকে। এমন ঘটনায় হতবাক হয়ে যান ওই ছাত্রী। বুঝে উঠতে পারছিলেন না। নিজের প্রতিও ঘৃণা জন্মে। বান্ধবীদের সঙ্গে শেয়ার করার পর পান সহযোগিতা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে জানানো হলে পুলিশের সহযোগিতায় ওই দুই নরপশুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে একটি ছাত্র মেসে। ওই ছাত্রী ক্যাম্পাসের একটি হলে বসবাস করেন। শান্ত ও পার্থ দুই বন্ধু। এক সময় তারা দু’জন ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত ছিল। শান্ত বসবাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে আখালিয়া খুলিয়াপাড়াস্থ একটি ছাত্রমেসে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। আর ওই ছাত্রী একটি হলে বসবাস করতো। শান্তর সঙ্গে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। ঈদের আগে ২রা মে নগরের রিকাবীবাজারে একটি কনসার্ট ছিল। ওই কনসার্টে যাওয়ার জন্য শান্তর পক্ষ থেকে ছাত্রীকে প্রস্তাব করা হয়। এতে রাজি হয় ওই ছাত্রী। সন্ধ্যায় সে শান্তকে নিয়ে আসতে নগরের খুলিয়াপাড়াস্থ তার বাসায় যায়। এ সময় শান্ত তাকে একটি কোল্ড ড্রিংস খেতে দেয়। সরল বিশ্বাসে সহপাঠীর দেয়া ওই কোল্ড ড্রিংস পান করে ছাত্রী। এরপর শান্ত কনসার্ট শুরু হয়েছে কিনা বিষয়টি জানতে তার সহপাঠী পার্থকে ফোন দেয়। 

পার্থ তাদেরকে নগরের সুবিদবাজারে আসার জন্য বলে। ফোন শেষ করে শান্ত ওই ছাত্রীকে নিয়ে সুবিদবাজারে চলে আসে। সেখানে আসার পর ছাত্রীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। মাথা ঝিমঝিম করে। নিজেকে সংবরণ করতে পারছিলেন না। বার বার ঢলে পড়ছিলেন। বিষয়টি শেয়ার করেন শান্ত ও পার্থ’র সঙ্গে। অনুরোধ করেন তাকে হলে পৌঁছে দিতে। এক পর্যায়ে শান্ত ও পার্থ দু’জন মিলে ওই ছাত্রীকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেও হলে না গিয়ে তারা শান্তর খুলিয়াপাড়াস্থ মেসে চলে যায়। সেখানে একটি বিছানায় তারা ওই ছাত্রীকে শুইয়ে রাখে। কিছু সময় পর ওই ছাত্রী অনুভব করেন পার্থ তার শরীরের সব কাপড় খুলে ফেলছে। তিনি কিছুটা স্মৃতি ফিরে পেয়ে পার্থকে আটকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পার্থ তাকে উলঙ্গ করে ওই মেসে ধর্ষণ করে। ঘটনার পর পার্থ তার বাসায় চলে গেলে শান্ত আসে ওই ছাত্রীর কাছে। সেও রাতে ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ওই ছাত্রী দেখেন তিনি বিবস্ত্র। এ সময় শান্ত তাকে ধমক দেয় এবং মারতে উদ্যত হয়। বলে ঘটনাটি জানিয়ে দিলে তাদের কাছে ধর্ষণের সময়কার ভিডিও এবং ছবি রয়েছে। সেগুলো দেখিয়ে দেবেন সবাইকে। 

এ ঘটনায় হতবাক হয়ে পড়েন ওই ছাত্রী। তিনি চলে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। সেখানে এলে নিজের সম্মানের কথা চিন্তা করে বিষয়টি কারও সঙ্গে শেয়ার করেননি। এমনকি ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের কাছে ঘটনাটি এড়িয়ে যান। ঘটনার পরদিন ৩রা মে ওই ছাত্রীর মোবাইলের হোয়াটসঅ্যাপে ধর্ষণকালীন সময়ের ভিডিও ও ছবি পাঠায় পার্থ। মেসেজে ওই ছাত্রীকে জানায় ঘটনাটি কাউকে না জানাতে। এতে ভয় পেয়ে যান ওই ছাত্রী। তিনি বিষয়টি তাৎক্ষণিক তার ঘনিষ্ঠ দুই বান্ধবীর সঙ্গে শেয়ার করেন। তারা ওই ছাত্রীকে অভয় দেন। পাশে থাকার কথা বলেন। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন বলে জানান। এতে সাহস পান ওই ছাত্রী। এদিকে- বিশ্ববিদ্যালয়  খোলার পর বুধবার বিকালে শান্ত ও পার্থ ওই ছাত্রীর সঙ্গে ক্যাম্পাসেই দেখা করে। এ সময় তারা ফের ভিডিও ও ছবি দেখিয়ে তাদের সঙ্গে মেসে আসার কথা বলে। নতুবা ভিডিও এবং ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়। তাদের এই হুমকিতে বিচলিত হয়ে পড়েন ওই শিক্ষার্থী। 

তিনি এ ঘটনাটি শেয়ার করেন তার বান্ধবীদের সঙ্গে। পরে তারা পরামর্শ করে ঘটনাটি বৃহস্পতিবার বেলা দুইটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মুখলেছুর রহমানকে জানান। এ সময় মুখলেছুর রহমান ঘটনাটি শুনে ওই ছাত্রীর কাছ থেকে লিখিত রাখেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে তারা ধর্ষক ওই ছাত্রকে ধরতে পুলিশের সহযোগিতা চান। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি জানার পর  মোবাইল ট্র্যাকিং চালিয়ে আখালিয়া এলাকা থেকে শান্ত ও পার্থকে আটক করেন। শান্তর পুরো নাম শান্ত তারা আদনান ও পার্থের পুরো নাম স্বাগত দাশ পার্থ। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। গণ-অভ্যুত্থানের পূর্বে তারা দু’জন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। শান্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি মামলার আসামিও। পরে অবশ্য সাধারণ ছাত্রের সঙ্গে মিশে ক্যাম্পাসে ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। 

এদিকে শান্ত ও পার্থকে আটকের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদেরকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তারা ঘটনা স্বীকার করে। সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ওই ছাত্রদের আটক করে নিয়ে আসে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। এ সময় তাদের কর্মকাণ্ডে ক্যাম্পাসে থাকা শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ জানায়। অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে মারতেও উদ্যত হন। পরে অবশ্য পুলিশ কড়া নিরাপত্তায় তাদেরকে ক্যাম্পাস থেকে নিয়ে আসেন। এরপর ধর্ষণের শিকার হওয়া ওই শিক্ষার্থী সিলেটের কোতোয়ালি থানায় এজাহার দাখিল করলে পুলিশ সেটিকে ধর্ষণ মামলা হিসেবে রেকর্ড করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ইসমাঈল হোসেন জানিয়েছেন- অভিযোগ পাওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যেই ডিজিটাল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে অভিযুক্তদের শনাক্ত করে প্রক্টর অফিসে হাজির করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে আমরা ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহায়তায় পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এদিকে আটকের পর ওই দুই শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার এসআই শামসুল হাবিব মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থী শান্ত ও পার্থকে শুক্রবার বিকালে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। দু’একদিনের মধ্যে তিনি আদালতে তাদের রিমান্ড প্রার্থনা করবেন বলে জানান। 

বিক্ষোভ ও মানববন্ধন: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনায় দুই ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি ধর্ষক শান্ত তারা আদনান ও স্বাগত দাস পার্থের ছাত্রত্ব বাতিলের দাবিও জানান আন্দোলনকারীরা। শুক্রবার তিন ধাপে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। জুমার নামাজের পর গোলচত্বরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে, বিকাল ৩টায় ভিক্টিম ছাত্রীর ব্যাচমেটরা ও বিকাল ৪টায় ‘ভয়েস ফর জাস্টিস’র ব্যানারে এ বিক্ষোভ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা ধর্ষণবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেন। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল হোসাইন বলেন, ধর্ষকের মানুষ বলে পরিচয় দেয়ার কোনো অধিকার নেই। এরা পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি অবিলম্বে ধর্ষকদের ছাত্রত্ব বাতিল করা হোক। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী রাফিয়া তাসকিন নুর দোলা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায়ও মেয়েরা নিরাপদ না। নিজের সহপাঠী কর্তৃক এই ধরনের ধর্ষণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। পাশাপাশি ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য প্রশাসনের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।

পাঠকের মতামত

ছাএলীগের এই দুটি জাফর ইকবালের মতাদর্শে দর্শিত।

রহমান
২১ জুন ২০২৫, শনিবার, ১:২২ অপরাহ্ন

ধর্ষনের শাস্তি মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হোক।

Hedayet Ullah
২১ জুন ২০২৫, শনিবার, ১০:২৭ পূর্বাহ্ন

এই ছাএ দুটা ড. জাফর ইকবালের শিষ্য

সোহাগ
২১ জুন ২০২৫, শনিবার, ৯:৫৮ পূর্বাহ্ন

তদন্ত সাপেক্ষে কঠিন শাস্তির দাবি করছি, এমন বিচার হোক,ভবিষ্যতে যাহাতে কেউ এই ঘটনার পুনরাবৃত্তির সাহস না পায়।

Shambhu Chandra dey
২১ জুন ২০২৫, শনিবার, ৯:৫২ পূর্বাহ্ন

হায়রে উচ্চ শিক্ষা আমাদের! সার্টিফিকেট দেয়, কিছু থিউরি দেয় কিন্তু মানুষ হবার কোন সিলেবাস আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নাই। প্রচলিত ছাত্র রাজনীতি আর শিক্ষা ব্যবস্থা দুটোই অমানুষ বানানোর কারখানা।

মুহাম্মদ মিজানুর রহম
২১ জুন ২০২৫, শনিবার, ৯:০৯ পূর্বাহ্ন

"পরে অবশ্য পুলিশ কড়া নিরাপত্তায় তাদেরকে ক্যাম্পাস থেকে নিয়ে আসেন।" কিছুদিন পর জামিন পাবে। তারপর আবার একই কাজ করবে। মানিকের সিশ্য হিসেবে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালন করবে। কি ক্ষতি হত ওদেরকে সবার হাতে ছেড়ে দিলে ?

পাঠক
২১ জুন ২০২৫, শনিবার, ১২:১৪ পূর্বাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status