শেষের পাতা
টার্গেট সহযোগিতা জোরদার
জোটবদ্ধ হলো বাংলাদেশ চীন ও পাকিস্তান
কূটনৈতিক রিপোর্টার
২২ জুন ২০২৫, রবিবার
পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদারের অঙ্গীকার নিয়ে জোটবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তান। সম্প্রতি চীনের ইউনান প্রদেশে এক সভা থেকে ওই জোটের ঘোষণা আসে। যদিও এ নিয়ে ঢাকার তরফে এখনো কোনো রাখঢাক করা হচ্ছে না। বৃহস্পতিবার কুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত চীন-সাউথ এশিয়া ফোরোমের ৬ষ্ঠ বৈঠকে যান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রুহুল আলম সিদ্দিকী। মূলত অন্তর্বর্তী পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে ওই দিনই ছিল তার শেষ কর্মদিবস। ২০শে জুন থেকে তার অবসরোত্তর ছুটি শুরু হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, চীন-সাউথ এশিয়া ফোরামের সাইড লাইনে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে ‘ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও গভীর করার প্রয়াসে একটি জোট গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। পাকিস্তানি সংবাদ মাধ্যম ডনের রিপোর্ট মতে, ত্রিদেশীয় জোট তথা পারস্পরিক সহযোগিতার ওই প্রতিশ্রুতি দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত ভূদৃশ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।
পাকিস্তান পররাষ্ট্র দপ্তর প্রচারিত এ সংক্রান্ত বিবৃতির বরাতে ডনের রিপোর্টে বলা হয়, ত্রিদেশীয় বৈঠকে চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান ওয়েইদং, বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রুহুল আলম সিদ্দিকী এবং পাকিস্তানের অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে প্রাথমিক অধিবেশনে যোগ দেন। রিপোর্ট মতে, নতুন ত্রিপক্ষীয় জোটের লক্ষ্য হলো সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, আরও বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে কাজ করা। বালুচ তার বক্তব্যে চীন এবং দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সম্পৃক্ততার আরও গভীর করার জন্য পাকিস্তানের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। তিনি চীন ও বাংলাদেশ উভয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। সেইসঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, কৃষি, ডিজিটাল অর্থনীতি, পরিবেশ সুরক্ষা, সমুদ্র বিজ্ঞান, সবুজ অবকাঠামো, সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দুই দেশের সঙ্গে কাজ করার জন্য পাকিস্তানের আগ্রহের কথা জানান। আলোচনার সময় সম্পাদিত চুক্তি বাস্তবায়ন করার জন্য তিনটি দেশ একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে সম্মত হয়। ডনের রিপোর্টে ত্রিপক্ষীয় প্ল্যাটফরম বিষয়ে বলা হয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের চিহ্ন। বিশেষ করে এটি পাকিস্তান এবং বাংলাদেশকে একত্রিত করেছে, যারা কয়েক দশক ধরে কূটনৈতিকভাবে দূরে ছিল। গত বছর বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে ইসলামাবাদ ও ঢাকার মধ্যে সম্পর্ক যথেষ্ট উষ্ণ হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে ঢাকা সক্রিয়ভাবে বৃহত্তর কূটনৈতিক দিগন্ত অনুসরণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে চীন ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গেই নতুন পর্যায়ের যোগাযোগ। চীন তার পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক কূটনীতি এবং আঞ্চলিক সংযোগ উদ্যোগের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব আরও গভীর করার চেষ্টা করেছে। মার্চ মাসে ইউনূসের বেইজিংয়ে রাষ্ট্রীয় সফর এবং তিস্তা নদী ও মোংলা বন্দরের মতো সংবেদনশীল অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য চীনকে বাংলাদেশের আমন্ত্রণ শেখ হাসিনার ভারতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নীতিগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। ইতিমধ্যে, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ন্যূনতম যোগাযোগের পর পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরাসরি বাণিজ্য, সামরিক বিনিময় এবং উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক সংলাপ পুনরায় শুরু করেছে। বেইজিংয়ের জন্য, ক্রমবর্ধমান ত্রিপক্ষীয় সম্পর্ক তার দীর্ঘমেয়াদি আঞ্চলিক লক্ষ্যগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস। যার মধ্যে রয়েছে বিকল্প অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণ, বঙ্গোপসাগরে তার উপস্থিতি সমপ্রসারণ এবং প্রতিবেশী অঞ্চলে ভারতের কৌশলগত স্থান হ্রাস করা। ভারতের জন্য, চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ জোট গঠন উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক এবং নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ হতে পারে, বিশেষ করে যেহেতু প্রস্তাবিত চীনা-সমর্থিত কিছু অবকাঠামো প্রকল্প ভারতের সংবেদনশীল উত্তর-পূর্ব করিডোরের কাছাকাছি অবস্থিত। যদিও ত্রিপক্ষীয় ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, এই সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা অন্বেষণের জন্য তিন দেশের সদিচ্ছার ইঙ্গিত দেয়। এই গ্রুপ দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে যদি অংশীদারিত্ব বিস্তৃত হয় এবং বৃহত্তর সংযোগ, প্রতিরক্ষা সংলাপ এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে সমন্বিত অবস্থান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদিও পরবর্তী দফার বৈঠকের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষণা করা হয়নি, তবে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠার ফলে একাধিক ক্ষেত্রে ফলো-আপ আলোচনা এবং সহযোগিতা ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বৈঠকে চীন-বাংলাদেশ-পাকিস্তান যৌথ সহযোগিতা সত্যিকারের বহুপাক্ষিকতা ও উন্মুক্ত আঞ্চলিকতাকে অনুসরণে জোর দেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে এটা স্পষ্ট করা হয়েছে যে, এটি নিজেদের উন্নয়নের জন্য, কারও বিরুদ্ধে নয়। বৈঠকে চীনের প্রতিনিধি সান ওয়েইদং বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভবিষ্যতের এক অভিন্ন সমাজ গড়তে চীন সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তার মতে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান- উভয়ই চীনের ভালো বন্ধু ও অংশীদার। পাশাপাশি তারা উচ্চমানের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারও বটে। চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্লোবাল সাউথের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং আঞ্চলিক অন্যতম প্রধান দেশ হিসাবে এই তিন দেশের সামনেই রয়েছে জাতীয় পুনরুত্থান ও আধুনিকায়নের লক্ষ্য, যা অর্জনে প্রয়োজন শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিবেশ। ওয়েইদং বলেন, চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ সহযোগিতা তিন দেশের জনগণের অভিন্ন স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তা আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনমান উন্নয়ন এই ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার মূল লক্ষ্য বলে জানান তিনি।