শেষের পাতা
যে কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমছে
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৪ মে ২০২৫, শনিবার
দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি আর্থিক সংকটের কারণে কমেছে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের বিক্রি। অন্যদিকে আগের কেনা সঞ্চয়পত্র মেয়াদপূর্তির পর ভাঙাচ্ছেন। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না বেড়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এ ছাড়া ট্রেজারি বন্ড ও ব্যাংকের সুদ বা মুনাফার হারও এখন ভালো। এ কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ না বেড়ে ঋণাত্মক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে বিক্রির চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা মনে করেন, বাস্তবতা হলো মানুষের সঞ্চয় কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ এখন সংকুচিত হয়ে গেছে। অনেকেই সঞ্চয়পত্র ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। অনেকেই মেয়ের বিয়ে বা ছেলে বিদেশে পড়তে যাবে এ কারণেও সঞ্চয়পত্র ভাঙছেন। এতে এ খাতে বিনিয়োগ কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনও বলছে, সঞ্চয়পত্রে মানুষের আগ্রহ কমছে। বিক্রির চেয়ে বাড়ছে ভাঙানোর পরিমাণ।
একজন বিশ্লেষক বলেন, সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সঞ্চয়ে উৎসাহ দেয়া খুব একটা ভালো পদক্ষেপ নয়। সঞ্চয়পত্র কেনা মানে সরকারের একটা কর্জ বা ধার করা। এখানে যদি উচ্চ সুদের হারে সরকারকে কিনতে হয় তাহলে এর বিপরীতে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ হয়ে যাচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানো বা সঞ্চয় বাড়ানো খুব ভালো উদ্যোগ নয়। তিনি বলেন, তবে কিছু সময়ের জন্য সরকার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদের জন্য করা আপাতত ঠিক হবে না। আসলে হয় কি ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্রং করে যারা সঞ্চয় করছে তারা ওসব জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারে। আবার যদি অন্য কোনো প্রকল্প করার সুযোগ থাকে যেমন বেসরকারি সেক্টরের বিনিয়োগ, সেটা ব্যাংকের মাধ্যমে সঞ্চয় কিনে বেসরকারি খাত পায়, তাহলে সেটা ভালো উপায়। কারণ আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থা দুর্বল, সেখানে উচ্চ সুদে ঋণ নিলে সরকার কীভাবে পরিশোধ করবে সেটা একটা বিষয় থেকেই যায়।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরে সাড়ে ৮৩ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্য সরকারের। এই লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ৩৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে প্রথম ৭ মাসে ৪৩ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙা হয়েছে। অর্থাৎ ৭ মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার যে টাকা পেয়েছে, সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর ফলে তার চেয়ে ৭ হাজার ১৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে। গত অর্থবছরের পুরো সময়ই (জুলাই-জুন) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ঋণাত্মক ধারায় ছিল। ১২ মাসে আগের আসল ও সুদ বাবদ ২১ হাজার ১২৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বিক্রির চেয়ে আগের সুদ-আসল বাবদ ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে।
গ্রাহকরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয়পত্র কেনার প্রবণতা কমেছে। বিপরীতে ব্যাংক আমানত ও সরকারের বিল-বন্ডের সুদের হার বেড়েছে। এসব কারণে সঞ্চয়পত্রের চেয়ে অন্য আর্থিক খাতকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে মানুষ। তাদের মতে, আগে একটা সময় সঞ্চয়পত্রের কোনো স্কিমের মেয়াদ শেষ হলে বেশির ভাগ গ্রাহক সেখানেই ফের বিনিয়োগ করতেন। এখন বিপরীত চিত্র। যাদের সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে তারা নতুন করে আর বিনিয়োগ করছেন না বা ক্রয় করছেন না। এতে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। বিক্রির চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ বেশি করতে হচ্ছে সরকারকে। আবার সরকারও এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
সোনালী ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে ব্যাংক ও বিল-বন্ডে ভালো রেট পাওয়া যায়। ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থাও বেড়েছে, সেখানে ১০ শতাংশ বা তারও বেশি সুদহার। আবার এক বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলে সুদহার এখন ১১.৬০ শতাংশ। এ কারণে সঞ্চয়পত্র ছাড়াও মুনাফার জন্য ভালো বিকল্প খুঁজছে অনেকে। অনেকেই আবার স্বর্ণেও বিনিয়োগ করছেন।
এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ১৮ হাজার কোটি টাকা ধরা হলেও সরকার এখান থেকে এক টাকাও ঋণ পায়নি। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরেও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা করেছে সরকার।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা খলিল বলেন, পেনশনের একটি অংশ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনেছিলাম। এখন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের চেয়ে ব্যাংকে লাভ বেশি। ব্যাংকের মাধ্যমে বন্ডে বিনিয়োগ করছি। ট্রেজারি বন্ডের মুনাফা অনেক ভালো।
আরেক গ্রাহক বলেন, স্বর্ণে বিনিয়োগ করবো। এখন প্রতিনিয়তই স্বর্ণের দাম বাড়ছে। গহনা তৈরি করলে ব্যবহার করতে পারবো, আবার দিন যত যাচ্ছে দামও বাড়ছে। তাই ভাবছি সঞ্চয়পত্রের টাকা স্বর্ণে বিনিয়োগ (গহনা তৈরি) করবো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, পরিচিতদের মধ্যে যাদের সঞ্চয়পত্র ছিল তারা বন্ডে-ট্রেজারি বিল বন্ডে বিনিয়োগ করছে। ব্যাংকগুলোরও রিটার্ন ভালো। মোটামুটি সব ব্যাংকই প্রায় ১০ শতাংশ বা তার কিছুটা বেশি রেট দিচ্ছে। সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙানো নিয়ে কিছুটা জটিলতা থাকলেও ব্যাংকে যেকোনো সময়ই ভাঙানো যায়। তাছাড়া স্বর্ণের দাম প্রতিনিয়তই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এ কারণে অনেকেই আবার সেখানেও বিনিয়োগ করছেন। এসব কারণে হয়তো সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কিছুটা কমছে।