শেষের পাতা
সিলেটের জৈন্তাপুর মেঘালয়ের লিজ বাতিল চাইছেন ২৫০০ পরিবার
স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট থেকে
২৪ মে ২০২৫, শনিবার
সিলেটের জৈন্তাপুরের চারিকাটা ইউনিয়ন। বেশির ভাগ এলাকাই টিলা-জঙ্গল ভূমি। টিলার ফাঁকে ফাঁকে বসতি। কয়েক হাজার পরিবারের বাস এখানে। পর্যটনস্পট লালাখালের পাশে অবস্থিত। এই এলাকায় ১২১৭ একর জমি লিজ নিয়ে চা-বাগান সৃজন করছে মেঘালয় নামের একটি কোম্পানি। তবে; নামেমাত্র শ’দেড়শ একর ভূমিতে বাগান করা হয়েছে। প্রায় ১৮ বছর ধরে বাগানের বিপক্ষে আন্দোলনে চারিকাটা ইউনিয়নের ৫ মৌজার প্রায় আড়াই হাজার পরিবারের কয়েক হাজার লোক। ভিটে-মাটি হারানোর শঙ্কায় বার বার সরকারের কাছে তারা লিজ বাতিলের দাবি করছে। এ নিয়ে উচ্চ আদালতেও গিয়েছিলেন তারা। আদালত বসবাসকারী ৯৩১ পরিবারকে পুনর্বাসন করে বাগান সৃজনের নির্দেশ দিয়েছেন। সম্প্রতি মেঘালয়ের লিজ বাতিলের দাবিতে এলাকাবাসী একাট্টা। মার্চ থেকে তারা আন্দোলন করছেন। ইতিমধ্যে ভূমি উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে লিজ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। ভূমি উপদেষ্টা বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রকল্পের নাম ‘দি মেঘালয় টি স্টেট ও খাদিজা বহুমুখী ফার্ম’। লিজ গ্রহীতা হচ্ছেন মোহাইমিন খান মানিক ও তার পরিবারের সদস্যরা। তারা সিলেটের সাবেক এক মন্ত্রী পরিবারের স্বজন।
২০১১ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি ওই ফার্মের নামে চারিকাটা ইউনিয়নের ভিত্রিখেল পূর্ব, ভিত্রিখেল পশ্চিম, ভিত্রিখেল উত্তর, নোয়াখেল উত্তর, নোয়াখেল দক্ষিণ মৌজার ১২১৭ একর ভূমি চা-বাগানের জন্য লিজ দেয় সরকার। কিন্তু ২০০৭ সাল থেকেই বাগানের বিপক্ষে আন্দোলনে এলাকার মানুষ। তারা জানিয়েছেন, বাগানের লিজ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয় ২০০৫ সাল থেকে। এরপর যখন সরকারের দপ্তর থেকে কার্যক্রম শুরু করা হয় তখনই তারা লিজ না দেয়ার জন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন শুরু করেন। তাদের আপত্তি উপেক্ষা করে ক্ষমতার জোরে বাগানের নামে ভূমি লিজ দেয়া হয়। পরবর্তীতে ওই ভূমিতে বসবাসকারী ৯৩১টি পরিবার উচ্চ আদালতে যান। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি বাগানের লিজ নবায়ন করে দেয় প্রশাসন। তবে ২০২৩ সালের ১২ই জুলাই উচ্চ আদালত ৯৩১ পরিবারকে পুনর্বাসন করে বাগান সৃজনের নির্দেশনা দেন। হাইকোর্টে মামলা থাকার কারণে ২০২৩ সালে পুনঃলিজের কাগজ সমঝে পায় লিজ গ্রহীতারা।
গত ১১ই মার্চ জৈন্তাপুরের এসিল্যান্ড সীমানা নির্ধারণ করতে গেলে স্থানীয়রা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। তারা আন্দোলন শুরু করলে সীমানা নির্ধারণ কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। ওই দিন থেকে আন্দোলনে রয়েছেন এলাকার হাজার হাজার মানুষ। ১৪ই মে তারা ভূমি উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে এ সংক্রান্ত একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। এতে তারা তিনটি কারণে মেঘালয়ের নামে ১২১৭ একর ভূমির লিজ বাতিল দাবি করেছেন। এ দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে; ২০১১ সালে তথ্য গোপন করে তৎকালীন সরকারের এক মন্ত্রীর দাপটের কারণে লিজ দেয়া হয়। তথ্য গোপনের বিষয় কী, সেটি জানিয়ে তারা বলেন- মেঘালয়ের লিজকৃত ভূমিতে আগে থেকেই হাজারো পরিবার বসবাস করছে। কিন্তু ২০০৫ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে এই ভূমি লিজ দেয়ার পক্ষে যে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছিল সেখানে তারা সম্পূর্ণ ভূমিকে অব্যবহৃত বলে উল্লেখ করেছে। ওই রিপোর্টে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। পরে ২০০৯ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যে রিপোর্ট দাখিল করেছিলেন সেখানে ২৫-৩০টি পরিবারের অবস্থান রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। এরপর এলাকাবাসীর যথাযথ প্রমাণ দাখিল সাপেক্ষে উচ্চ আদালত ৯৩১টি পরিবারকে পুনর্বাসনের নির্দেশ দেন।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি হচ্ছে; পূর্ব থেকেই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ার কারণে ওই ভূমি চা-বাগানের জন্য উপযুক্ত নয়। সুতরাং বাগানের নামে যে লিজ দেয়া হয়েছে সেটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ওই সময় মন্ত্রীর পরিচয়ে অনেকটা জোরপূর্বকভাবে বাগানের নামে লিজ নেয়া হয়।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে; প্রথমে ৫ বছরের জন্য লিজ নিলেও সরকারের বেঁধে দেয়া বাগান সৃজনের নিয়ম কোম্পানি পূরণ করতে পারেনি। এ ছাড়া আদালতের নির্দেশ মতো ৯৩১টি পরিবারকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ তো দূরের কথা আলোচনাও করা হয়নি। এতে আদালতের নির্দেশকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ৫ মৌজা ঐক্যপরিষদের সমন্বয়ক ও ভুক্তভোগী আলতাফ হোসেন বিলাল মানবজমিনকে জানিয়েছেন- আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এক মন্ত্রীর দাপটে তথ্য গোপন করে লিজ নিয়ে জোরপূর্বকভাবে তারা বাগান সৃজন করার চেষ্টা করে। অতীতে এলাকার অনেক প্রতিবাদী মানুষকে তারা হয়রানি করেছে। এবার একইভাবে তারা নাটক করছে। এটা ৫ মৌজা সহ জৈন্তাপুরের মানুষ তাদের ভূমি নিয়ে নাটকীয়তা কখনো মেনে নেয়নি, নেবে না। চারিকাটা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন- বসবাসকারী পরিবারের তথ্য নিয়ে সরকারি পর্যায় থেকে একেক সময় একেক রিপোর্ট দেখা হয়েছে। এতে প্রমাণ হয় লিজ দেয়ার আগে রিপোর্ট সঠিক ছিল না। বাস্তবতা হচ্ছে এখন লিজকৃত ভূমিতে আড়াই থেকে তিন হাজার পরিবার রয়েছে। তিনি বলেন- আমাদের ধারণা লিজ গ্রহীতাদের মূল উদ্দেশ্য বাগান সৃজন করা নয়, এই ভূমিকে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করা। এজন্য তারা শত শত বছর ধরে বসবাসকারী লোকজনকে উচ্ছেদ করতে চাইছে। চারিকাটা পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন দরবস্তের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবদলের সভাপতি বাহারুল ইসলাম বাহার জানিয়েছেন- মানুষ যা চায় আমরা মানুষের পক্ষে।
জৈন্তাপুরের রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক মুজিবুর রহমান ডালিম জানিয়েছেন- বর্তমান সরকারকে ইনসাফ করতে হবে। এজন্য নতুন করে নিরপেক্ষ তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে প্রকৃতপক্ষে এখানে কতোটি পরিবার বসবাস করছে। এরপর সরকার চিন্তা করতে পারবে বাগান থাকবে না বসতি থাকবে। এটিই এখন চায় এলাকার মানুষ। ‘দি মেঘালয় টি স্টেট ও খাদিজা বহুমুখী ফার্ম’-এর ম্যানেজার আব্দুল হালিম মানবজমিনকে জানিয়েছেন- জনবসতিপূর্ণ এলাকায় চা-বাগান হয় না। যখন লিজ দেয়া হয় তখন সেখানে কয়েকটি পরিবার ছিল। পরে বাইরে থেকে লোকজন এসে ১০-১২ একর করে জমি দখলে নিয়েছেন। তিনি বলেন- এখন যারা ভূমিতে রয়েছেন তাদেরকে উচ্ছেদের কথা কেউ বলছে না। প্রশাসন থেকে সীমানা নির্ধারণ করে আমাদের ভূমি বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। তখন এলাকার কিছু সংখ্যক মানুষ বাধা দিয়েছেন। তিনি বলেন- সরকারের সব নিয়ম মেনেই লিজকৃত ভূমিতে বাগান সৃজন করছেন। এটি চা বাগানের বোর্ডের অধীনে একটি তালিকাভুক্ত বাগান বলে জানান তিনি।