শেষের পাতা
শাহবাগের জমায়েতে বিএনপি’র যে বিপদ দেখছেন ডা. জাহেদ উর রহমান
স্টাফ রিপোর্টার
১২ মে ২০২৫, সোমবার
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. জাহেদ উর রহমান তার ইউটিউব চ্যানেল ‘জায়েদ টেক’ -এ ‘শাহবাগের জমায়েতে বিএনপি’র যে বিপদ’ শিরোনামে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। এতে তিনি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগে জমায়েতের নানানদিক বিশ্লেষণ করেন। বলেন, বিএনপিকে স্টিকমাটাইজড করা কারও কারও খোয়াব হতে পারে। এরকম পরিস্থিতি দফায় দফায় তৈরি করে নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে তোলার চেষ্টা থাকতে পারে। এটা একটা শক্তি পরীক্ষা বিএনপি’র বাইরের যারা মাঠে আছেন তাদের সবাইকে নামাতে পারছেন কীনা এবং কতো শক্তিতে মাঠে নামাতে পারছেন।
ডা. জাহেদ বলেন, নানা ঘটনা ঘটলো। শাহবাগ মোড় অবরোধ করা হলো। সেই শাহবাগ মোড় যেখানে গণজাগরণ মঞ্চ হয়েছিল। আগের মতোই অবরোধ করে চাপ তৈরি করা হলো। চাপের মাধ্যমে কিছু অর্জন করার চেষ্টা করা হলো। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়া ছাত্রদের একাংশ। প্রত্যেক ছাত্ররা তাদের জায়গায় ফিরে গেছে। ছাত্রদলে ফিরে গেছে, শিবিরে ফিরে গেছে। তাদের নিজস্ব রাজনীতি আছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইক্সক্লুড (বাইরে রাখা) হলো। যারা কোনো দল করে না তারা লেখাপড়ায় ফিরে গেছে। ছাত্রদের একটা ক্ষুদ্র অংশ যারা এনসিপিতে গেছে বা আরও যারা কিছু সংগঠনে জড়িত আছে তাদের ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা বৃদ্ধি পেলো।
রাজনৈতিক এই বিশ্লেষক বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই তারা রাজনীতিতে ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে এই অংশটি। এই ম্রিয়মাণ পরিস্থিতি থেকে এটা তাদের খানিকটা বাঁচিয়ে তুলতে পারে, সেটা তারা মনে করেছেন। তারা একটা বিজয় চাইছে। শুধু তারা না, তাদের যারা বুদ্ধি পরামর্শ দেন... অনেক মানুষ আছেন যাদের বক্তব্যে বোঝা যায়। আরেকটা উদ্দেশ্য বেরিয়ে এসেছে, সেটা হলো বিএনপি’কে বিপদে ফেলা। এগুলো রাজনীতির খেলা। আমরা খেয়াল করলাম ক্রমাগত বিএনপিকে ডাকা হচ্ছে। সারজিস আলম ঐক্যবদ্ধ শাহবাগে বিএনপিকে আশা করছেন এমনটাই বলছেন। বেগম খালেদা জিয়াকেও আহ্বান জানানো হয়েছে। তিনি ওখানে যাবেন এবং ঐক্য প্রকাশ করবেন এটা চাওয়া হয়েছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের এই সদস্য বলেন, গত শুক্রবার তারা ৩ দফা দাবি দিয়েছে। হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন- আওয়ামী লীগসহ যত সহযোগী সংগঠন রয়েছে তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে আওয়ামী লীগের দলগত বিচারের বিধান যুক্ত করতে হবে। তৃতীয়ত, জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র জারি করতে হবে। তিনি বলছেন, এই দাবি না মানা হলে কী আমরা মাঠ ছাড়বো? সবাই সমস্বরে বলেছেন, না।
তিনি বলেন, যেকোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হতে পারে সন্ত্রাস দমন আইনে। জামায়াত-শিবিরকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করেছিল এই আইনে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে যদি নিষিদ্ধ করাই হয়, তাহলে আইসিটিতে কোনো তাদের বিচার করার কথা বলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে এটা স্ট্যাবলিশ করতে চাইছে? সন্ত্রাস দমন আইনে যদি নিষিদ্ধ হয়েই যায় তাহলে ওটার দরকার কী? জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র না হলে তারা মাঠ ছাড়বেন না। আইসিটিতে এই বিধানটা করা কঠিন কিছু না। জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে কথাবার্তা হয়েছিল সেটা কন্টিনিউ করেনি। অনেকক্ষেত্রে বিভিন্ন দলের মতানৈক্য ছিল। এটা করতে বেশকিছু দিন লেগে যেতে পারে। তাহলে তারা সেই শাহবাগের মতো দুটো শাহবাগ হবে ভবিষ্যৎ ইতিহাসে। জানি না ওই শাহবাগের কাছাকাছিও হয়েছি কীনা।
ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, জামায়াতে ইসলামী নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করেন। তারা কন্সটিটিউশন মেনে চলে, তাদের ইসলামপন্থা রয়েছে। কিন্তু শাহবাগে কন্সটিটিউশনাল পলিটিক্স-ডেমোক্রেসি দেখতে পারে না, খেলাফত চায় এ ধরনের সংগঠনগুলোও হাজির হয়েছে। আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট বলা হয়... আবার তারাই এসেছেন যারা নিজস্ব মতবাদ চাপিয়ে দিতে চান গায়ের জোরে।
বিএনপি’র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপি এখানে যাচ্ছে না। বিএনপি সুতরাং আওয়ামী লীগের দোসর, এই ন্যারেটিভ চালিয়ে দেবার চেষ্টা হতে পারে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ-সম্পর্ক আছে সেজন্য বিএনপি না গেলে ভারতের দোসর হিসেবেও স্ট্যাবলিশ করা হতে পারে। সেটারই চেষ্টা চলছে। রীতিমতো বেগম খালেদা জিয়াকেও ডাকা হচ্ছে। এই মুহূর্তে রাজনীতিতে তিনি সবথেকে রেসপেকটেড মানুষ। তাকেও স্টিকমাটাইজড করা হচ্ছে, দারুণ কিছু ভাষা দিয়ে। তারা বলতে পারেন, খালেদা জিয়াকে আমরা ডেকেছিলাম আওয়ামী লীগের বিচার চেয়ে তিনিও আসেন নাই। তিনিও কতো খারাপ; এটা এখন বলা না হলেও ভবিষ্যতে বলা হতে পারে। বিএনপি এটার জবাব দিয়েছে। জনাব মঈন খান বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কীনা সেটা বিএনপি নয় জনগণ ঠিক করবে। যেসব রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কথা বলছে, তারা তাদের বক্তব্যে বলেছে। আমাদের মহাসচিব ইতিমধ্যেই বলেছেন, এটা জনগণের সিদ্ধান্তের বিষয়। তিনি বলেন, এটা সরকার এবং নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
তিনি যোগ করেন, যতদূর জানি এটা নির্বাচন কমিশন করতে পারে না। যদি তারা ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করতে না পারে। সেক্ষেত্রে তারা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে না কিন্তু দল হিসেবে থেকে যাবে। দল নিষিদ্ধের কাজ আসলে সরকারের। বিএনপি এক ধরনের অবস্থান জানিয়েছে, আমি এটা ধারণা করি এটা অনেকেরই ভালো লাগবে না। সত্যিকার অর্থে বিএনপি’র জন্য একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ একটা পপুলার দাবি। তবে পপুলার দাবি যে সবসময় সঠিক এটা বলছি না। ২০১৩ সালে যখন গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়, আমার চারপাশের প্রচুর মানুষকে দেখেছি এটার পক্ষে দাঁড়াতে। সেই শাহবাগ পরে কী করেছিল তা আমরা দেখেছি। বিএনপি’র ২০০১-০৬ সরকারের সময় ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করা শুরু হলো, ভীষণ পপুলার ছিল। এটা ছিল অসভ্যতা-বর্বরতা। কিন্তু বিএনপি তো পপুলার পলিটিক্স করে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধতা চায়। আওয়ামী লীগ মানুষের ওপর নির্যাতন করেছে, ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পপুলার দাবিতে বিএনপি যখন যাবে না তখন একটা বড় অস্ত্র হবে যারা বিএনপি’র বিরুদ্ধে রাজনীতি করবে। রাজনীতিতে ঠিক আছে কিন্তু এরমধ্যে কারও কারও অন্যরকম স্বপ্ন আছে।
তিনি বলেন, এখন বিএনপি কী করতে পারে? হাসনাত আব্দুল্লাহ ডাক দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে জামায়াত মিছিল নিয়ে গেছে। বিভিন্ন সংগঠন ভাগ ভাগ হয়ে শাহবাগে বসেছেন। অনেকেই দলীয় ব্যানার নিয়ে গেছেন, দলীয় স্লোগানও দিয়েছেন। সেখানে কেন বিএনপি যাবে? এখানে কিছু গায়ের জোরে চাপিয়ে দেয়া ইসলামিস্ট, গণতন্ত্রবিরোধী ইসলামিস্ট আছে। ধরে নেই, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সর্বোচ্চ একটা প্রতিনিধিদল সেখানে গেল বা একটি প্রতিনিধিদল গেল। এটাকে এনসিপি, জামায়াত বিজয় হিসেবে উদ্?যাপন করবে। তারা বলবে চাপের মুখে বিএনপি আসতে বাধ্য হয়েছে।
রাজনৈতিক এই বিশ্লেষক আরও বলেন, বিএনপি এটা হয়তো ভাবছে- আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপি কোনোদিন প্রতিবাদ করেনি। আমার যতদূর মনে পড়ে তারা বলেছে, এক্সিকিউটিভ অর্ডারের মাধ্যমে তারা কোনো দল নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়। তারা বলছে জনগণ যদি চায়। বিএনপি নিউট্রাল অবস্থান রাখতে চাইছে। আওয়ামী লীগের পক্ষে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিএনপি’র থেকে আওয়ামী লীগের হাতে বেশি নির্যাতিত কেউ হয় নাই। দলটাকে আবার প্রমাণ করতে হবে বিএনপি যে আওয়ামী লীগ বিরোধী। এটা যদি না করে তবে মোটাদাগে একটা অস্ত্র বিএনপি বিরোধীদের হাতে চলে যাবে। নির্বাচনে কিছুটা প্রভাব পড়তেও পারে। এটাকে ব্যবহার করা হবে জনসভা, বক্তৃতাতে। যদিও আমি মনে করি, এটা ব্যবহার করাও উচিত। রাজনীতি এটাই হওয়া উচিত, অপরপক্ষের নেগেটিভ বিষয়গুলো নিয়ে বলা উচিত। কিন্তু বিএনপিকে স্টিকমাটাইজড করা কারও কারও খোয়াব হতে পারে। এররকম পরিস্থিতি দফায় দফায় তৈরি করে নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে তোলার চেষ্টা থাকতে পারে। এটা একটা শক্তির পরীক্ষা, বিএনপির বাইরের যারা মাঠে আছেন তাদের সবাইকে নামাতে পারছেন কীনা এবং কতো শক্তিতে মাঠে নামাতে পারছেন। নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে হাসনাত আব্দুল্লাহ যদি ঢুকে যেতে পারেন, এটা অবিশ্বাস্য বিষয়। একটা সরকারপ্রধানের বাড়ির ওদিকে মিছিল নিয়ে কতোটুকু দূরত্বে কে যেতে পারবেন এটা ক্লিয়ারলি রিটেন থাকার কথা। আছেও। কিন্তু যাওয়া গেছে। সেখান থেকে শাহবাগ ব্লকেড হয়েছে। কোনোদিন নির্বাচনের ডেট হলে নির্বাচন পেছাও বলে ব্লকেড। গণভোট করো, ড. ইউনূস থাকবেন কীনা; সেই দাবিতে ব্লকেড। এগুলো সামনে আসতে পারে। এই জমায়েত থেকে সেই পরীক্ষা চলছে বলে আমার মনে হয়।
উল্লেখ্য, এই ভিডিও বার্তা প্রকাশের পর শনিবার রাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচারকার্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠনের অবস্থান কর্মসূচি চলার মধ্যেই সরকারের তরফে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
পাঠকের মতামত
পরিস্থিতি এখন ঘোলাটে! শেষ পর্যন্ত গনতন্ত্র আবার শিকল বন্দী হয় কি না, কিংবা দেশ আবার অরাজকতার দিকে ধাবিত হয় কি না, খুবই জটিল প্রশ্ন! দেশ আবার অরাজকতার দিকে এগিয়ে গেলে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে কি না গভীর ভাবে ভেবে দেখতে হবে!