শেষের পাতা
সিলেট সীমান্তে ফের সক্রিয় হলো চোরাই সিন্ডিকেট
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
২৪ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার
সিলেটে চোরাচালানকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে চাইছে প্রশাসন। সেজন্য চতুর্মুখী অভিযান চলছে। কিন্তু এসব অভিযানের ফাঁক গলিয়ে ফের সক্রিয় হয়েছে চোরাই সিন্ডিকেট। সীমান্ত দিয়ে আসছে বানের পানির মতো পণ্য। রুটও বদল করা হয়েছে। এ কারণে প্রশাসনের অনেককেই ‘ম্যানেজ’ করে চোরাচালান করা হচ্ছে। সিলেটের চোরাই রাজ্য বলে খ্যাত হরিপুর। ঈদের আগে সেনাবাহিনীর অভিযানে এই রাজ্য এখন অস্তিত্ব সংকটে। চিহ্নিত চোরাকারবারিরা পালিয়েছে এলাকা ছেড়ে। কেউ কেউ দেশ ছেড়েও পালিয়ে গেছে। এই অবস্থায় রুট পরিবর্তন করে ফের সক্রিয় হয়েছে হরিপুরের চোরাকারবারিরা। তাদের অনেকেই এখন জৈন্তাপুরের পার্শ্ববর্তী গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাটে অবস্থান নিয়েছেন। সেখান থেকে তারা চোরাচালান করছে। গোয়াইনঘাটের সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজন জানিয়েছেন- উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে চোরাই মালামাল। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঢাকার ব্যবসায়ীদের কসমেটিক্স সহ নানা পণ্য। এসব পণ্য দীর্ঘদিন ধরে হরিপুরের ব্যবসায়ীরা ক্যারিয়ার হিসেবে পৌঁছে দিচ্ছে। এতে মাঝখানে তারা লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। হরিপুরে সেনা অভিযানের পর মালামাল আটক হওয়ায় কিছু দিন চোরাচালান বন্ধ ছিল। ওই সময় প্রাণ ভয়ে হরিপুরের ব্যবসায়ীরা সিলেট থেকে পালিয়ে যান। সম্প্রতি তারা সিলেটে ফিরেছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই অবস্থান নিয়েছেন গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি, হাদারপাড়, মাতুর তল, হাজীপুর, জাফলং সহ কয়েকটি এলাকায়। সেখান থেকে তারা চোরাই পণ্য রিসিভ করে ট্রাকযোগে ঢাকায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয় লোকজন জানান- হরিপুর ছিল সবচেয়ে বড় পশুর হাট। সেটি এখন আর নেই। বর্তমানে গোয়াইনঘাটের তোয়াকুল বাজারে সবচেয়ে বড় চোরাই পশুর হাট বসে। বিছনাকান্দি এলাকা দিয়ে প্রতিদিন শত শত পশু সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ঢুকে।
স্থানীয় চোরাকারবারি কামাল সহ কয়েকজন সিন্ডিকেট করে এসব পশু বিজিবি ও পুলিশের সঙ্গে আঁতাত করে নিয়ে আসেন। এই পশুগুলো তোয়াক্কুল বাজারে এনে সিট দিয়ে বৈধ করা হয়। এরপর সেগুলো কোম্পানীগঞ্জ, সালুটিকর দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে দেয়া হয়। প্রতিদিন ওই হাটে কোটি টাকার পশু বেচাবিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন এলাকার মানুষ। বিছনাকান্দি এলাকা দিয়ে আসে ঢাকার ব্যবসায়ীদের কসমেটিক্স সহ অন্যান্য মালামাল। এই মালগুলো হাদারপাড় এলাকায় এসে ট্রাকে করে সালুটিকর আসে। এরপর বাদাঘাট সড়ক ও এয়ারপোর্টের বাইপাস সড়ক দিয়ে সুনামগঞ্জ রুট ধরে চলে যায়। নতুন করে রুট হওয়ায় এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে পড়েনি পাচার হওয়া এসব চালান। সালুটিকর এলাকার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন প্রতিদিন চোরাচালানের শত শত ট্রাক ওই এলাকা দিয়ে চলে যায়। বেশির ভাগ চালান যায় ঢাকায়। হরিপুরের ব্যবসায়ীরা হাদারপাড় ও বিছনাকান্দি এলাকায় অবস্থান নিয়ে তাদের পুরাতন ব্যবসা চালাচ্ছেন। দ্বিতীয় স্পট হচ্ছে গোয়াইনঘাটের মাতুরতল, সোনারহাট সহ কয়েকটি এলাকা। এসব এলাকা দিয়ে পশু নামে। এগুলো রাধানগর বাজারে এসে বৈধ হয়ে যায়। হরিপুরের চোরাকারবারিরা ওই এলাকার চোরাকারবারিদের পার্টনার। গ্রেপ্তার এড়াতে তারা সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকাতে অবস্থান নিয়েছেন। প্রথমে তারা নীরব থাকলেও এখন পুরাতন ব্যবসা চালাচ্ছেন। গোয়াইনঘাট থানার সম্মুখ দিয়ে তারা চোরাই মালামাল নিয়ে এসে হাতিরপাড়া রুট দিয়ে ধোপাগুল হয়ে ঢাকায় চলে যায়। ওই রুট দিয়ে প্রতিদিনই পণ্যবাহী শতাধিক মিনি ট্রাক প্রবেশ করে বলে জানিয়েছেন গোয়াইনঘাট সদরের বাসিন্দারা।
তারা জানিয়েছেন, অনেক চাঁদাবাজ চক্র পথে পথে ট্যাক্স বসিয়ে এসব গাড়ি থেকে চাঁদাবাজি করে। গোয়াইনঘাট থানা পুলিশ ‘ম্যানেজ’ থাকায় চোরাই পণ্যের মালামাল কখনোই আটক হয় না। হরিপুর চোরাই রাজ্যের পতন হওয়ার কারণে কানাইঘাটে বেড়েছে চোরাচালান। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার এড়াতে হরিপুরের অনেক ব্যবসায়ী কানাইঘাটে অবস্থান নিয়েছে। তারা লালাখাল সীমান্ত, কালীবাড়ী-বাদশাবাজার সীমান্ত ও লোভা সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে কসমেটিক্স সহ নানা পণ্য নিয়ে আসে। এসব পণ্য কানাইঘাট বাজার দিয়ে শাহবাগ হয়ে ঢাকায় যায়। আবার কেউ কেউ বোরহানউদ্দিন রুট ধরে পণ্য নিয়ে আসেন সিলেট নগরের টুলটিকর সহ কয়েকটি এলাকায়। সেখান থেকে বড় ট্রাকে করে পণ্য ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। রাত হলেই কানাইঘাটের সড়কগুলো সরব হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন এলাকার মানুষ। জৈন্তাপুর বাজারে বৈধ হয় চোরাচালানের পশু: সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা সদর বাজারে বৈধ হয় ভারতীয় পশু। প্রতিদিন ২ থেকে ৩ শতাধিক পশু সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ করে জৈন্তাপুর বাজারে। বাজার থেকে বৈধ চালান নিয়ে যাচ্ছে উপজেলার বিভিন্ন বাজার সহ সিলেট ও বিভিন্ন জেলায়। কিছুদিন পূর্বে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর বাজারে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার পর থেকে ধীরে ধীরে জৈন্তাপুর বাজার হয়ে উঠে চেরাচালানের বৈধ হাট। আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর অভিযানে ইতিমধ্যে জৈন্তাপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে মাদকদ্রব্য আটক করা হলেও দেদারছে বাজারে প্রবেশ করছে ভারতীয় গরু-মহিষ-ছাগল।
বাজার থেকে এসব গরু-মহিষ বৈধ কাগজ নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন বাজার সহ সিলেট ও জেলার বাইরে প্রেরণ করা হচ্ছে। এলাকাবাসী জানান, বিজিবি’র লাইনম্যান ও নিজে চোরাচালান ব্যবসায়ী হওয়াতে জৈন্তাপুর গরুর বাজার ইজারাদার নিযুক্ত হওয়ায় একক আধিপত্য বিস্তার করে বাজারে গরু-মহিষ প্রবেশ করছে। আব্দুল করিম ওরফে ব্যান্ডিজ করিম নিজে ইজারাদার ও বিজিবি’র লাইনম্যান হওয়ার কারণে এখন উল্লিখিত চোরাকারবারিদের নিয়ে জৈন্তাপুর বাজার থেকে বৈধ চালান নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন বাজার সহ সারা দেশে প্রেরণ করা হয়। হরিপুর বাজারে অভিযানের পর থেকে সীমান্তের জৈন্তাপুর বাজার এখন চোরাকারবারিদের নিয়ন্ত্রণে ব্যবসা পরিচালনা করছে। জৈন্তাপুর উপজেলায় গরু-মহিষ বাজারজাত করণে কোনো খামার নেই। তবুও জৈন্তাপুর বাজারে প্রতিদিন শত শত ভারতীয় গরু- মহিষ বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রয় হচ্ছে। জৈন্তাপুর মডেল থানার ওসি আবুল বাশার মো. বদরুজ্জামান জানিয়েছেন- সীমান্তের অতি নিকটে বাজার হওয়ার পরে পুলিশ অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে। তবে সীমান্তের বিষয়টি অন্যান্য বাহিনী দেখভাল করছে বলে জানান।