ঢাকা, ২ জুলাই ২০২৫, বুধবার, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৫ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

শেষের পাতা

জুলাই আন্দোলন

চট্টগ্রামে পর্দার অন্তরালের নায়ক ছাত্রদল নেতা শাহীন

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে
২ জুলাই ২০২৫, বুধবার
mzamin

১৮ই জুলাই, ২০২৪। একরাশ শঙ্কা আর শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা বুকে নিয়ে চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটের গলিপথ ধরে ছুটছে হাজারো ছাত্র-জনতা। চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে দমন-পীড়নের করাল ছায়া। দু’দিকে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। অন্য 
দু’দিকে পুলিশ। তাদের হাতে বন্দুক, রামদা আর চোখে হিংস্রতা। তবুও থেমে নেই জনতার মিছিল। যে মিছিলের ভিড়ে ছিলেন মোহাম্মদ শাহীনও। সেদিন শরীরে বেশ কয়েকটি বুলেট তাকে থামাতে পারেনি। প্রতিদিন পুলিশের বাধা ডিঙিয়ে দলবল নিয়ে মাঠে থাকতেন তিনি। চট্টগ্রামের জুলাই আন্দোলনের রাফি-রাসেলরা গণমাধ্যমের কল্যাণে পরিচিতি পেলেও শাহীনরা থেকে গেছেন পর্দার অন্তরালে।

ছাত্রদলের পাঁচলাইশ থানা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ শাহীন। পুরো পরিবার বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় আওয়ামী প্রশাসনের হাতে বিভিন্ন সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০২১ সালে শাহীনের বড় ভাই নগর ছাত্রদলের সাবেক সহ-সম্পাদক সাইফুল ইসলামকে ক্রসফায়ারের নাটক করে শরীর থেকে পা বিচ্ছিন্ন করে পুলিশ। জুলাই আন্দোলনে ছোট ভাই ফাহিমও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সাইফুল-শাহীনদের বিশাল কর্মী বাহিনী মুরাদপুর, দুই নম্বর গেট, বহদ্দারহাটে পুলিশ ছাত্রদলের সঙ্গে সংঘর্ষে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বয়স মাত্র ২৫। শরীর জুড়ে গাঢ় হয়ে আছে আন্দোলনের আঁচড়। যে দেশে স্বপ্ন দেখা দায়, সেখানে দাঁড়িয়ে শাহিন দেখেছে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বড় ভাইয়ের পা হারানো। দেখেছে পুলিশের বারবার অভিযানে কেঁপে ওঠা সংসার। সেই অভিজ্ঞতাই তার ভেতরে জন্ম দিয়েছিল এক অবিনাশী জেদ। আর সেই জেদই তাকে টেনে এনেছিল রাজপথে মুক্তির নামে, ন্যায়ের দাবিতে।
১৫ই জুলাই, ঢাকায় ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগের বর্বর হামলার প্রতিবাদে শাহীন ও তার ভাই ফাহিম পলিটেকনিক মোড়ে তরুণদের নিয়ে বের করেছিলেন মিছিল। রক্তে লেখা সেই রাতের প্রতিক্রিয়ায় পুলিশ তৎপর হয়। রাতেই গিয়ে হাজির হয় তাদের বায়েজীদের বাসায়। ‘ভাইদের একজনকে ধরিয়ে দাও, নয়তো গোটা পরিবার বিপদে পড়বে।’ সেদিন কোনোমতে পালিয়ে যান তারা। আর বাড়িমুখো হওয়া হয়নি। আত্মীয়ের বাড়িতে রাত। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মিছিল। এই ছিল তখনকার জীবনচিত্র। শাহীনের ভাইয়েরা পরদিন কোথায় কর্মসূচি, তা জানতে প্রতিদিন চোখ রাখতেন ‘খান তালাত মাহমুদ রাফি’র ফেসবুক পেজে। সেখান থেকেই সংগ্রহ করতেন আন্দোলনের দিকনির্দেশনা। ১৮ই জুলাই সকালে শাহ আমানত সেতুর সংযোগস্থলে সংঘর্ষ হয় ছাত্র-জনতা ও পুলিশ-ছাত্রলীগের মধ্যে। সেখান থেকে ধাওয়া খেয়ে শাহীনরা সরে আসেন বহদ্দারহাটে। এখানে জড়ো হয় নতুন করে মানুষ। কিন্তু প্রতিপক্ষও প্রস্তুত ছিল সশস্ত্র, নিষ্ঠুর। একপর্যায়ে গর্জে ওঠে গুলি। মুহূর্তেই রক্তে রাঙানো হয় মাটি।

মোহাম্মদ শাহীন মানবজমিনকে বলেন, আমার পেটে গুলি লাগে। গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে। কিন্তু হাসপাতালেও যেতে পারিনি। কারণ জানতাম, চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাতা ছিল হাসিনার পেটোয়াবাহিনীর ফাঁদ। আমাকে গ্রেপ্তার করতেই ওরা ওত পেতে বসেছিল। তিনি জানান, বায়েজীদের একটি বেসরকারি হাসপাতালে গোপনে অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু সেখানেও বেশিক্ষণ থাকা গেল না। গুলি খাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই ফের পালিয়ে বেড়াতে হয়। লুকিয়ে লুকিয়ে সুস্থ হন। আগস্টের শুরুতেই আবার ফিরেও আসেন রাজপথে। এক নতুন প্রতিজ্ঞা নিয়ে। ৪ঠা আগস্ট, নিউমার্কেট মোড়ে আবারো দানবীয় আক্রমণ। পুলিশ-আওয়ামী লীগের গুলি এবার শাহীনের ভাই ফাহিমকে বিদ্ধ করে। তাকেও গোপনে নিয়ে যাওয়া হয় একই হাসপাতালে। ওই দুঃসময়ের কথা বলতে গিয়ে শাহীন বারবার ফিরে যান পরিবারের কথা, বিশেষত মায়ের কথা।

শাহীন বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন মা। তিনি কোনোদিন আমাদের ঠেকাননি। উল্টো প্রতিদিন ভোরে উঠে কেঁদে কেঁদে দোয়া পড়তেন-আল্লাহ যেন আমাদের হেফাজত করেন। তার সাহস না থাকলে এতদূর আসা যেতো না। শাহীন জানতেন এই রক্তাক্ত পথই একদিন পৌঁছে দেবে বিজয়ে। তার চোখে ছিল স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি, হৃদয়ে ছিল সাহসের ধ্বনি। গুলির ক্ষত, জেলখানার ভয় কিংবা প্রাণ হারানোর আশঙ্কা- কিছুই তাই তাকে দমাতে পারেনি। আর সেই কারণেই, ৫ই আগস্ট দুপুর গড়াতেই যখন রাজপথে বিজয়ের স্লোগান ওঠে, কাঁদেন শাহীন। কিন্তু এবার সে কান্না হয়ে উঠলো-আনন্দাশ্রু।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status