ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে

স্টাফ রিপোর্টার
২৪ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার
mzamin

গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মতো জঘন্য অপরাধ কোনোভাবেই বিচার ও শাস্তিহীন থাকা উচিত নয়- মন্তব্য করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মিয়ানমারকে এই অপরাধের জন্য দায়ী করা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আস্থা তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। গতকাল কাতারের দোহায় আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের দ্বিতীয়দিনে ‘বাধ্যতামূলকভাবে বাস্তুচ্যুত জনগণের সামাজিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ-রোহিঙ্গা ইস্যু’- শীর্ষক এক উচ্চপর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে এ কথা বলেন তিনি। প্রফেসর ইউনূস বলেন, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে), আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এবং মিয়ানমারের জন্য গঠিত স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়া (আইআইএমএম)-এর আওতায় রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত নৃশংসতার বিচার ও জবাবদিহিতার চলমান উদ্যোগগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, জাতিসংঘ ও রোম সংবিধির সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ কোনোভাবেই শাস্তির বাইরে থাকা উচিত নয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মিয়ানমার বা এর কর্মকর্তাদের ওপর এই অপরাধগুলোর দায় চাপানো রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসনের জন্য আত্মবিশ্বাস তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ এই তিনটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বিচার প্রক্রিয়াকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করছে। আইসিজে-তে গাম্বিয়া ২৩শে অক্টোবর ২০২০ তারিখে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য প্রমাণসহ তার অভিযোগপত্র (মেমোরিয়াল) জমা দেয় এবং মিয়ানমার তার পাল্টা জবাব (কাউন্টার-মেমোরিয়াল) জমা দেয় ২৪শে অক্টোবর-২০২৩ এ।

 ২৩শে মে ২০২৪-এ গাম্বিয়া তাদের উত্তর জমা দেয় এবং মিয়ানমার তার পাল্টা উত্তর (রিজয়ান্ডার) জমা দেয় ৩০শে ডিসেম্বর ২০২৪-এ। প্রফেসর ইউনূস বলেন, এই মামলাটি ২০২৫ সালের শুরুর দিকে মূল (মেরিট) পর্বে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আইন সংস্থা ফোলে হোয়াগ জানিয়েছে, তিনটি ধাপ (অস্থায়ী, আপত্তি ও মূল) সফলভাবে সম্পন্ন হলে, তারা মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যার শিকারদের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবিতে আইসিজেতে আবেদন করবে। প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, গাম্বিয়া সরকার ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলো থেকে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহে একযোগে কাজ করছে। এ পর্যন্ত ওআইসি ২.৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের অবদান সবচেয়ে বেশি- ৭ লাখ ডলার। ড. ইউনূস বলেন, আইসিজেতে চলমান বিচার প্রক্রিয়ার ব্যয় নির্বাহে যে তীব্র বাজেট ঘাটতি দেখা দিয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে ওআইসি’র শক্তিশালী সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে কাতার ‘রোহিঙ্গা ফান্ড’-এ আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য ওআইসিকে অনুরোধ করতে পারে, যা মামলার খরচ মেটাতে এবং এ কাজে গতি বজায় রাখতে সহায়ক হবে। এ সময় রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন শুরু করার জন্য ওআইসিকে সক্রিয় করতে কাতারকে জোরালো ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন শুরু করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য কাতার তাদের কূটনৈতিক প্রভাব কাজে লাগাতে পারে। 

আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে, কাতার জোরালোভাবে তাদের সংহতি প্রকাশ করে এই সংকট সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া ওআইসি দেশগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তহবিল সংগ্রহ জোরদার ও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে মত প্রকাশের জন্য আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তিনি মানবতা, স্থিতিশীলতা ও ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করতে বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বলেন, আসুন আমরা নিশ্চিত করি, আজকের আলোচনা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে একটি অর্থবহ অংশীদারিত্বের সূচনা করে যা রোহিঙ্গা সংকটকে আমাদের যৌথ মানবিক অগ্রাধিকারগুলোর শীর্ষে রাখে এবং একটি স্থায়ী সমাধানের দিকে একযোগে কাজ করে। ড. ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে এবং রোহিঙ্গাদের হতাশ করে তুলছে। ক্যাম্পগুলোতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধি এবং অবৈধ অভিবাসনের চেষ্টা তাদের হতাশার স্পষ্ট চিহ্ন। এই সমস্যা যদি আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে এটি পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং উন্নয়নমূলক উদ্যোগগুলোও হুমকির মুখে পড়তে পারে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, দুর্ভাগ্যবশত, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উদ্ভূত নানা সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা সংকট থেকে সরে যাচ্ছে।

 তিনি আরও বলেন, ২০২৫ সালের ১৯শে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের দাখিলকৃত ৮ লাখ ২৯ হাজার ৩৬ জনের তালিকার মধ্যে মিয়ানমার সরকার ২ লাখ ৩৯ হাজার ৫৬ জনকে যাচাই করেছে এবং এর মধ্যে ১ লাখ ৭৬ হাজার ১৯৮ জনকে ‘মিয়ানমারে বসবাসকারী ব্যক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ টেকসই প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা জানান, বাংলাদেশ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ‘রোহিঙ্গা মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন’ আয়োজন করবে। এই সম্মেলনে কাতারের উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ। তিনি কাতার ফাউন্ডেশনকে এই বৈঠকের আয়োজন এবং নীতিগত বিবৃতির বাইরে গিয়ে বাস্তবসম্মত সমাধান, জবাবদিহিতা ও সংহতির বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৩ লাখ বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক (রোহিঙ্গা) আশ্রয় নিয়েছে, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ৩২ হাজার নবজাতক যুক্ত হচ্ছে। প্রফেসর ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ কেবল মানবিক বিবেচনায় এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ মনে করে, টেকসই প্রত্যাবাসনই হলো বর্তমান সংকটের একমাত্র সমাধান। ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রফেসর ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে), আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এবং মিয়ানমারের জন্য গঠিত স্বাধীন তদন্ত সংস্থার (আইআইএমএম) চলমান উদ্যোগগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, জাতিসংঘ এবং রোম সংবিধির সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মতো অপরাধের কোনোভাবেই শাস্তি এড়ানো উচিত নয়।

 রোহিঙ্গাদের আস্থা ফেরাতে এবং রাখাইন রাজ্যে তাদের প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমার ও এর কর্মকর্তাদের অপরাধের জন্য দায়ী করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন তিনি। আইসিজে’তে দায়ের করা মামলাটি চলতি বছরের প্রথমার্ধে মেরিট পর্বে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আইনি ফার্ম ফোলি হোয়াগ জানিয়েছে, প্রাথমিক, আপত্তি ও মূলপর্ব শেষ হওয়ার পর তারা আইসিজে’তে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যার শিকারদের ক্ষতিপূরণের আবেদন করবে। গাম্বিয়া সরকার ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ওআইসি ২৭ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে, যেখানে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে, যার পরিমাণ সাত লাখ ডলার। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ বর্তমান সংকটের একমাত্র সমাধান হিসেবে টেকসই প্রত্যাবাসনকেই বিবেচনা করে। এই গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status