শেষের পাতা
মুরাদনগরে ৩০ বছর ধরে রুবীর শাসন
আবুল কালাম আজাদ, মুরাদনগর (কুমিল্লা) থেকে
৫ জুলাই ২০২৫, শনিবারমুরাদনগরে গণপিটুনিতে একই পরিবারের দুই নারীসহ তিনজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। শুক্রবার রাতে মামলা করা হবে বলে জানা গেছে। এদিন বিকাল পর্যন্ত তিনজনের মরদেহ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে কেউ আনতে যায়নি। পরে সন্ধ্যায় মরদেহগুলো নিয়ে যান নিহতের আত্মীয় মনির হোসেন। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পাহারায় রাতে কড়ইবাড়ি গ্রামের পশ্চিমপাড়া কবরস্থানে দাফন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত লাশ কাফন-দাফনের জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
এর আগে, বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার আকুবপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের কড়ইবাড়ি গ্রামে গণপিটুনিতে তিনজনকে হত্যা করা হয়। এ সময় গুরুতর আহত হয়েছেন একজন। নিহতরা হলেন- জুয়েল মিয়ার স্ত্রী রোকসানা আক্তার রুবী (৫৮), তার ছেলে মো. রাসেল (৩৫) ও মেয়ে জোনাকি আক্তার (৩২)। আরেক মেয়ে রুমা আক্তার (২৫) আশঙ্কাজনক অবস্থায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (কুমেক) চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে। এ ঘটনায় কড়ইবাড়ি গ্রাম ও বাজারে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নিহতদের বাড়ি ও ওই এলাকা মানুষ শূন্য হয়ে পড়েছে। নিহতের বাড়িতে ঝুলছে তালা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
রুবীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ: কয়েকজন এলাকাবাসী বলেন, রোকসানা আক্তার রুবী। দেখতে শ্যামলা হলেও সুন্দরী, কোকরানো চুল, খুবই অহংকারী, উগ্রমেজাজি। ১৯৯৯ সালে বাড়িতে ছিল তার চৌচালা টিনের ঘর। ঘরের সামনে ছিল বিশাল খালি বাড়ি। এখন তার একটি ৭ তলা ভবন, একটি করে ৩ তলা ও দোতালা ভবন এবং দু’টি টিনের ঘর রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে একটি মার্কেট। বাড়ির সামনে ডিসি খালের ওপর পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গায় আরসিসি পিলারের ওপর রয়েছে কয়েকটি অবৈধ দোকানঘর। যা দখল করে রেখেছে রুবী ও তার পরিবার। ঘটনার পর থেকে সব দোকানে তালা ঝুলছে। স্থানীয়রা বলেন, ক্ষমতার দাপট দেখাতে রুবী বিয়ে করেন চাচাতো ভাই সাবেক সেনাসদস্য কবির হোসেনকে। কবির তালাক দিলে রুবী কম বয়সী পীর কাশিমপুর গ্রামের মাদক কারবারি জুয়েলকে বিয়ে করেন। তালাকের পর কবির চট্টগ্রামে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তার ঘরে রয়েছে রুবীর ৩ মেয়ে ও এক ছেলে। আর জুয়েলের ঘরে একটি ছেলে রয়েছে। কবিরের বড় মেয়ে নরসিংদীতে বিয়ে করেছেন। সেখানেই সংসার করছেন তিনি। আর জুয়েলের একমাত্র সন্তানকে রুবী ভারতে বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জুয়েলকে বিয়ে করার পর থেকে রুবী মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। হয়ে যান মাদক কারবারের বড় ব্যবসায়ী। গত ৩০ বছর ধরে তার ছিল একক অধিপত্য। তার বিরুদ্ধে কিছু বললেই হামলা, মামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হতো। রুবীর নাম মুখে নিতেই ভয় পেতো মানুষ। পীর কাশিমপুর, কড়ইবাড়ি, হীরাকাশি, হায়দরাবাদ গ্রামের মানুষের বিরুদ্ধে ৮২টি মামলা করেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ২৮টি ও মনিরের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৭টি। দেহ ব্যবসা, নারী শিশু নির্যাতন, ফেন্সিডিল, গাঁজা, ইয়াবা ব্যবসা ছিল তার মূল কর্ম। কুমিল্লা ও ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন থানায় এসব মামলা রয়েছে। সাবেক মুরাদনগর থানা ওসি ও মুরাদনগর-বি সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলাও করেছিলেন রুবী। এ ছাড়াও বিভিন্ন তুচ্ছ ঘটনায় মামলা-হামলা শিকার হয়েছেন- আকুবপুর ইউনিয়ন পরিষদ সাবেক চেয়ারম্যান আবু বক্কর, মেটাংঘর গ্রামের ইউপি সদস্য দুলাল মিয়া, কড়ইবাড়ি গ্রামের নাছির উদ্দীন সরকার, হিরাকাশীর গ্রামের জামাল উদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী সদস্য শাহজাহান, শিক্ষক রুহুল আমিনের পিতা।
স্থানীয় এক পান দোকানি বলেন, একবার রুবীর জন্য তার মেয়ে পান চেয়েছিল। আমি না বলাতে রুবী এসে আমাকে রাস্তায় ফেলে চুল ধরে মারধর করে। বুকের ওপর উঠে পা দিয়ে চাপ দেয়। অনেকেই ঘটনা দেখছিল কিন্তু সবাই চুপ ছিল। রড সিমেন্ট ব্যবসায়ী এরশাদ মিয়া বলেন, রুবী আমার দোকান থেকে ভবন নির্মাণের সময় রড সিমেন্ট বালু বাকিতে নিয়েছিল। আমি টাকা চাইতে গেলে আমাকে মারধর করে। আমি মুখ বুঝে সহ্য করেছি। ডেকোরেশন ব্যবসায়ী বাছির মিয়া বলেন, আমি রুবীর কাছে পাওনা টাকা চাইলে আমাকে মারধর করে। মামলা হামলা ভাঙচুর লুটপাটের ভয় দেখায়।
ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহ বলেন, আমাকে নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় মিথ্যা খবর প্রকাশিত হয়েছে। আমি এসবের সঙ্গে জড়িত নই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রুবীকে বিভিন্ন সময় ইয়াবা, গাঁজাসহ ধরেছে। পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী ও যৌথবাহিনীর অফিসাররা তাকে ধরে নিয়ে যায়। ক’দিন জেলহাজতে থাকার পর বের হয়ে আবার ওই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এতে কেউ প্রতিবাদ করলে নেমে আসতো নির্যাতন, হামলা-মামলা। তার কাছে কেউ নিরাপদ ছিল না। বাঙ্গরা বাজার থানার ওসি মাহফুজুর রহমান জানান, এ ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। পারিবারের লোকজনকে ঘটনার পর থেকে খোঁজা হচ্ছে। কেউ না আসলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
পাঠকের মতামত
When existing law does not work properly then this may be a way to get justice.