ঢাকা, ৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার, ২১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৮ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

শেষের পাতা

ছিনতাইয়ের ঘটনায় বেশির ভাগই অভিযোগ, নেয়া হয় না জিডিও

সুদীপ অধিকারী
৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার
mzamin

রাজধানীতে একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মানুষের মোবাইল ফোন, টাকা থেকে শুরু করে ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে সর্বস্ব। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানা পুলিশের দ্বারস্থ হলে তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেয়া হয় শুধু লিখিত অভিযোগ। যার হদিস থানা পুলিশের কাছেও থাকে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জিডি নেয়া হলেও মামলা দায়েরে নারাজ পুলিশ। 

গত ২৫শে জুন রাত পৌনে ১১টায় আদাবরের নবোদয় হাউজিং কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে দিয়ে রিকশাযোগে বাসায় ফেরার সময় ইব্রাহীম নামে এক যুবক ও তার বন্ধুকে ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে মারধর করে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। তবে সেই ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে অসাবধানতাবশত নিজের অজান্তে মোবাইল হারিয়ে গেছে মর্মে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রেকর্ড করে আদাবর থানা পুলিশ। ভুক্তভোগী ইব্রাহীম বলেন, বুধবার রাতে দোকানের কাজ শেষ করে আমি ও আমার আরেক বন্ধু নাহিদ বাসায় ফিরছিলাম। নবোদয় হাউজিং খাল পাড়ে বড় মসজিদের সামনে যাওয়া মাত্রই ৫-৬ জনের একটি দল রামদা, চাপাতি ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে আমাদের রিকশা ঘেরাও করে। ওই সময় তারা আমাদের ধারালো অস্ত্রের উল্টো পাশ দিয়ে মারধর করে আমাদের পকেটে থাকা আইফোনসহ তিনটি দামি মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ নিয়ে যায়। সবকিছু হারিয়ে আমরা গুরুতর অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকলে আশপাশের লোকজন আমাদের উদ্ধার করে। পরে আমরা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ কল করে পুলিশের সহায়তা চাই। ওই সময় আদাবর থানা থেকে এসআই মনিরুজ্জামান নামে একজন এসে আশপাশের লোকজনসহ আমাদের সঙ্গে কথা বলে আদাবর থানায় যেতে বলেন। আমরা রাতেই থানায় যাই। ডিউটি অফিসার ঘটনার সবকিছু শুনে পরদিন সকালে আবারো থানায় যেতে বলেন। পরদিন থানায় যাওয়ার পর থানা থেকে আমাদের মোবাইল হারিয়ে গেছে- মর্মে অনলাইনে একটা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে নিয়ে যেতে বলে। আমরা তাদের কথামতো জিডি করে থানায় নিয়ে গেলে তারা দু’জন অফিসারের নামে মোবাইল হারানোর জিডি এন্ট্রি করে।? বলে মোবাইল উদ্ধার হলে আপনাদের জানানো হবে। কিন্তু আমাদের যে মারধর করে সব ছিনিয়ে নেয়া হলো তার কোনো বিচার পেলাম না। 

এদিকে গত ৫ই জুন মেয়ে শিশুকে নিয়ে ধানমণ্ডি থেকে রিকশায় নিউমার্কেট যাওয়ার সময় সায়েন্সল্যাব এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন জান্নাতুল ফেরদৌস নামে এক গৃহিণী। সেদিন সকলের সামনে তার গলা থেকে ৮ আনা ওজনের স্বর্ণের চেইন ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে ছোট্ট মেয়ে থাকায় সেদিন টুঁ-শব্দ পর্যন্ত করতে পারেননি জান্নাতুল। পরে তিনি ধানমণ্ডি থানার দ্বারস্থ হন। সেখান থেকে সাদা কাগজে শুধুমাত্র একটি লিখিত অভিযোগ নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। পরে লোক মারফত বিষয়টি ওসিকে জানালে তিনি এসআই আকিব নূরকে ঘটনাস্থলে পাঠান। এসআই যাচাইবাছাই শেষে বলেন- সিটি কলেজের সামনের রাস্তার এই পাশ আমাদের থানা এলাকায়। আর সায়েন্সল্যাবের পাশ নিউমার্কেট থানা এলাকা। ছিনতাইটি নিউমার্কেট থানা এলাকায় হয়েছে। আমরা কিছুই করতে পারবো না। পরে নিরুপায় হয়ে রাতেই বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে আবার নিউমার্কেট থানায় যান জান্নাতুল। সেখানেও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর তার কাছ থেকে সাদা কাগজে একটি লিখিত অভিযোগ জমা নেয়া হয়। অনেকবার অনুরোধ করলেও মামলা তো দূরের কথা জিডি পর্যন্ত নেয়নি নিউমার্কেট থানা পুলিশ। এই দিন এই এলাকা থেকে ছিনতাইয়ের শিকার হন নাসরিন আক্তার নামে আরও এক নারী। পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে তার গলা থেকে স্বর্ণের চেইন ও কানের দুল নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। তিনিও থানায় গেলে বসিয়ে রেখে সাদা কাগজে নেয়া হয় অভিযোগ। 

জান্নাতুল ফেরদৌস মানবজমিন’কে বলেন, আমি কিছু জিনিস কিনতে ধানমণ্ডি ১৫ নম্বর থেকে নিউমার্কেট যাচ্ছিলাম। সঙ্গে আমার মেয়ে ছিল। আমার রিকশাটি যখন সায়েন্সল্যাব ফুটওভারের কাছাকাছি জ্যামের মধ্যে ছিল। তখন হঠাৎ একটি ছেলে হাতে ছুরি নিয়ে আমার গলার চেইন টান দেয়। আমি তখন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এত লোকের মধ্যে সে স্বদর্পে ছিনতাই করছে কেউ কিছু বলছে না। সঙ্গে আমার ছোট্ট মেয়ে থাকায় আমি তখন চিৎকার পর্যন্ত করতে পারিনি। শুধু চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছিল। আমি পাশেই ধানমণ্ডি থানায় যাই। সেখানে গিয়ে ডিউটি অফিসারকে বিষয়টি জানিয়ে একটা মামলা করতে বলি। তবে তিনি আমাকে বলেন-এসব ঘটনায় মামলা হয় না। আমি তখন তাকে বলি- তাহলে জিডি করি। তখন তিনি আমাকে বলেন- আপনি একটা কাগজে আপনার সমস্যাগুলো লিখে দেন। আমি তখন ধানমণ্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগ দায়েরের জন্য একটি আবেদন করি। আবেদনটির দুই কপি প্রিন্ট করে আমি তাদের বলি- জিডি নম্বর লিখে আমাকে একটি কাগজ রিসিফ (স্বাক্ষর) করে দেন। কিন্তু তারা তেমন কিছুই করেননি। উল্টো আমাকে বলেন- এই ঘটনায় কোনো জিডি হবে না। আমরা অভিযোগটি জমা নিয়েছি। খোঁজখবর করে আপনাকে জানানো হবে। জান্নাতুল বলেন, পুলিশ আমাকে ন্যূনতম সহযোগিতা করেনি। আমি কান্না করতে করতে বাসায় ফিরি। পরে আমার এক প্রতিবেশী (সংবাদকর্মী) থানায় গিয়ে দেখেন অভিযোগপত্রটি একপাশে চাপা দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। ডিউটি অফিসার খুঁজে পাচ্ছেন না। পরে সেই আবেদনটি এসআই আকিব নূরকে পাঠান। তবে এসআইয়ের ফোনে ইন্টারনেট না থাকায় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও তিনি তা দেখেননি। পরে ওসিকে জানালে, ওসির নির্দেশে ঘটনাস্থলে যান এসআই। গিয়ে বলেন, ঘটনাস্থল নিউমার্কেট থানা এলাকায়। আপনারা সেখানে যান। পরে আমি আবার নিউমার্কেট থানায় যাই। সেখানকার ওসি তার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হাফিজকে বলে দেন ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু তিনিও সাদা কাগজে লেখা অভিযোগ জমা নিয়ে ব্যবস্থা নিবো বলে আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দেন। আজ পর্যন্ত আমি ওই ঘটনার কোনো প্রতিকার পাইনি। জান্নাতুল বলেন, আমি যখন থানায় ছিলাম তখন একই সময়ে আরেকটি মহিলার সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটে। তারা ছিনতাইকারীদের মধ্য থেকে একজনকে ধরে থানায় নিয়ে আসে। তাদেরও কোনো জিডি নেয়া হয়নি। ফোন হারিয়ে যাওয়ার একটি অভিযোগ নেয়া হয়। আর ছিনতাইকারীকে অন্য একটি চুরি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। 

সম্প্রতি মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া সাদনান নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, আমার বাসা মোহাম্মদপুর ৪০ ফিট এলাকায়। কিছুদিন আগে আমি ও দুই বন্ধু মিলে রাতের বেলা খাবার খেতে বের হই। পথে ৫/৭ জনের একটি ছিনতাইকারী চক্র আমাদের গলায় ধারালো ছুরি ধরে সব নিয়ে যায়। বিষয়টি আমি আমার স্বজনদের জানালে তারা আমাকে রাতের বেলায় বাইরে বের হতে নিষেধ করে। আমি থানায় অভিযোগ দেয়ার কথা বললে- তারা জানায়, তুই একা ঢাকায় থাকিস। থানায় অভিযোগ করলে আবার যদি কোনো অসুবিধা হয়? নিষেধের পরও আমি পরদিন সকালে মোহাম্মদপুর থানায় যাই। সেখানে গিয়ে বিষয়টি ডিউটি অফিসারকে জানালে তিনি আমাদের ওসি বরাবর মোবাইল চুরির একটি লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন। পরে অভিযোগটি নিয়ে আবারো তার কাছে গেলে তিনি ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়ে আমাদেরকে পাঠিয়ে দেন। এরপর অনেকবার থানায় যোগাযোগ করেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো প্রতিকার পাইনি।  

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান মানবজমিন’কে বলেন,  আমাদের ডিএমপি কমিশনার থেকে শুরু করে সকল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশ- থানায় আগতদের যেন যথাযথ সেবা দেয়া হয়। মামলা নেয়া হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে কিছু কিছু পুলিশ সদস্য থানার র‌্যাঙ্কিং কমে যাবে বলে অনেক সময় মামলা-জিডি নিতে চান না। ভুক্তভোগীকে ভুল বুঝিয়ে মামলা করা থেকে দূরে রাখে। এতে তারা নিজেদের অজান্তেই পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন। আবার অনেক সময় পুলিশের পেছনে ও আদালতে সময়ক্ষেপণ হবে ভেবে ভুক্তভোগী নিজেই মামলা না করে হারিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেন। তাই সকলের প্রতি অনুরোধ আপনারা আপনাদের সমস্যা নিয়ে থানায় আসেন। আপনাদের সমস্যা সমাধানে অবশ্যই মামলা নেয়া হবে। আর যেই থানার পুলিশ সদস্যরা মামলা নিতে না চাইবে বা অনীহা প্রকাশ করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

 

পাঠকের মতামত

আমি একজন আইনজীবী। আমার ছেলের নতুন সাইকেল খেলার মাঠ থেকে তালাসহ অটোতে তুলে নিয়ে গেছে। ক্লাবের সিসি ক্যামেরার সব স্পষ্ট। আমি সিসি ক্যামেরার ভিডিও সহ খিলগাঁও খানায় গেলে সাদা কাগজে একটা অভিযোগ লিখে আমাকে চলে যেতে বলে। আর কোনদিন পুলিশ খোঁজই নেয়নি। এই হলো বাংলাদেশের থানার সেবা। মনে করেছিলাম পট পরিবর্তনের পর পুলিশের সেবার মানে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু এদের মগজে যা ঢুকেছে তার আর কোনদিন বের হবার নয়।

Advocate GMA Zafar
৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার, ১১:২৫ পূর্বাহ্ন

Police jodi "Ovijog" naa Naay(naan), Tahoilea, Police er 'Chakuri' karaar ki darker?

no need
৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার, ১১:২৩ পূর্বাহ্ন

Bangladesh-e Police ki "Oloos" ?

no need
৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার, ১১:২০ পূর্বাহ্ন

এটার একটা পরিসংখ্যান তৈরি হবে আর লিখা হবে গত ৫০ বছরে দেশে কোন ছিনতাই হয়নি - কেউ চাপাতি নিয়ে মানুষের জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। মনের ভুলে মানুষ জিনিসপত্র এমনকি জান পর্যন্ত হারিয়ে ফেলতে পারে

BAL
৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার, ১১:১৯ পূর্বাহ্ন

নিরাপত্তা কার কাছে চাইতে হবে ?

aminul
৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার, ১১:১৩ পূর্বাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status