ঢাকা, ৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার, ২১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৮ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

শেষের পাতা

ফাঁসির দণ্ড পাওয়া ১১৬৬ মামলা

হাইকোর্টের অনুমোদনের অপেক্ষায়

রাশিম মোল্লা
৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার
mzamin

সবেমাত্র কলেজ থেকে বাসায় ফিরেছেন মনির। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।  মেসে থেকে মানিকগঞ্জের খান বাহাদুর আওলাদ হোসেন খান কলেজের একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করতেন। একদিন চাকরির লোভ দেখিয়ে প্রতিবেশী চাচা বাদশা মিয়া তাকে নিয়ে যায় নির্জন এক স্থানে। এরপর সাভারের বংশী নদীতে ইঞ্জিনচালিত একটি ট্রলারে তোলা হয় তাকে। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ মনিরকে মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। মনিরের আর্ত-চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কিন্তু মন গলেনি অপহরণ চক্রের মূলহোতা বাদশা মিয়া গংদের। উল্টো মনিরের চিৎকার মোবাইলে রেকর্ড করতে আরও মারধর করতে থাকে। মুক্তি পেতে মায়ের কাছে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতেও বলা হয়। মনির তাদের কথামতো মাকে চিৎকার করে টাকাও দিতে বলেন। তারপরেও বাঁচতে পারেনি মনির। আচমকা ট্রলার থেকে বংশী নদীতে ফেলে দিয়ে মনিরকে হত্যা করা হয়। 

২০১৫ সালে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মানিকগঞ্জের খানবাহাদুর আওলাদ হোসেন খান কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র মনির হোসেন। ২০১৮ সালে আলোচিত এই মামলায় মানিকগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালত শিবালয় উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামের অপহরণ চক্রের মূলহোতা বাদশাসহ চারজনের বিরুদ্ধে ফাঁসির দণ্ড ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন- সিংগাইর উপজেলার ভাটিরচর গ্রামের লাল মিয়া, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার কোশলা গ্রামের আজগর চৌধুরী ও দিনাজপুরের আওলিয়াপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন। কিন্তু হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শুনানি না হওয়ায় এখনো কার্যকর হয়নি ফাঁসির দণ্ড। দণ্ড তো কার্যকর হয়ইনি উল্টো ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে অন্য একটি হত্যা মামলায় দুর্ধর্ষ আসামি বাদশা মিয়াকে হাজির করা হলে পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে যান তিনি। এখনো ওই আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পালিয়ে যাওয়া আসামি এখন ভিকটিমের মা মালেকা বেগম ও পিতা পরশ আলীকে ফোন করে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও হত্যার হুমকি দিয়েছেন।  শুধু তাদেরকেই হুমকি দেয়নি, হুমকি দিয়েছে তার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেয়া কয়েকজন সাক্ষীকেও। এ ঘটনায় জিডি হলেও কোনো কাজ হয়নি। গত সোমবার হাইকোর্টে মামলার খোঁজ নিতে আসা  মালেকা বেগম ও পরশ আলী এ অভিযোগ করেন। একমাত্র  ছেলে সন্তানকে হারিয়ে তারা এবার পরিবারের অন্য সদস্য হত্যার শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। ভালো কোনো খবর না পেয়ে হাইকোর্ট থেকে হতাশ হয়েই ফিরেন তারা।  প্রায় প্রতিদিনই সুপ্রিম কোর্টে হত্যা মামলার খবর নিতে আসেন সন্তানহারা ও বাবাহারা স্বজনরা। চলতি বছরের ৩১শে মার্চ পর্যন্ত হাইকোর্টের অনুমোদনের অপেক্ষায় ফাঁসির দণ্ড পাওয়া ১১৬৬ মামলা বিচারাধীন।

ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেথ রেফারেন্স মামলার নিষ্পত্তির সময়সীমা নিয়ে ফৌজদারি আইন বা উচ্চ আদালতের রুলসে (বিধি) কিছু উল্লেখ করা নেই। অন্যদিকে এ ধরনের মামলার নিষ্পত্তির আইনি প্রক্রিয়া যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমনি খরচসাপেক্ষও। আসামিপক্ষের অনেকের এ সামর্থ্য থাকে না। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে ডেথ রোফারেন্স বেঞ্চ বাড়ানোর দাবি জানান সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড শাখার সদস্য সচিব এ এম জামিউল হক ফয়সাল। তিনি মানবজমিনকে বলেন, বর্তমানে ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য ৪/৫টি বেঞ্চ রয়েছে। দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য আরও কয়েকটি বেঞ্চ বাড়ানো জরুবি বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের  মুখপাত্র ও স্পেশাল অফিসার  মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন মানবজমিনকে বলেন, স্পর্শকাতর ও আলোচিত মামলাগুলো শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি অগ্রাধিকারভিত্তিতে বেঞ্চ গঠন করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল জাব্বার ভূঁইয়া মানবজমিনকে বলেন, ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তি করতে রাষ্ট্রপক্ষ খুবই আন্তরিক। প্রতিটি মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ যৌক্তিক সাবমিশন তুলে ধরেন। আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। 

হাইকোর্টে আলোচিত আরও একটি মামলা বিচারাধীন। মামলার তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালের ২৭শে মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় তার মা শিরিনা আক্তার সোনাগাজী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করলে অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০১৯ সালের ২৪শে অক্টোবর নুসরাত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ। আলোচিত সে রায়ে মামলার প্রধান আসামি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। আলোচিত এই মামলটি বিচারিক আদালতে কয়েক মাসের মধ্যে রায় হলেও হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানির জন্য বিচারাধীন রয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত ১ হাজার ১৬৬টি ডেথরেফারেন্স বিচারাধীন। এ সময় মামলার প্রারম্ভিক সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৫৪টি, নতুন করে যুক্ত হয়েছে ২৫টি। মোট মামলার সংখ্যা হয় ১ হাজার ১৭৯টি। এর মধ্যে তিন মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৩টি মামলা। বেশ কয়েকজন ফৌজদারি আইনবিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পেপারবুক প্রস্তুত করা সাপেক্ষে পাঁচ বছরের আগে সাধারণত হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসে না । মামলার নিষ্পত্তিতে সময় লাগে পাঁচ থেকে ১৮ বছর। আপিল বিভাগে মামলার নিষ্পত্তি হতে দুই যুগ পেরিয়ে যাওয়ার নজিরও আছে। আইন ও বিধি অনুযায়ী বিচারিক আদালতে কারও মৃত্যুদণ্ড হলে কারাবিধি অনুযায়ী তাকে কারাগারের বিশেষ সেলে রাখা হয়, যা কনডেম সেল নামে পরিচিত। যাবজ্জীবন বা অন্য সাজা হলে রাখা হয় সাধারণ সেলে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী, হাইকোর্টের অনুমোদন ছাড়া ফাঁসির সাজা কার্যকর করা যায় না। এ জন্য দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির রায়সহ যাবতীয় নথি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠাতে হয়। এটিকে বলে ডেথ বা কোর্ট রেফারেন্স। পেপারবুক যাচাই সাপেক্ষে মামলাগুলো পর্যায়ক্রমে শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ওঠে। অন্যদিকে বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল ও জেল আপিলের সুযোগ পান। তবে সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের আপিলের সুযোগ নেই। হাইকোর্টে সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকলে আসামিরা আপিল বিভাগে আপিল ও জেল আপিল করতে পারেন। আপিল বিভাগে সর্বোচ্চ দণ্ড বহাল থাকলে শেষ সুযোগ হিসেবে দোষ স্বীকার করে প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারেন।  এ আবেদন নাকচ হলে কারাবিধি অনুযায়ী ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ।

 

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status