শেষের পাতা
ফেনীতে ত্রাণের অপেক্ষায় বানভাসিরা
ফেনী প্রতিনিধি
১১ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার
ফেনীতে টানা বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও সদর উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তবে সরকারি হিসেবে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ২০ হাজার বলে দাবি করেছেন জেলা প্রশাসন। আশ্রয় কেন্দ্রে বানভাসি মানুষের চাপ বাড়তে শুরু করেছে। বেশির ভাগ আশ্রয় কেন্দ্রে ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করেছে বন্যাদুর্গতরা। এদিকে বুধবার রাত থেকে মুহুরী নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় মুহুরী নদীর পানি ১০ দশমিক ৩৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর নতুন করে বেড়িবাঁধের আর কোথাও না ভাঙলেও ইতিপূর্বে ভাঙনকৃত ২০টি স্থান দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে করে নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। তৃতীয় দিনের মতো ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়ক ডুবে থাকায় ছোট-বড় সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে ফেনী জেলা সদরের সঙ্গে ফুলগাজী ও পরশুরামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
নতুন আক্রান্ত দুই উপজেলা, পানিবন্দি শতাধিক গ্রাম: বঙ্গোপসাগরের সৃষ্ট লঘুচাপ ও ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ২০টি ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলাবাসী পানিবন্দি হলেও রাত থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে ফুলগাজী উপজেলার ৬৭ গ্রাম, পরশুরাম উপজেলার ২৭টি গ্রাম, ছাগলাইয়া উপজেলার ১২টি গ্রাম, সদর উপজেলার পাঁচটি গ্রাম রয়েছে বলে জেলা প্রশাসন থেকে দাবি করলেও আক্রান্ত গ্রামের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। আক্রান্ত চার উপজেলার শতাধিকেরও বেশি গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
ফুলগাজীর দক্ষিণ শ্রীপুর গ্রামের অটোরিকশাচালক মোহাম্মদ জসিম বলেন, বুধবার বিকাল থেকে তার ঘরে পানি ঢুকে কোমর পর্যন্ত পানিবন্দি হয়ে পড়ে। তিনি তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি মাদ্রাসার আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন।
একই এলাকার রোকসানা আক্তার বলেন, ঘরে পানিবন্দি থাকায় সন্তানদের নিয়ে নিকটস্থ আশ্রয় কেন্দ্রে চলে আসেন। তবে তার আশ্রয় কেন্দ্রটিতে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কেউ কোনো খোঁজখবর নেয়নি। পার্শ্ববর্তী দোকান থেকে শুকনো খাবার কিনে বাচ্চাদের খাওয়ানো হয়েছে।
বুধবার রাত থেকে নতুন করে প্লাবন দেখা দিয়েছে ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলে। ছাগলনাইয়া উপজেলার এলনাপাথর, মাটিয়াগোধা, দক্ষিণ সতর নদীরকূল, দক্ষিণ সতর, উত্তর পানুয়া, কাশীপুর, নিচিন্তা, লক্ষ্মীপুরসহ বেশ কিছু স্থান পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুবল চাকমা জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তার উপজেলায় ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৪৯০ জন আশ্রয় নিয়েছেন। বিভিন্ন গ্রাম থেকে আক্রান্তরা আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটে আসছেন। উপজেলা প্রশাসন থেকে সার্বক্ষণিক বন্যার চিত্র তদারকি করা হচ্ছে।
ফেনী সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়নের ফাজিলপুর ও মোটবি ইউনিয়নের ইজ্জতপুর, বাঘাইয়া কচুয়া এলাকার কিছু গ্রাম পানিবন্দি হওয়ায় শতাধিক পরিবার নিকটস্থ আশ্রয় কেন্দ্রে উঠতে শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানা নাসরিন কান্তা।
উদ্ধার তৎপরতায় সেনাবাহিনী: ফুলগাজীর পানিবন্দি বিভিন্ন গ্রামে উদ্ধার তৎপরতায় নেমেছে সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে সেনাবাহিনীর ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের দুরন্ত ১৫ সাপোর্ট ব্যাটালিয়ানের ১৩৯ সদস্যের একটি কোম্পানি উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার কাজে নেমেছেন। নিজস্ব ট্রাকে করে শুকনো খাবারের সহস্রাধিক প্যাকেট বিতরণ করার জন্য ফুলগাজীতে আনা হয়েছে। সেনাবাহিনীর কোম্পানির দায়িত্বে থাকা মেজর মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান রাশেদ বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার কাজ শুরু করা হয়েছে। সেনাবাহিনী নিজস্ব ১০টি স্পিডবোটের মাধ্যমে দুর্গম এলাকায় পানিবন্দিদের উদ্ধারে কাজ শুরু করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করা প্রয়োজন হবে এবং ত্রাণ বিতরণের প্রয়োজন হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সেনাবাহিনী পানিবন্দিদের পাশে রয়েছে।
বন্যার্তদের পাশে বিজিবি: পরশুরাম ও ফুলগাজীতে বন্যায় পানিবন্দি মানুষের মাঝে রান্না করা খাবার প্রদান করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ফুলগাজীর বিভিন্ন স্থানে খাবার বিতরণ করে চলেছে বাহিনীর সদস্যরা। বুধবার রাতে উপজেলার মধ্যম ধনীকুণ্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে বাহিনীটির পক্ষে খাবার বিতরণ করা হয়। বিজিবি কুমিল্লা অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল রেজাউল কবির আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া দুই শতাধিক মানুষের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করেন। খাবার বিতরণের সময় বিজিবি-৪ ফেনী ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন, সহকারী পরিচালক নজরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ: ফুলগাজী উপজেলার মুন্সিরহাট ইউনিয়নের একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করা রিনা আক্তার বলেন, বুধবার রাত থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করলেও ত্রাণ সহায়তা নিয়ে তাদের পাশে কেউ এসে দাঁড়ায়নি। একই ইউনিয়নের শ্রীপুর দারুল উলূম মাদ্রাসা কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন শরিফা আক্তার। বৃহস্পতিবার বেলা এগারোটা পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণ না পেয়ে শুকনো খাবার খেয়ে কোনোরকম আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। তবে ভিন্নচিত্র দেখা গেছে ফুলগাজী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে। গত তিনদিন সেখানে শুকনো খাবারের পাশাপাশি রান্না করা খাবার বিতরণ করছে উপজেলা প্রশাসন।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম বলেন, বুধবার বিকাল থেকে ভারী বর্ষণ বন্ধ থাকায় ও উজান থেকে ঢলের পানি কমতে শুরু করায় নদীতে পানি বিপদসীমার নিচে নেমে গেছে। মুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ২ দশমিক ২ মিটার বা ২২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ নদীতে পানি বিপদসীমার ১২ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।