শেষের পাতা
সিপিডি’র তথ্য
২০২৩ সালে কর ফাঁকি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২২ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবারবেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মনে করে, উচ্চ করের হার, দুর্বল প্রয়োগ, জটিল আইনি কাঠামো এবং কর ব্যবস্থার মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে দেশে কর ফাঁকির হার বেড়েছে। সিপিডি’র গবেষণা বলছে, কর ফাঁকির কারণে ২০২৩ সালে (২০২২-২৩ অর্থবছর) আনুমানিক ২ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে বাংলাদেশ, যা আগের এক দশকের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ হারিয়েছে করপোরেট কর ফাঁকির কারণে। এই কর ফাঁকির পরিমাণ ২০১১ সালের পর থেকে বেড়েছে। এভাবে গত ১১ বছরে দেশে কর ফাঁকির পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে বলে জানায় সিপিডি।
সোমবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে আয়োজিত ‘করপোরেট আয়কর সংস্কার ও কর ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানানো হয়। যৌথভাবে এর আয়োজন করে সিপিডি ও ক্রিশ্চিয়ান এইড। ব্রিফিংয়ে আলোচনা করেন সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডি’র জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামিম আহমেদ।
সিপিডি’র গবেষণায় উঠে এসেছে, একদিকে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে অনেক প্রতিষ্ঠান কর দিতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়ছেন। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪৫ শতাংশ কোম্পানি অভিযোগ করেছে, কর প্রদানের সময় তাদের ঘুষ দিতে হয়েছে এবং ৮২ শতাংশ কোম্পানি করহারকে ‘অন্যায্য’ বলে মন্তব্য করেছে। করপোরেট আয়কর নিয়ে গবেষণার জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়-এমন মোট ১২৩টি কোম্পানির তথ্য নিয়েছে সিপিডি। এ ছাড়া তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক, তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যাংকিং ও চামড়া-এই পাঁচটি খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের মতামত নেয়া হয়েছে। জরিপটি পরিচালিত হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে।
সিপিডি’র মতে, ২০২৩ সালে আনুমানিক ২ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা কর ফাঁকি হয়েছে। এর মধ্যে করপোরেট কর ফাঁকির পরিমাণই অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ; সেই হিসাবে এই খাতে ২০২৩ সালে আনুমানিক ১ লাখ ১৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা করপোরেট কর ফাঁকি দেয়া হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, কর ফাঁকির প্রবণতা ২০১১ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০১২ সালে যেখানে কর ফাঁকি ছিল ৯৬ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা, তা ২০১৫ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৩ হাজার ৬৭৩ কোটিতে এবং ২০২৩ সালে তা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কর ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপক কর ফাঁকি সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে এবং আইনের প্রতি অনুগত নাগরিকদের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে দেয়।
জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামিম আহমেদ বলেন, বৈশ্বিক অবস্থার মতো বাংলাদেশেও করপোরেট কর কমতির দিকে। পোশাক, আইসিটিসহ অনেক খাত কর সুবিধা পেয়ে থাকে। ২ লাখ ৮৮ হাজার কোম্পানি রেজিস্ট্রার্ড, কিন্তু ট্যাক্স রিটার্ন সাবমিশন করেছে মাত্র ৯ শতাংশ কোম্পানি বা ২৪ হাজার ৩৮১টি কোম্পানি। এটা একটা বড় বৈষম্য। যারা কর দিচ্ছে তাদের ওপর করের বোঝা বাড়ছে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় থাকা বাংলাদেশের জন্য এই পরিস্থিতি বড় চ্যালেঞ্জ। এলডিসি উত্তরণের পর বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যার ফলে কর ফাঁকি ও কর পরিহারের ঝুঁকিও বাড়বে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সিপিডি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কর ব্যবস্থার ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন ও নীতিগত সংস্কারের সুপারিশ করেছে।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কর ফাঁকি ছাড়াও প্রণোদনা ও কর ছাড়ের কারণে সরকার প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। বিনিয়োগের কথা বলে বিভিন্ন খাতভিত্তিক কর ছাড় দেয়া হচ্ছে। এগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত। প্রণোদনা বা কর ছাড় বিনিয়োগের ভিত্তি হতে পারে না বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশের প্রণোদনা কাঠামো পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় তৈরি বলে অভিযোগ করেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তার মতে, এই কাঠামো থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। বিনিয়োগের কথা বলে বিভিন্ন খাতভিত্তিক কর ছাড় দেয়া হচ্ছে। এগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত। প্রণোদনা বা কর ছাড় বিনিয়োগের ভিত্তি হতে পারে না।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আগামী দিনে সরকার যদি উচ্চমাত্রায় রাজস্ব না পান তাহলে ভর্তুকি, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, দক্ষ জনবল তৈরি করা সরকারের পক্ষে সহজ হবে না। তিনি বলেন, প্রতি বছর বাজেট আসলে প্রেশার গ্রুপ সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকেন তার করহার কমানোর জন্য। এর ফলে কর নিয়ে সরকারের যে লক্ষ্য তা প্রায়ই বিচ্যুত হয়। কর-জিডিপি বাড়ানোর লক্ষ্যে আগামী দিনে একটি কাঠামো প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শুধু যে কর ফাঁকি তা নয়, করজালের বাইরেও অনেক খাত ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদেরকে করজালের মধ্যে আনা যায়নি। এই বিপুল পরিমাণ ফাঁকি রোধ করতে পারলে বড় পরিমাণ অর্থ বা রাজস্ব আদায় সম্ভব। এই গবেষক বলেন, ডিজিটালাইজেশন কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমরা দেখতে পারছি। ব্যবসায়ী ও এনবিআরের স্বার্থে এটা করা জরুরি। অথচ এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের এক ধরনের অনীহা রয়েছে। বাংলাদেশে যেকোনো লেনদেন একক ডিজিটাল সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। যাতে করে যেকোনো লেনদেন ট্রেস ও ট্রাক করা যায়। সেটার আলোকে দাখিলকৃত রিটার্নকে ভেরিফাই করা যায়।
ক্রিশ্চিয়ান এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুজহাত জাবিন বলেন, বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের দেশ প্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। এটা পরিবর্তন করতে হবে। আমরা যখন এলডিসি গ্রাজুয়েশন করছি প্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।
গবেষণায় আরও বলা হয়, কিছু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তা করদাতাদের ডিজিটাল মাধ্যমে রিটার্ন দাখিল করতে নিরুৎসাহিত করেন। কারণ, ডিজিটাল পদ্ধতি কর ফাঁকি ও ঘুষের সুযোগ কমিয়ে দেয়। বর্তমানে মাত্র ২৫% কোম্পানি সম্পূর্ণভাবে অনলাইনে কর রিটার্ন জমা দেয়, যা সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। এই দুর্নীতি রোধে সিপিডি কিছু প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম- এনবিআর ভবনের কর কর্মকর্তাদের সব কক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো। এটি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে সহায়ক হবে বলে মনে করে সিপিডি। তবে তারা সতর্ক করেছে, এসব ক্যামেরার ফুটেজ যেন শুধুমাত্র অনুমোদিত ব্যক্তিরাই দেখতে পারেন, সে জন্য কঠোর তথ্য সুরক্ষা নীতি মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া তারা স্বাধীন তদারকি, নিয়মিত অডিট এবং স্বচ্ছ প্রতিবেদন ব্যবস্থার মতো চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে, যাতে কর আদায়ের প্রক্রিয়া হয় ন্যায্য ও দুর্নীতিমুক্ত।