শেষের পাতা
স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ
স্টাফ রিপোর্টার
৬ মে ২০২৫, মঙ্গলবার
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন। স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বেলা ১১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অধ্যাপক ইউনূসের কাছে কমিশন এই প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে মোটাদাগে ৩২টি সুপারিশ করা হয়েছে।
সংবিধান সংশোধনপূর্বক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে দেয়ার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন। এ ছাড়াও কমিশন স্বতন্ত্র ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস’ গঠনের সুপারিশ করেছে। সরকারি হাসপাতালে জনবল নিয়োগ, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা বৃদ্ধি, রোগীদের বিদেশমুখিতা কমাতে নতুন হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব করেছে কমিশন।
কমিশনের মুখ্য সুপারিশে সংবিধান সংশোধন করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
কমিশন বেশ কিছু আইন সংস্কার ও নতুন আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। সুপারিশে বলা হয়, সব সংশ্লিষ্ট পুরনো আইন পর্যালোচনা করে যুগোপযোগী করতে হবে। এ ছাড়া রোগী সুরক্ষা, আর্থিক বরাদ্দ, জবাবদিহি ও জরুরি অবস্থায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। কমিশন প্রস্তাবিত নতুন আইনগুলো হলো বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন আইন; বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস আইন; জনস্বাস্থ্য ও অবকাঠামো আইন; বাংলাদেশ সেইফ ফুড, ড্রাগ, আইভিডি ও মেডিকেল ডিভাইস আইন; ওষুধের মূল্য নির্ধারণ ও প্রাপ্তি আইন; স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও রোগী নিরাপত্তা আইন; অ্যালায়েড হেলথ প্রফেশনাল কাউন্সিল আইন; হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক অ্যাক্রেডিটেশন আইন; স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন; নারী স্বাস্থ্য আইন; ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ আইন; শিশু বিকাশ কেন্দ্র আইন; বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল আইন; স্বাস্থ্য তথ্য সুরক্ষা আইন ও স্বাস্থ্য খাতে টেকসই অর্থায়ন আইন। এ ছাড়া নিম্নলিখিত আইনগুলোর সংশোধন প্রয়োজন: বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, মেডিকেল শিক্ষা অ্যাক্রেডিটেশন আইন, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল আইন, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল আইন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, পৌর ও সিটি করপোরেশন আইন ইত্যাদি।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একটি স্বাধীন ও স্থায়ী ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই কমিশন স্বাস্থ্যবিষয়ক নীতি প্রণয়নে সংসদ ও সরকারকে কৌশলগত পরামর্শ দেবে। পাশাপাশি এটি জাতীয় কৌশল, সেবা ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মানদণ্ড এবং ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন প্রণয়ন করবে। এর ভিত্তিতে কমিশন বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও সরকারকে উন্নয়নের জন্য গঠনমূলক মতামত ও দিকনির্দেশনা প্রদান করবে। এই কমিশন সরাসরি সরকারপ্রধানের কাছে জবাবদিহি করবে। প্রতিবছর একটি বার্ষিক প্রতিবেদন সংসদে পাঠাবে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পেশাদারি, দক্ষতা ও জবাবদিহিমূলক সেবার মান নিশ্চিত করতে বিদ্যমান স্বাস্থ্য ক্যাডার, অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ক্যাডার এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সব জনবল নিয়ে প্রশাসনিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত ও পেশাভিত্তিক একটি নতুন সিভিল সার্ভিস-বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস গঠন (বিএইচএস) করতে হবে। প্রতিবেদনে স্বতন্ত্র পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, উপজেলা পর্যায়ে সেকেন্ডারি স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করে জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সহজলভ্য করতে হবে। জেলা হাসপাতালগুলোয় বিশেষায়িত (টারশিয়ারি স্তরের) চিকিৎসাসেবা চালু করতে হবে, যাতে সেবার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত হয়, মেডিকেল কলেজ ও জাতীয় ইনস্টিটিউটগুলোর ওপর রোগীর চাপ কমানো যায়, ভৌগোলিক কারণে কেউ বিশেষায়িত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হন। প্রতিটি বিভাগীয় সদরে অন্তত একটি পূর্ণাঙ্গ, সর্বাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ও বিশ্বমানের টারশিয়ারি সেবা হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে, যা জটিল ও বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য একটি আঞ্চলিক রেফারেল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। প্রতি রোগীর জন্য গড়ে ১০ মিনিটের পরামর্শ সময় নিশ্চিত করতে হবে, এ জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেবা প্রদানকারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে এবং সাপ্তাহিকভাবে প্রেসক্রিপশন নমুনা যাচাইয়ের পদ্ধতি চালু করা হবে। অতি দরিদ্র বা যারা দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ, তারা সব হাসপাতালে বিনামূল্যে সব সেবা পাবেন। দেশের সব সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি হাসপাতালের রক্ত সঞ্চালন সেবা, ল্যাবরেটরি সেবা ও ফার্মেসি ২৪/৭ খোলা থাকবে।
সুপারিশে বলা হয়েছে, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সর্বজনীন প্রাপ্যতাকে একটি মৌলিক স্বাস্থ্য অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। দেশের সব নাগরিককে প্রয়োজনের ভিত্তিতে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ বিনামূল্যে (যথা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পর্যায়ে এবং অতি দরিদ্রের ক্ষেত্রে) বা ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করতে হবে। বেসরকারি খাত থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত ওষুধ সংগ্রহে কৌশলগত ক্রয়ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ফার্মেসি ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হবে। এই ফার্মেসিগুলো জাতীয় ফার্মেসি নেটওয়ার্কের আওতায় পরিচালিত হবে। অ্যান্টিক্যান্সার, অ্যান্টিডায়াবেটিক, অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ ও অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকাভুক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর ভ্যাট এবং প্রযোজ্য অন্যান্য শুল্ক ও কর শূন্য হবে। অন্যদিকে ভিটামিন, মিনারেলস, ব্রেস্ট মিল্ক সাবস্টিটিউট ও প্রোবায়োটিকসহ স্বাস্থ্য-সম্পূরক ও উচ্চমূল্যের ওষুধের ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধি করতে হবে। এর মাধ্যমে একদিকে জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের প্রাপ্যতা বাড়বে, অন্যদিকে তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় ও বিলাসমূলক পণ্যে কর বাড়িয়ে রাজস্ব আয় জোরদার করা যাবে।
স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেছেন, চিকিৎসক-ফার্মাসিউটিক্যাল-সংক্রান্ত নীতি সস্পর্কিত সুপারিশে কমিশন সুপারিশ করেছে, ওষুধের নমুনা বা উপহার দিয়ে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকবে। অর্থাৎ, উপহার দিয়ে চিকিৎসকদের প্রভাবিত করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়াও ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের ওষুধের ভ্যাট-কর মওকুফ করার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন জমা শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সংখ্যা বাড়ানো এবং দুই বছর পর পর এই ওষুধের তালিকা আপডেট করার সুপারিশ করেছে কমিশন। এ ছাড়াও অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ প্রাথমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভর্তুকিমূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ: স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিন ধরে যেসব সমস্যা রয়েছে তা নিরসনে স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এসব সুপারিশের যেগুলো এখনই বাস্তবায়নযোগ?্য সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
কমিশন প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে এই কমিশনের সদস্যরা তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নিকট হস্তান্তর করেন। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ইনফরমেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন, অধ্যাপক লিয়াকত আলী, ডা. সায়েবা আক্তার, ডা. নায়লা জামান খান, সাবেক সচিব এম এম রেজা, ডা. মোজাহেরুল হক, ডা. আজহারুল ইসলাম খান, ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন, ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, ডা. আহমেদ এহসানুর রাহমান এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি উমাইর আফিফ।