ঢাকা, ৬ মে ২০২৫, মঙ্গলবার, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৭ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

বেকার ৬০ হাজার শ্রমিক

আগস্টের পর শতাধিক কারখানা বন্ধ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৬ মে ২০২৫, মঙ্গলবার
mzamin

গত বছরের আগস্ট মাসের পর প্রায় শতাধিক কারখানা স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। এতে কাজ হারিয়েছেন ৬০ হাজারের অধিক শ্রমিক। অন্যদিকে দেশে অর্থনৈতিক সংকট সহ নানা উত্থান-পতনের মধ্যেও রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পে নতুন নতুন কারখানাও চালু হয়েছে। এতে কর্মসংস্থানও বেড়েছে। তবে কারখানা বন্ধ ও খোলা শিল্পের কার্যক্রমের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে মনে করেন শিল্প উদ্যোক্তারা। বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও শিল্প পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে বৈশ্বিক অর্ডার কমে যাওয়া, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের মূল্যস্ফীতি, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, অর্থ পরিশোধে বিলম্ব এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনসহ একাধিক কারণ উল্লেখ করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

শিল্প পুলিশ জানায়, গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর ৯৫টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। এর বাইরে আরও কয়েকটি কারখানা অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হওয়া কারখানার মধ্যে গাজীপুরে রয়েছে ৫৪টি, নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদীতে ২৩টি ও সাভার-আশুলিয়ায় ১৮টি। এসব কারখানায় ৬১ হাজার ৮৮১ জন শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করতেন। রাজধানীর অদূরে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় প্রায় ২ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার মধ্যে ২৩ প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। এসব শিল্পকারখানার প্রায় ৬ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন। শিল্প পুলিশ-৪-এর কর্মকর্তারা জানান, গত সাত মাসে গ্রীন বাংলা হোম টেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, এশিয়ান ফ্যালকন গার্মেন্টস, জিএল ফ্যাশন, মাস্টার টেক্সটাইল, ওয়েস্ট বেস্ট অ্যাটায়ার্স, স্টার কাটিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংসহ ২১টি কারখানা বন্ধ হয়। সব কারখানাই ছোট ও মাঝারি। এছাড়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী গ্রুপের দুই কারখানার কয়েকটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত কারাখানা দু’টিতে কাজ করতেন চার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। গাজীপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট নিবন্ধিত কারখানা ২ হাজার ১৭৬টি। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি তৈরি পোশাক কারখানা, সংখ্যা ১ হাজার ১৫৪টি। গত আগস্টের পর জেলার ৫৪টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হওয়া কারখানার প্রায় সবক’টিই তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের। গাজীপুরে বন্ধ হওয়া কারখানার মধ্যে উল্লেখযোগ্য টিএমএস অ্যাপারেলস, নায়াগ্রা টেক্সটাইল, মাহমুদ জিন্‌?স, হার্ডি টু এক্সেল, পলিকন লিমিটেড, অ্যাপারেল প্লাস, মাহমুদ জিন্‌স অ্যাপারেলস, টিআরজেড ও দি ডেল্টা নিট। গাজীপুরে বন্ধ হওয়া ৫৪ কারখানার ৪৫ হাজার ৭৩২ শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে বেক্সিমকোর ৩৩ হাজার ২৪৪ জন শ্রমিক রয়েছেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের সারাবো ও কাশিমপুরে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৪ কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়। 

অন্যদিকে ঢাকার নিকটবর্তী সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে শিল্পকারখানা রয়েছে ১ হাজার ৮৬৩টি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানা ৭৪৫টি। গত সাত মাসে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে ১৮টি তৈরি পোশাক কারখানা। এতে বেকার হয়েছেন ১০ হাজার ১২৭ জন শ্রমিক-কর্মচারী। শিল্প পুলিশ-১-এর কর্মকর্তারা জানান, গত সাত মাসে সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই অঞ্চলের জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন, বেস্ট ওয়ান সোয়েটার, এমএস সোয়েটার, সাভার স্পোর্টসওয়্যার, বার্ডা গ্রুপ, র?্যামস ফ্যাশন অ্যান্ড এমব্রয়ডারি, প্রিয়াঙ্কা ফ্যাশন, জাভান টেক্স নিটওয়্যার ইত্যাদি কারখানা বন্ধ হয়।
পোশাক কারখানা বন্ধ ও চালু: অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে নতুন বিনিয়োগ আসছে। তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৫ মাসে তাদের নতুন কারখানা চালু হয়েছে ১২৮টি। এতে মোট ৭৪ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে এই পনেরো মাসে আবার ১১৩টি কারখানা বন্ধও হয়ে গেছে। এতে কাজ হারিয়েছেন ৯৬ হাজার ১০৪ শ্রমিক। আর কর্মসংস্থানের যোগ-বিয়োগের পর বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার। আর ১১৩টির মধ্যে ৬৯টি (৬১ শতাংশ) বন্ধ হয়েছে গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে। 

সমপ্রতি বন্ধ হওয়া তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে সংকটে পড়া বেক্সিমকো গ্রুপের ২৪টি, কেয়া গ্রুপের ৪টি, টিএনজেডের ৪টি প্রতিষ্ঠান এবং ভারগো এমএইচ, মডিশ অ্যাটায়ার, সিরোক অ্যাপারেলস, ওডিশ ক্র্যাফট ইত্যাদি। অন্যদিকে গত ১৫ মাসে বিজিএমইএর সদস্যপদ নেয়া নতুন কারখানাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো একেএইচ আউটওয়্যার, এজেড কম্পোজিট, নেক্সটন, এলএসএ অ্যাপারেলস, সিটেক ফ্যাশন, সুপ্রিম আউটফিট, স্প্যারো গ্রিনটেক ইত্যাদি। নতুন ১২৮ কারখানার মধ্যে মাত্র ১৮টিতে শ্রমিকের সংখ্যা ১ হাজারের বেশি। 

নতুন চালু হওয়া কারখানার সংখ্যা বন্ধের চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও চাকরি হারিয়েছেন ২২ হাজারের বেশি। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ৬৯টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে ৭৬ হাজার ৫০৪ জন শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশ সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, কারখানা বন্ধের কারণে এক লাখের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৭৫ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক এখনও বেকার। অবশিষ্ট শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

৩ কারণে বন্ধ কারখানা: প্রথমত, বেশির ভাগ মালিক আর্থিক সংকট ও ক্রয়াদেশ না থাকায় কারখানা বন্ধ করেছেন। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মালিকদের কয়েকটি কারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। সেগুলো বন্ধ হয়েছে। তৃতীয়ত, ক্ষমতাচ্যুত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ী আত্মগোপনে থাকায় তাদের কারখানা রুগ্‌?ণ হয়ে পড়েছে।
তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুরনো কিছু কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে। এতে সামনের দিনগুলোতে ভালো কিছু হবে বলে আশা করা যায়। 
বিজিএমইএ’র সাবেক সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান খান মনে করেন, নতুন কারখানা চালু ও এর বিপরীতে কিছু বন্ধ হবে- এটা চলমান প্রক্রিয়া। তার মতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বিদেশি পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করায় একধরনের চাপ বা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এই অনিশ্চয়তা না কাটা পর্যন্ত নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে উদ্যোক্তারা কিছুটা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, এবার রাজনৈতিক পরিবর্তনও একটি ভূমিকা পালন করেছে। বেশ কয়েকটি বড় গ্রুপ- যেমন বেক্সিমকো এবং নাসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, নতুন চালু হওয়া কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোর চেয়ে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।

এ বিষয়ে জানতে শিল্প পুলিশের ডিআইজি মো. ছিবগাত উল্লাহকে কয়েক বার ফোন ও এসএমএস করা হলে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

 

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status