বাংলারজমিন
হাওর রক্ষা স্থায়ী বাঁধ
সুনামগঞ্জে ৩০৮ কোটি টাকার কাজে নয়ছয়
এম. এ রাজ্জাক, সুনামগঞ্জ থেকে
৬ মে ২০২৫, মঙ্গলবার
সুনামগঞ্জের ১৪টি হাওরে ফসল রক্ষা স্থায়ী বাঁধ নির্মাণকাজে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। বাঁধের কাজ একবছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। ৩০৮ কোটি টাকার বিশেষ এই প্রকল্পের বাঁধ নির্মাণকাজে নয়ছয় হচ্ছে। ঢাকা, নোয়াখালী, নেত্রকোনা ও সিলেটের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ বাঁধ নির্মাণে কাজ করছে। আগামী জুনে এসব প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। হাতে আছে মাত্র আর দুই মাস। এ সময়ের মধ্যেই তড়িঘড়ি করে নামমাত্র কাজ শেষ করার চেষ্টা করছেন ঠিকাদাররা।
জানা যায়, ২০১৮ সাল থেকে স্থানীয় কৃষক ও সুবিধাভোগীদের নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ করা হচ্ছে। এবার ১২৭ কোটি টাকা প্রাক্কলন ধরে ৬৮৭টি প্রকল্পে ৫৯৫ কিলোমিটার বাঁধের কাজ হয়েছে। পাউবো অনেকটা নীরবে ঠিকাদারদের দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে। একইসঙ্গে পিআইসি’র ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শুরু হওয়ায় মানুষ বুঝতে পারেনি কোনটা স্থায়ী আর কোনটা পিআইসি’র কাজ। বন্যা ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন জরুরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় গত বছর জেলার ৭টি উপজেলায় ১৪টি হাওরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য ১৭টি প্রকল্প নেয়া হয়। এতে ৩০৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। এসব প্রকল্পে মাটি, বালু, জিও ব্যাগ এবং বাঁধের দু’পাশ ও ওপরে আরসিসি ব্লক দেয়ার কাজ রয়েছে। সবমিলিয়ে ১৭টি প্রকল্পে ১৬ দশমিক ১৪ কিলোমিটার বাঁধের কাজ হওয়ার কথা। কাগজপত্রে কোনো কোনোটি কাজ শুরু দেখানো হয়েছে গত বছরের জানুয়ারি, কোনোটি মার্চে।
স্থানীয় কৃষক সবুজ মিয়া বলেন, বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, হাওরে পানি চলে আসছে। তাই বাকি দুই মাসে কোনো অবস্থাতেই এসব বাঁধের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। শান্তিগঞ্জ উপজেলার খাই হাওরে স্থায়ী বাঁধের দু’টি প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। এগুলোতে এখনো ভালোভাবে মাটির কাজেই শেষ হয়নি। এর মধ্যে তাড়াহুড়ো করে ব্লকের কাজ শুরু করে দেয়া হয়েছে। ঢাকার মেসার্স মোস্তফা অ্যান্ড সন্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আসামুরা গ্রামের পাশ থেকে বাঁধের ভেদাখালী পর্যন্ত অংশের কাজ পেয়েছে। বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ (ক্লোজার) অংশে দু’টি এক্সাভেটর দিয়ে মাটি ফেলা হচ্ছে। আবার একাংশে নদীর তীর ঘেঁষে বসানো হচ্ছে কিছু পাকা ব্লক। উত্তর পাশে বাঁধের কিছু অংশ বৃষ্টিতে ধসে গেছে। বর্ষায় এসব মাটি আর ব্লক থাকবে না। এই কাজ যদি শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে করা হতো, তাহলে টেকসই হতো। এখন যেনতেনভাবে কাজটা শেষ করার চেষ্টা করছে তারা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি কামরুল হাসান বলেন, মাঝখানে বৃষ্টি হওয়ায় এক্সাভেটর চালাতে সমস্যা হয়েছে। এখন মাটি এবং ব্লকের কাজ হচ্ছে। বর্ষা আসার আগেই কাজ দ্রুত শেষ করবেন বলে জানান তিনি।
আতাউর রহমান খান লিমিটেড ও মেসার্স প্রীতম এন্টারপ্রাইজ নামের দু’টি প্রতিষ্ঠান হাওরের বাঁধে মাটির কাজ করতে দেখা যায়। নদী তীরবর্তী অংশে দু’টি স্থানে কিছু ব্লক বিছানো হয়েছে। আবার উত্তর পাশে মাটি খাড়াভাবে থাকায় বৃষ্টিতে কয়েকটি স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। স্থানীয় দুর্বাকান্দা গ্রামের ইউপি সদস্য সাইদুল ইসলাম বলেন, মাটির ওপর বালু, জিও ব্যাগ দিয়ে পরে ব্লক বসানোর কথা। কিন্তু অনেক স্থানে বালু দেয়া হচ্ছে না। কাজে গাফিলতি হচ্ছে। আর বড়জোর এক সপ্তাহ কাজ করা যাবে। পরে বর্ষায় কাজ বন্ধ রাখতে হবে। যে ব্লক, মাটি দেয়া হয়েছে, সেগুলো বর্ষায় ধসে যাবে। এক বছর আগের কাজ এখন তাড়াহুড়োয় শেষ করতে গিয়ে কাজের মান খুব খারাপ হচ্ছে।
গত রোববার দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্র্যালয়ে পাউবোর বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন প্রকল্প বিষয়ক মতবিনিময় সভায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) আব্দুল লতিফ মোল্লা বলেছেন, হাওরে ৩০৮ কোটি টাকার স্থায়ী ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও বাঁধের পাশের গর্ত ভরাট প্রকল্পের কাজে ঠিকাদারদের গাফিলতির অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হচ্ছে। অনিয়ম পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, কাজে অনিয়ম কিংবা ঠিকাদারের গাফিলতি হচ্ছে না। জলমহালে ইজারা আছে। মাটি কাটলে পানি চলে যাবে। আবার কোথাও কোথাও মাটির সংকট মানুষের এসব কথার কারণে প্রথম দিকে কাজ শুরু করা যায়নি। হাওরের দুর্গম এলাকায় এসব কাজ হচ্ছে। নির্মাণসামগ্রী নেয়া কঠিন। শ্রমিকরা থাকতে চায় না। স্থানীয় লোকজনও সমস্যা করেন। এ কারণে স্থায়ী বাঁধের কাজ একটু বিলম্ব হচ্ছে।