শেষের পাতা
আইএমএফের ঋণ নিয়ে শঙ্কা কাটেনি
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
১ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবারআন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ঋণ পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত সহ বেশ কয়েক শর্ত পূরণ না হওয়ায় ঋণ প্রক্রিয়াটি আটকে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এদিকে আইএমএফ কর্তৃপক্ষ শর্ত পূরণের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিলেও এখন পর্যন্ত অনড় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় ঋণ সংক্রান্ত আলোচনায় সমাধানে পৌঁছানো ছাড়াই ওয়াশিংটন থেকে ঢাকায় আসেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তবে কষাকষি চলছে বলে জানা গেছে।
এ নিয়ে গত ২৫শে এপ্রিল ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আইএমএফ’র ঋণ এখন দেশের অর্থনীতির জন্য খুব বেশি প্রয়োজনীয় নয়। তাদের ঋণের কিস্তি না পাওয়া গেলেও কোনো ক্ষতি হবে না। দেশের অর্থনীতি যেমন আছে, তেমনই চলবে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে স্থানীয় সময় গত শুক্রবার আইএমএফ’র কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশ মিশনের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মর্তুজাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গভর্নর এ সব কথা বলেছেন।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ’র বসন্তকালীন সভায় যোগ দিতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গভর্নর সহ উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র সফর করে। গত ২১শে এপ্রিল থেকে ২৬শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত এই সভার অবসরে আইএমএফ’র কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুই দফায় বৈঠকে বসেন উপদেষ্টা ও গভর্নরসহ ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদল।
অন্যদিকে বুধবার এফবিসিসিআই আয়োজিত সভায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা শুধু আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক এর সঙ্গে কথা বলিনি। আমরা সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। সরকার শুধু আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেনি। অন্যান্য সব পক্ষের সঙ্গেও কথা বলেছে। আইএমএফ’র সঙ্গে এখনও শর্ত মেলেনি। কঠোর দর কষাকষি হচ্ছে। চেষ্টা চলছে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল নয় বলেও মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। বলেন, আইএমএফ’র সব শর্ত মেনে আমরা ঋণ নিতে চাই না।
জানা গেছে, বাংলাদেশ তৃতীয় কিস্তির অর্থ পেয়েছে ২০২৪ সালের জুন মাসে। তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার। চতুর্থ কিস্তির অর্থ পাওয়ার কথা ছিল গত বছরের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু তখন তা পাওয়া যায়নি। চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় করতে গড়িমসি করছে আইএমএফ। তবে জুন মাসে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একত্রে পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী বাংলাদেশ। অথচ শ্রীলঙ্কার ঋণের কিস্তি ছাড় করতে প্রাথমিকভাবে সম্মত হয়েছে সংস্থাটি। সবকিছু ঠিক থাকলে আইএমএফের পঞ্চম কিস্তির ৩৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার পাবে শ্রীলঙ্কা। গত শুক্রবার তা শ্রীলঙ্কার কিস্তি পাওয়া নিয়ে আইএমএফ’র ওয়েবসাইটে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, এ পর্যন্ত যা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যেসব সংস্কার হবে, তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে বলে আমি মনে করি। যা আইএমএফ’র সিদ্ধান্তে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সূত্র জানায়, ওয়াশিংটনে কোনো সমাধান ছাড়াই দু’টি বৈঠক শেষ হয়। অথচ এই বৈঠকেই বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার বিষয়টি সুরাহা হওয়ার কথা ছিল। এই সময়ে শ্রীলঙ্কাকে ঋণের পঞ্চম কিস্তি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি। প্রাথমিক চুক্তিও (স্টাফ লেভেল এগ্রিমেন্ট) হয়েছে দেশটির সঙ্গে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে উল্টো ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে এখন পর্যন্ত ঋণের কোনো কিস্তি পায়নি বাংলাদেশ। ঋণের চতুর্থ কিস্তি পাওয়ার কথা ছিল গত ডিসেম্বরে। শর্ত পূরণ না হওয়ায় সেটি মার্চে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মার্চেও মেলেনি কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার। বেশ কিছু শর্তে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একত্রে জুনে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল আন্তর্জাতিক এই ঋণদাতা সংস্থাটি।
জানা গেছে, আগামী জুন মাসে আইএমএফ’র পর্ষদ সভায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিদ্যমান ঋণ চুক্তির কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন হবে। এর এক মাস আগেই পর্ষদ সভার এজেন্ডায় ঋণ প্রস্তাবগুলো উঠতে হবে। ঋণ প্রস্তাব উঠতে হলে স্টাফ লেভেল এগ্রিমেন্ট করতে হবে বাংলাদেশকে। এ ধরনের কোনো চুক্তি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে করেনি সংস্থাটি।
বৈঠক সূত্র জানায়, দুই দফার আলোচনায় আইএমএফ বেশির ভাগ শর্তে ছাড় দিতে নমনীয়তা দেখায়। পাশাপাশি বাংলাদেশও কিছুটা সময় নিয়ে মুদ্রাবিনিময় হার বাজারভিত্তিক করাসহ রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সংস্কারে রাজি হয়। তবে ডলারবিনিময় হার সংক্রান্ত আরেকটি শর্তে এসে আলোচনা আটকে যায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এই শর্তে অসম্মতি প্রকাশ করেন। তবে সমঝোতা ছাড়াই আলোচনা শেষ হলেও ওই শর্তটিতে রাজি হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। ওই সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশ মত পাল্টালে আইএমএফ’র সঙ্গে স্টাফ লেভেল এগ্রিমেন্ট হতে পারে।
আইএমএফ’র ঋণের দুই কিস্তি না পেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকরা। যদিও গণমাধ্যমের কাছে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, এই ঋণ না পেলে বাংলাদেশের কোনো সমস্যা হবে না। তবে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, রিজার্ভের চাপ এবং আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যহীনতার প্রেক্ষাপটে আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়া বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, গভর্নর যেটা বলেছেন সেটাই হয়তো ঠিক। কোনো আর্থিক সমস্যা নাও হতে পারে। তবে এতে বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট হবে। কারণ শর্ত পূরণ করতে না পারায় বাংলাদেশ ঋণ পায়নি এটি ভালো দেখাবে না।
আইএমএফ’র কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য থেকে জানা গেছে, চতুর্থ কিস্তিতে অর্থ পেতে বাংলাদেশের জন্য শর্ত ছিল চারটি। সেগুলো হলো- অর্থনীতির বহিঃচাপ সামাল দিতে রাজস্ব আদায় জোরদার করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে সবুজ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতে নীতিমালার বাস্তবায়ন।
এর মধ্যে বিনিময় হার ও রাজস্ব আহরণ নিয়ে শর্ত পূরণের অগ্রগতি নিয়ে ওই সময় আইএমএফ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। পরে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি পেতে আরও কিছু শর্ত জুড়ে দেয় সংস্থাটি। এর মধ্যে চারটি শর্তের বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। এগুলো হলো, রাজস্ব আয়ের ভালো প্রবৃদ্ধি না হওয়া, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না হওয়া, ভর্তুকি না কমা এবং ব্যাংক খাতের আশানুরূপ উন্নতি না হওয়া। এ সবের বাইরেও আরেকটি অপ্রকাশিত শর্ত নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছে সংস্থাটি। ওই শর্তে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত পুরোপুরি অনমনীয়। শেষ পর্যন্ত ওই শর্তের জালেই আটকে যেতে পারে আইএমএফ’র ঋণের অর্থ। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাংলাদেশ যদি নিজেদের জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে ঋণের অর্থ আদায় করে নিতে পারে- সেটি হবে বড় সাফল্য।
পাঠকের মতামত
আইএমএফ বলুন আর বিশ্ব ব্যাংক বলুন কম বেশি একিই।বাংলাদেশ খুব ভালো করেছে।
আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এসব থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা উচিত সারা দুনিয়ার অস্থিরতার জন্য এদের অবদান সব চাইতে বেশি এরা হলো সাম্রাজ্যবাদীদের হাতিয়ার
IMF এর loans থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে এবং দুরনিতি কমাতে পারলে ইনশাআল্লাহ আগামী পাচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাবে!!