খেলা
বাংলাদেশি ফুটবল আলট্রাস: গ্যালারি মাতিয়ে রাখা একঝাঁক তরুণ
ফারজানা ববি
৬ জুন ২০২৪, বৃহস্পতিবার
‘বাংলাদেশি ফুটবল আলট্রাসকে’ এক বাক্যেই বিশ্লেষণ করা যায়। বাংলাদেশ ফুটবলের ম্যাচে একজনও যদি গ্যালারিতে দর্শক থাকে- সেই একমাত্র দর্শক হবে আলট্রাসের। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন বাংলাদেশ ফুটবলের পাড় সমর্থক গোষ্ঠী নিয়ে কথা বলছি। কিংস অ্যারেনার নর্দান স্ট্যান্ডে যাদের খুঁজে পাওয়া যায় বাংলাদেশ ফুটবলের হয়ে গলা ফাটাতে। শুধু কি কিংস অ্যারেনায়? কোথায় নেই আলট্রাসের উপস্থিতি? যেখানেই বাংলাদেশ ফুটবলের ম্যাচ, সেখানেই আলট্রাস।
ইউরোপ-আমেরিকার ফুটবলের হাইপ বিশ্বজুড়ে। টিভির পর্দায় তো বটেই, গ্যালারিতে নিজ নিজ দলের সমর্থনে থাকে টানটান উত্তেজনা, নানান রঙের ফ্লেয়ার-স্মোক, দলের সমর্থনে গলা ফাটানো, প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা। ইউরোপ পারলে আমরা নয় কেন? যেমন ভাবনা তেমন কাজ। বাংলাদেশ ফুটবলে আবাহনী-মোহামেডানের সোনালি সময় কেটে গেছে। দর্শক খরায় ভুগছে গ্যালারি। গ্যালারিকে রঙিন করতে মেহেদী হাসান অভির নেতৃত্বে এগিয়ে আসে ‘আলট্রাস।’ বাংলাদেশ ফুটবল দলকে যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে সমর্থন দেয়াই আলট্রাসের মূল উদ্দেশ্য। দর্শকশূন্য গ্যালারিকে কীভাবে পূর্ণ করা যায়, সেটা নিয়েও কাজ করছে এই সমর্থকগোষ্ঠী।
আলট্রাসের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫ হাজারের ওপরে এবং নিবন্ধিত সদস্য সংখ্যা ১ হাজারেরও বেশি। প্রথম রেজিস্ট্রেশন শুরু করার পর প্রথম সপ্তাহে প্রায় ৩ হাজার সদস্যের রেজিস্ট্রেশন সম্পূর্ণ হয়। এবার বেছে বেছে চলছে সদস্য বানানোর কাজ। আলট্রাস বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল নারী-পুরুষ এবং বয়সভিত্তিক দলের সব ম্যাচে গ্যালারিতে উপস্থিত হয়।
বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশ বনাম ফিলিস্তিন ম্যাচে আলট্রাসের ছিল সরব উপস্থিতি। কালো পোশাকে কিংস অ্যারেনার নর্দান স্ট্যান্ডে নেচে-গেয়ে তারা বাংলাদেশ দলকে উৎসাহ দিতে থাকে। ফিলিস্তিনের বিপক্ষে মাঠের বাহিরে আবেগ থাকলেও মাঠের ভেতরে কোনো আবেগ নেই বলে জানিয়েছিলেন আলট্রাসের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ইয়াসিন মোল্লা। ঠিক তেমনটাই দেখা গেল মাঠে। রোজা রেখেও প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেয়ার কাজটিতে এতটুকু ছাড় দেয়নি এই গ্রুপটি। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের। শেষ মুহূর্তে গোল হজম করে হেরে যেতে হয় জামাল ভূঁইয়াদের। তাতে পুরো গ্যালারিজুড়ে পিনপতন নীরবতা নামলেও আলট্রাসের বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়ায় এতটুকু ভাটা পড়েনি। জিতে গেলে তো কথাই নেই, হেরে যাওয়া ম্যাচেও এই গোষ্ঠীর সদস্যরা দাঁড়িয়ে থাকে তুমুল উৎসাহে বাংলাদেশ দলকে বিদায় দেয়ার জন্য। তাদের এমন পাগলামো, খ্যাপাটে উদ্যাপন চোখ এড়ায়নি খেলোয়াড় থেকে বাফুফে পর্যন্ত। স্মোক পাইরো জ্বালিয়ে শিরোনামে এসেছিল আলট্রাস। নিয়মতান্ত্রিক উদ্যাপনের পরামর্শ দিয়ে এই গ্রুপটিকে স্বাগত জানিয়েছে বাফুফে। জাতীয় দলের ফুটবলাররা ব্যক্তিগতভাবে সাধুবাদ জানিয়েছে তাদের। এমনকি বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হাবিয়ের কাবরেরা পর্যন্ত গ্রুপটির সদস্যদের কার্যক্রমের প্রশংসা করেছেন।
আলট্রাসের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমরা গ্যালারিতে এমন আবহ সৃষ্টি করতে চাই যেন প্রতিপক্ষ দল বাংলাদেশে খেলতে আসলে মাঠের প্লেয়ারদের সঙ্গে গ্যালারির দর্শক নিয়েও সমীহ করে। আমরা বাংলাদেশ ফুটবল দলের ১২তম প্লেয়ারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পুরো ৯০ মিনিট প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করতে চাই। আমরা শুধু খেলা দেখার জন্যই মাঠে যাই না। আমরা ৯০ মিনিট গ্যালারিতে সক্রিয় থাকি। অন্য ফ্যানরা চুপচাপ বসে খেলা দেখলেও আলট্রাস মেম্বাররা সম্পূর্ণ ৯০ মিনিট অ্যাক্টিভ থেকে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যায়।’
২০১৯ সালের ১৭ই মে কয়েকজন ফুটবলপ্রেমী তরুণ আলট্রাস গড়ার কথা চিন্তা করে। ২৭শে মে তাদের আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু। কিন্তু শুরুটা এত সহজ ছিল না। যেহেতু আলট্রাসের ৭০ ভাগ সদস্যই পেশায় ছাত্র তাই তাদের জন্য সরঞ্জাম কেনার টাকার জোগানটাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবুও কিছু সমমনা তরুণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একত্রিত হয়ে শত শত ঘণ্টার পরিকল্পনা, জনসমর্থন অর্জন, সবাইকে একই লাল-সবুজ পতাকার নিচে আনার কাজটি করে। তাদের লক্ষ্য ছিল করোনা পরবর্তী বাংলাদেশে বাংলাদেশ বনাম নেপাল ম্যাচ। তাদের প্রয়োজন ছিল ড্রামসহ আরও অনেক সরঞ্জাম। প্রথম অবস্থায় তারা খুঁজতে থাকে ব্যবহৃত ড্রাম কেউ বিক্রয় করবে কি না। কারণ নতুন ড্রাম কেনার সামর্থ্য তখন তাদের ছিল না। সদস্যদের চাঁদায় প্রথম ম্যাচের জন্য পতাকা বানানো, ব্যানার করা, ড্রাম কেনা, টিকিট সংগ্রহ করা, রঙিন আবিরসহ সবকিছু বন্দোবস্ত করা হয়। ম্যাচের ৯০ মিনিট তারা কী করবে, কীভাবে চ্যান্ট করবে, গ্যালারিতে সবকিছু নিয়ে সবাইকে কীভাবে মাতিয়ে রাখবে এই উত্তেজনায় ছিল সদস্যরা।
প্রথম ম্যাচ শুরুর আগে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের চারপাশে ঘুরে ড্রাম বাজিয়ে, সেøাগানে মুখরিত করে তোলে আলট্রাস। পরে গ্যালারিতে ঢুকে চলতে থাকে লাল-সবুজের দলটিকে সমর্থন দেয়া। অবশ্য সবকিছু পরিকল্পনামাফিক হয় না। সেøাগান দিতে বাধা দেয়া হয় তাদের। বাংলাদেশ যখন প্রথম গোল দেয় বাঁধভাঙা উল্লাসে গ্রুপটি উদ্যাপন করতে থাকে। এখানেই বাধে বিপত্তি। সাধারণ দর্শক বিরক্ত ছিল, হাতাহাতির পর্যায়ও চলে যায়। তবে সমঝোতাও হয় সেখানেই।
তাদের ড্রামগুলো পুরনো হওয়ার কারণে প্রথম দুই ম্যাচেই নষ্ট হয়ে যায় সব। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের মেয়েদের বয়সভিত্তিক সাফের ফাইনালের আগে সদস্যদের কারও টিফিনের টাকা, কারও পকেট খরচের টাকা থেকে কেনা হয়েছে সরঞ্জাম। তাদের কথা একটাই, গ্যালারি রাঙাতে হবে বাংলাদেশের পক্ষে। তাদের এত আয়োজন ব্যর্থ হতে দেয়নি বাংলাদেশের মেয়েরা। ভারতের বিপক্ষে জয় পায় নারীরা। আলট্রাস বারবার বাধার সম্মুখীন হয়েছে। পড়তে হয়েছে সাধারণ দর্শক, পুলিশ, সিকিউরিটির রোষানলে। কিন্তু তাদের দমিয়ে রাখা যায় নি। তাদের অদম্য চেষ্টায় এখন বাংলাদেশ ফুটবলের সঙ্গে জুড়ে আছে আলট্রাসের নামও। সাধারণ দর্শক তো বটেই, ফুটবলারও হয়তো মাঠে নেমে একবার চোখ রাখেন গ্যালারিতে, ‘আলট্রাস আছে তো!’