অনলাইন
২৩ মে ১৯৮০: এক রক্তাক্ত শুক্রবার
আবু জুবায়ের
(১০ ঘন্টা আগে) ২৩ মে ২০২৫, শুক্রবার, ১১:৪৭ পূর্বাহ্ন

২৩ মে। বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক সহিংসতার এক বিভীষিকাময় দিন। ১৯৮০ সালের এই দিন বিকেল ৪টা ১৯ মিনিটে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে খন্দকার মোশতাক আহমদের ডেমোক্রেটিক লীগের জনসভায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। সেদিনের সেই নারকীয় বোমা হামলায় নিহত হন সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান আশাসহ ১৬ জন, আহত হন অন্তত দুই শতাধিক মানুষ।
আমার বাবা, আবু সালেহ—সেদিন ছিলেন দৈনিক দেশের সিনিয়র রিপোর্টার। তিনি একজন প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, সংস্কৃতিকর্মী এবং মুক্তিযুদ্ধপূর্ব বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত একজন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন তিনি রাজনীতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। সেদিনের জনসভা কভার করতে গিয়ে তিনিও গুরুতরভাবে আহত হন। তাঁর শরীরে ৬২টি স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছিল, যার অনেকগুলো আজও শরীরে বহন করছেন।
আমি তখন একেবারে ছোট। আমার মা, কবি কাজী মাসুদা সালেহ, সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে প্রায়ই কাঁদতেন। তিনি বলতেন, 'তোমার বাবাকে আমি আর কখনও সুস্থ দেখে উঠতে পারিনি। প্রতিটি মে মাস আমাদের জন্য অভিশপ্ত হয়ে উঠেছিল।' তাঁর কষ্ট শুধু ব্যক্তিগত নয় এটি ছিল এক রাজনৈতিক নির্মমতার জ্বলন্ত প্রমাণ। ১৯৮০ সালের সেই হামলার পর থেকে আমাদের পরিবার যেন একটি দীর্ঘ অসুস্থতার মধ্যে ঢুকে পড়ে। বাবার চিকিৎসা চলে একনাগাড়ে দেড় বছর—ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পিজি হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, এবং লন্ডনের হারমি স্ট্রিট ও হ্যামার স্মিথ হাসপাতাল। কিন্তু সেই যন্ত্রণার অবসান আজও হয়নি।
সেদিন নিহত হন সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান আশা, যিনি ছিলেন দৈনিক বাংলার নবীন রিপোর্টার। আহত হয়েছিলেন:
জহিরুল হক, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক বাংলা
মশির হোসেন , দৈনিক বাংলা
কামরুজ্জামান, ফটোসাংবাদিক
আবদুল খালেক, দৈনিক বাংলা
শফিকুল কবির, চিফ রিপোর্টার, ইত্তেফাক
রশিদ তালুকদার, ইত্তেফাক
জাকারিয়া মিলন, ইত্তেফাক
আবদুল মান্নান, সংগ্রাম
বাঙাল আবদুল কুদ্দুস, সাপ্তাহিক আখবার
মাহবুব, সাপ্তাহিক মুক্তিবাণীসহ আরও অনেকেই
জহিরুল হকের পেটে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয় এবং কয়েকটি দাঁত ভেঙে যায়। চিকিৎসা অবহেলায় মোস্তাফিজুর রহমান আশা বারান্দায় কাতরাতে কাতরাতে প্রাণ হারান। আমার বাবাকেও মৃত ভেবে লাশের স্তূপে ফেলে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান ও ফটোসাংবাদিক রশিদ তালুকদার তাঁর জীবনের ক্ষীণ স্পন্দন টের পেয়ে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চিকিৎসার দায়িত্ব নেন, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আনান, রক্তের সংস্থান করেন, এবং পরে বাবাকে দেখতে হাসপাতালে আসেন। তিনি বলেছিলেন, "তাকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।" কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের আগেই জিয়া নিহত হন। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল, বিচারপতি সামসুদ্দিন ছিলেন আহ্বায়ক। রিপোর্ট প্রস্তুত হয়েও প্রকাশিত হয়নি। বিচার হয়নি। সাংবাদিকদের সংগঠন, প্রেস ক্লাব, কিংবা রাজনৈতিক মহল কেউ আর এই ঘটনাকে গুরুত্ব দেয়নি।
সাংবাদিক আতাউস সামাদ বিবিসির এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, "২৩ মে যাঁরা আহত হয়েছিলেন, তাঁদের কেউই ভালো নেই।" এখনো কেউ নেই। আমার বাবা এখনো চিকিৎসাধীন, হাসপাতাল তাঁর দ্বিতীয় বাসা। আমার মা এই অবিচারের ভার নিয়েই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
আজকের দিনে যখন আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার কথা বলি, তখন এই ইতিহাসগুলো উঠে আসা দরকার। একটি রাষ্ট্র কীভাবে তার কলম সৈনিকদের রক্ত ঝরানো অতীত ভুলে যায়, তা আমাদের লজ্জিত করে। ২৩ মে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জনসভায় সংঘটিত বোমা হামলা। অথচ এই দিনটি কোথাও স্মরণ করা হয় না।
২৩ মে শুধু আমাদের পরিবারের শোক নয়, এটি একটি জাতির চেতনার ক্ষয়িষ্ণু স্মারক। আমরা চাই, এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হোক, আহত সাংবাদিকদের রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃতি ও সহযোগিতা দেওয়া হোক, এবং ২৩ মে-কে সাংবাদিক নিরাপত্তা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক।
আজও যখন বাবার শরীরে সেই বোমার স্প্লিন্টার যন্ত্রণা দেয়, তখন আমি বুঝি—রাষ্ট্র তাঁকে কেবল আহত করেনি, তাঁকে একা করে দিয়েছে। এই একাকীত্বই জাতির বিবেকের ব্যর্থতা।
লেখক , সাংবাদিক আবু সালেহ পুত্র , কবি , গবেষক
পাঠকের মতামত
এই দিন গুলির প্রতি আওয়ামী লীগের মিনিয়া ছিল,কিন্তু বর্তমান সরকারের তো কোন সমস্যা নেই। মোস্তাক সাহেবের ডেমোক্রেটিক লীগের বোমা হামলা আর তার জন্য আওয়ামী লীগের মোড়কে বাকসালীরা দুঃখ প্রকাশ করবে! সেটা সম্ভব না, তবে বর্তমান সরকারের কিছু একটা করা উচিৎ।