অনলাইন
এ এক অন্যরকম অনুভূতি
মনির হায়দার
(১০ মাস আগে) ১৪ জুন ২০২৪, শুক্রবার, ৪:৩০ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:১১ পূর্বাহ্ন

দিনপঞ্জি: জুন ১২, ২০২৪, জেএফকে
নিউ ইয়র্কের সকালটা বেশ ঝলমলে আজ। আকাশে মেঘের ছিটেফোটাও যেন নেই। কিন্তু আমার মনটা কেবল মেঘাচ্ছন্নই নয়, যেন মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে সেখানে। জন এফ কেনেডি বন্দরে হাজারও মানুষের ভিড়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ঠিক এক বছর পর বাড়ির পথে রওয়ানা দিয়েছি। কোথায় আনন্দে মনটা অনেক বেশি ফুরফুরে থাকার কথা। কিন্তু জীবনের বাকি সকল ফেরার সঙ্গে এই ফেরার কত তফাৎ! প্রতি মুহূর্তে, প্রতি কদমে যেন ভয়ঙ্কর রকমের এক শূন্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
এর আগের দু'বার আব্বাকে সারপ্রাইজ দিয়েছিলাম। ২০২১ এ যখন ফিরি- আব্বা হাসপাতালে ছিলেন প্রায় মুমূর্ষু অবস্থায়। আমার মেহেরপুরে ফেরা প্রায় ৮ বছর পর। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা আব্বা চেতন-অবচেতনের মাঝামাঝি। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বিস্ময়-অবিশ্বাস নিয়ে পলকহীন তাকিয়ে ছিলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর তাঁর খুব কাছাকাছি গিয়ে বসতেই হঠাৎ যেন পুরোপুরি হুঁশে ফিরলেন; ম্যাজিকের মতো বেশ খানিকটা শক্তিও ফিরে পেলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন। অনেকক্ষণ বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রাখলেন; একটু পরপর ফিসফিসিয়ে বলতে থাকলেন- আল্লাহ আমি আমার বাবাকে পেয়েছি আমার আর কোনও দুঃখ নেই।
ওই মুহূর্ত থেকেই আব্বার অবস্থার অভাবনীয় উন্নতি হতে থাকলো। আগের কয়েকদিন যেখানে তাঁর একটানা সজ্ঞানে থাকাটাই ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার- সেখানে এখন সারাক্ষণই জেগে থাকছেন, কথা বলার চেষ্টা করেছেন। আমি একটু চোখের আড়ালে গেলেই কাছে থাকা লোকজনকে জিজ্ঞেস করছেন- আমার বাবা কোথায়? এরমধ্যেই খোকন বাসায় গিয়ে মাকে হাসপাতালে নিয়ে এলো। তাঁকেও আগেভাগে জানানো হয়নি আমার হঠাৎ আগমনের বিষয়টি। তাই আমাকে দেখে তিনিও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তারপর কয়েক সেকেন্ডের ঘোর কাটতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! এমন কান্না সহজে কি থামে? কতদিন পর আব্বা মা দু'জনকে একসঙ্গে কাছে পেলাম। আমার চোখও ভেঙে পড়েছিল।
দু'দিনের মধ্যেই আব্বার অবস্থা এমন পর্যায়ে উন্নীত হলো; অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে স্থানান্তরের প্রস্তুতি শুরু। তুহিন ভাই, মেহেরপুরের মানুষের সামনে সাংবাদিক বলতেই সবার আগে যার চেহারাটা ভেসে ওঠে; কবে কিভাবে যেন তিনি আমাদের পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেলেন। গত ক'সপ্তাহ মেহেরপুর সদর হাসপাতালে আব্বার ভর্তি থেকে শুরু করে পুরো চিকিৎসার তদারকি সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে করে গেছেন তিনি। এ পর্যায়ে আবার আধুনিক যন্ত্রপাতি সুসজ্জিত একটি চমৎকার অ্যাম্বুলেন্স দ্রুতই যোগাড় করে ফেললেন তুহিন ভাই। তারপর তৃতীয় দিনে ঢাকার পথে রওয়ানা; অ্যাম্বুলেন্সে আব্বার সঙ্গে তাজুল এবং আমি। অক্সিজেন, নেবুলাইজারসহ সবরকম জরুরি প্রস্তুতি নেওয়া ছিল। কিন্তু স্রষ্টার কৃপায় তেমন কোনও পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। অনেকটা নির্বিঘ্নেই আব্বাকে নিয়ে ইবনে সিনায় পৌঁছালাম। ১৩ দিনের মাথায় নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে উড়াল দেয়ার আগে প্রতিদিন বেশির ভাগ সময় হসপিটালে আব্বার সঙ্গেই থাকবার চেষ্টা করেছি। মায়ের পেটের ভাই না হয়েও যিনি আমার জীবনে অকৃত্রিম এক সহোদর হয়ে উঠেছিলেন সেই আতিউর ভাইয়া প্রায় প্রতিদিনই এসে লম্বা সময় বসে থাকতেন আমার এবং আব্বার পাশে। বন্ধু-ভাই ডা: মাসুম তো যথারীতি ছায়ার মতো লেগেছিল। ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান হিসাবে তার ব্যস্ততা কোন্ পর্যায়ের তা সহজেই অনুমেয়। তারপরও আব্বার সুচিকিৎসার ব্যাপারে তার যে সার্বক্ষণিক সজাগ দৃষ্টি সেটাকেও আমার সৌভাগ্যই বলতে হবে। আর নাজমুল ইমাম- যার ব্যাপারে শুধু এটুকুই বলা যেতে পারে; ২০১৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আমার দেশ ছাড়ার পরদিন থেকেই আব্বা-মা'র চিকিৎসার সব ধরনের দায়-দায়িত্ব যেন আল্লাহ সরাসরি তার ওপর দিয়ে রেখেছেন। আমাদের ৯ ভাই বোনের বিশাল পরিবারে আমি আর চতুর্থ ভাই সিরাজ ছাড়া বাকি ৭ জনই দেশে। স্বাভাবিকভাবেই আব্বা মা'র সেবাযত্ন ও দেখাশোনার প্রশ্নে আমাদের দুজনের চেয়ে তারা প্রত্যেকেই অনেক বেশি সৌভাগ্যবান। সকলে তাদের সর্বোচ্চটাই করেছেন। কিন্তু রক্তের সম্পর্কহীন নাজমুল যেন আমাদের পরিবারে এক দেবদূত! আব্বা কিংবা মা- কার কখন ডাক্তার দেখাতে হবে, কিভাবে দ্রুত এপয়েন্টমেন্ট করতে হবে, দুর্লভ কোনও ওষুধ বিকল্প ব্যবস্থায় কিভাবে সংগ্রহ করতে হবে, সবার অলক্ষ্যে গিয়ে আব্বার জন্য হুইলচেয়ার কিনে আনা, এমনকি চিকিৎসা শেষে হাসপাতালের বিল কিভাবে একটু কমানোর পথ বের করা যাবে - এসব নিয়ে পরিবারের যে কারো চেয়ে নাজমুলের ব্যস্ততা-ত্রস্ততা বহুগুন বেশি। শুধু কি আব্বা মা'র চিকিৎসা? মেজ ভাইয়ের ব্যক্তিগত সমস্যা, ছোট বোনের স্বামীর ট্রাক পুলিশ আটকে দিয়েছে- তদবির করে সেটা ছাড়ানো, এমনকি আমার ছোট্ট ভাগনি জোবায়দা সন্ধিও জানে- তার অতি স্পর্শকাতর ব্যক্তিগত বিষয়ে নিশ্চিন্তে কথা বলা বা সাহায্য নেয়ার একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ এ জগতে আছে- তার নাম নাজমুল। অথচ পরিবারের বড় সন্তান হিসাবে নাজমুল এমনিতেই নানা দায়িত্বভারে ন্যুজ্ব। তদুপরি কর্মস্থল যমুনা টিভির বড় দায়িত্বে থাকার বড় ব্যস্ততা। মাঝে মাঝে ভাবি- ও কী করে যে সামলায় এতো কিছু!
সেবার যেদিন ঢাকা ছাড়ি- আব্বা তখনও হাসপাতালে। তবে শারীরিক অবস্থার উন্নতি যা হয়েছিল তাতে বিছানায় বসে নিজহাতে খাবারটা খেতে পারছিলেন। ডাক্তার সাহেবরা বলেছেন; এখনই ছেড়ে দেয়া যায়, তবে আরও দুই অথবা তিন দিন অবজার্ভেশনে থেকে গেলে ভালো হয়। বিশেষ আন্তরিকতায় আব্বাকে সেবা দিয়ে যাওয়া দারুণ বন্ধুবৎসল ডা: শাকুর খান আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, আপনি এখন নিশ্চিন্তে উড়াল দিতে পারেন। তারপরও আব্বাকে হাসপাতালের বিছানায় রেখে চলে আসতে মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু এই জগৎ সংসারে আমরা কতজন যে কতভাবে নিরুপায়!
গত বছর- মানে ২০২৩ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে আবার সুযোগ হলো বাবা মা'র কাছে ফেরার। তবে এই যেতে পারার কৃতিত্ব আমার নিজের চেয়ে বন্ধু কাজী মিয়ার অনেক বেশি। আমেরিকান রাজনীতিক কাম ব্যবসায়ী বন্ধুটি বাবা মা'র মাইগ্রেশনের সূত্রে বেশ ছোটবেলায় দেশ ছেড়েছিল। দেশের সঙ্গে শৈশবের খুব বেশি স্মৃতি তার নেই। তবু আজকাল শেকড়ের সঙ্গে অজ্ঞাত এক টান পেয়ে বসেছে তাকে। বছরে কয়েকবার ছুটে আসে সুনামগঞ্জ-ছাতকে বাপ দাদার ভিটেমাটিতে।
নিউ ইয়র্কে আমার সবচেয়ে কাছের ভাই-বন্ধু বেলাল কয়েক সপ্তাহ ধরেই দেশে অবস্থান করছিল। হঠাৎ কাজী'র প্রস্তাব; এক সপ্তাহের ঝটিকা সফর, ঢাকা-মেহেরপুর-সিলেট-সুনামগঞ্জ। এমন আরাধ্য প্রস্তাবে দ্বিতীয়বার না ভেবে মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। আমি নিউ ইয়র্ক থেকে আর কাজী আটলান্টা থেকে ঢাকার উদ্দেশে উড়াল দিই। সিলেটে থাকা বেলালও দ্রুত হাজির ঢাকায়। আমরা সন্ধ্যায় নেমে রাতটুকু কাটিয়েছিলাম স্মৃতিময় এই নগরে। পরদিন ভোরেই মেহেরপুরের পথে রওয়ানা। বন্ধু নোমান চৌধুরীর দেয়া বিলাসবহুল গাড়িতে ভ্রমণ বেশ আরামদায়ক ছিল। যদিও আবহাওয়ার মেজাজ ছিল প্রচণ্ড তিরিক্ষি। তাপমাত্রার ওঠানামা ছিল ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। জুমার দিন; চুয়াডাঙ্গা শহরে জুমার নামাজ আদায় করে ২৫-৩০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাই আব্বা-মা'র কাছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আবারও আমাকে পেয়ে কি যে খুশি হয়েছিলেন আব্বা তা লিখে বর্ণনা করা মুশকিল।
আগের বারের সঙ্গে এবারের পার্থক্য হলো; আব্বা বাড়িতে বসে সবার সঙ্গে গল্প করছিলেন। হঠাৎ হঠাৎ অ্যাজমাজনিত সমস্যা ছাড়া বড় কোনও শারীরিক জটিলতা ছিল না। আমাকে কাছে পেয়ে যথারীতি বেশ কিছুক্ষণ বুকে জডিয়ে ধরে রাখলেন। চোখেমুখে আনন্দের উচ্ছলতা। প্রচণ্ড গরমের হাঁসফাঁস অনুভূতি যেন মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেল!
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো; একদিকে মাত্র ৬ দিনের ট্রিপ, অন্যদিকে সিলেট-সুনামগঞ্জ-ঢাকায় আরও কিছু পরিকল্পনা। তাই আব্বা মা'র সঙ্গে খুব বেশি সময় থাকা হয়নি। মনের মধ্যে এমন একটা বিষয়ও কাজ করছিল যে, দেশে যেহেতু আসা-যাওয়া শুরু করেছি আবারও আসবো। আর আব্বার শরীরটাও এখন ভালোই। পরের বার এসে তাঁদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাবো।
কে জানতো যে, সেই কাঙ্খিত ‘পরের বার’ আর কখনও আসবে না এ জীবনে! মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে আব্বা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে মেহেরপুরের এক ছোট হাসপাতালে কয়েকদিন। তেমন কোনও উন্নতি হচ্ছিল না। তাই ঢাকায় স্থানান্তর করা হলো। তবে তাঁর সেই অবস্থাটাকে মুমূর্ষু বলা চলে না কিছুতেই। ঢাকায় গিয়ে প্রথম রাতটা বাসাতেই ছিলেন। তাঁর হার্নিয়া অপারেশন দরকার ছিল। সে জন্য ধানমন্ডিতে ডা: সাইফুল ইসলাম ভাইয়ের ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু প্রচণ্ড কাশির কারণে শরীর অপারেশনের জন্য উপযুক্ত ছিল না। তাই কাশি-অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে আনবার জন্য নিয়ে ভর্তি করা হলো আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে; ডা: শাকুর খানের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু কী কারণে যেন শাকুর ভাই এবার নিজে ততোটা সময় দিতে পারেননি! বেশিরভাগ সময় টেলিফোনে জুনিয়র ডাক্তারদের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়েছেন এবং চিকিৎসার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। অথচ আগেরবার আব্বা অন্য হাসপাতালে, অর্থাৎ ইবনে সিনায় ভর্তি থাকার সময় শাকুর ভাই আনোয়ার খান হাসপাতালে নিজের রোগী দেখা এবং অন্যান্য দায়িত্ব পালনের ব্যস্ততার ভিতরও নিয়মিত প্রতিদিন গিয়ে আব্বাকে দেখে এসেছেন এবং নিবিড়ভাবে চিকিৎসার তত্ত্বাবধান করেছেন। যাইহোক এবার হয়তো তাঁর এমন কোনও ঝামেলা ছিল যেটা পরিহার করা সম্ভব হয়নি।
তবে বড় ভাই, ফেরেশতাতূল্য মানুষ প্রফেসর ডা: সাইফুল ইসলাম নিজের সীমাহীন ব্যস্ততার মধ্যেও প্রায় প্রতিদিন নিয়মিত আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যালে এসে আব্বার অবস্থা দেখে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ডা: মাসুম দিনে অন্ততঃ একবার এসে দেখে গেছে। কিন্তু সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ রাত থেকে আব্বার অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে লাগলো। জরুরি ভিত্তিতে আইসিইউতে নেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু ওই হাসপাতালে কোনও আইসিইউ খালি ছিল না। ১৪ সেপ্টেম্বর সকালে ডা: শাকুর খানকে বিষয়টি টেলিফোনে জানানো হলে তিনি যেখানে আইসিইউ পাওয়া যায় সেখানে স্থানান্তরের উপদেশ দেন। এ অবস্থায় ডা: সাইফুল ইসলাম ভাই এবং মাসুম খুব দ্রুত আব্বার কেবিনে এসে হাজির হন। মাসুম একটার পর একটা ফোনকল করতে থাকে আইসিইউর সন্ধানে। এক পর্যায়ে জানা যায় যে পান্থপথে নতুন চালু হওয়া ধানমন্ডি জেনারেল হাসপাতালে একটা আইসিইউ খালি আছে। হাসপাতালটির মালিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে মাসুম দ্রুতই সেই আইসিইউ বুক করলো। আব্বাকে দ্রুত সেখানে স্থানান্তরের জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডাকার কাজটিও করে সে। প্রচণ্ড নাজুক শারীরিক অবস্থার মধ্যেই আব্বাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। সেটাই ছিল শেষ চেষ্টা। তাজুল, সিরাজ এবং বড় ভাই ছিলেন অ্যাম্বুলেন্সে আব্বার বিদায় মুহূর্তের সঙ্গী।
জরুরি একটা কাজে নিউ ইয়র্ক থেকে পেনসিলভেনিয়ার গ্রিন টাউনে যাচ্ছিলাম গাড়ি চালিয়ে। বাসা থেকে রওয়ানা দেয়ার পর কখনও বড় ভাই, কখনও মাসুম, সিরাজ, নাজমুল কিংবা তাজুলের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই গাড়ি চালাচ্ছিলাম। এটা অনুচিত এবং এভাবে গাড়ি চালানো মোটেও নিরাপদ নয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে মনটা বেশ অস্থির ছিল। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গেই যেন ভয়ঙ্কর কোনও আশঙ্কার আনাগোনা।
বড় ভাই জানালেন- বড় একটা ভুল হয়ে গেছে। অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। এটা আগেই খেয়াল করা দরকার ছিল। যখন অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়লো তখন আর কিছুই করার নেই। ভীতি জাগানিয়া সাইরেন বাজিয়ে ছুটতে থাকলো অ্যাম্বুলেন্সে। মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। কিন্তু তাজুল, সিরাজ ও বড় ভাইয়ের কাছে সেই সময়টুকুকে হয়তো মনে হয়েছিল কয়েক ঘন্টা কিংবা তারচেয়েও বেশি।
নাজমুল আগেই গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ধানমন্ডি জেনারেল হাসপাতালের সামনে। তার সঙ্গে টেলিফোনে ছিলাম। অ্যাম্বুলেন্সটা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই সে দৌড়ে গিয়ে কী দেখলো বুঝতে পারিনি। শুধু মনে হচ্ছিল তার কথাগুলো এলোমেলো এবং অসংলগ্ন। বড় ভাই, সিরাজ ও তাজুল ফোন ধরছিল না কিছুতেই। নাজমুলের লাইন কেটে দিয়ে দ্রুত ফোন করলাম মাসুমকে।
মাথার ওপরের আসমানটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ তার মুখ থেকেই জানলাম। অক্সিজেনবিহীন সেই অ্যাম্বুলেন্সেই মহাকালের পথে নিজের চিরকালীন যাত্রা শুরু করেন আব্বা। খবরটা শুনে প্রথমে মনে হচ্ছিল আমি স্বপ্নের মধ্যে গাড়ি চালানো অবস্থায় একটা দুঃস্বপ্ন দেখলাম মাত্র। এর আগেও এমন খারাপ স্বপ্ন বেশ কয়েকবার দেখেছিলাম। এবারও হয়তো সে রকম কিছু। কিন্তু এমন ভাবনা তো এসেছিল মনের ভেতরকার চাওয়া থেকে। দুঃস্বপ্নের সিঁড়ি বেয়েই একদিন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবতার রূঢ় রুপ আমরা দেখি, নিরুপায় হয়ে মেনে নিই, মানিয়ে নিই।
বিশেষ বাস্তবতায় লম্বা সময় ধরেই যেহেতু দূরদেশে অবস্থান করছিলাম; তাই আব্বার চিরপ্রস্থানের মুহূর্তে তাঁর কাছে থাকতে না পারার দুর্ভাগ্য আমার বেলায় হয়তো পূর্বানুমিতই ছিল। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুর্ভাগা হলো কনিষ্ঠতম ভাই খোকন। আমার দেশান্তরের পর থেকে আব্বা মা'র চিকিৎসা এবং খেদমতে মূল ভূমিকায় ছিল সে। কতদিন কতরাত যে অসুস্থ বাবার পাশে একাকি নির্ঘুম কাটিয়েছে খোকন তার কোনও হিসাব নেই। পৃথিবীর এক নম্বর ট্রাফিক জ্যামের শহরে আব্বাকে নিয়ে হসপিটাল থেকে হসপিটালে, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মাকে নিয়ে ডাক্তার, ওষুধের দোকান- এসবের পেছনে গত ১০ বছরে হাজারো ঘন্টা সময় দিয়ে শেষ পর্যন্ত আব্বার বিদায় মুহূর্তে কাছে থাকতে না পারার বেদনা যে ও কিভাবে বয়ে বেড়াচ্ছে তা আল্লাহই ভালো জানেন।
এই বিক্ষিপ্ত দিনপঞ্জি লেখা যখন শেষ করছি তখন সময়টা ১২ জুন পেরিয়ে ১৩ তারিখ সন্ধ্যা। আমার ফ্লাইট ঢাকায় অবতরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আল্লাহ চান তো কিছুক্ষণের মধ্যে নাজমুল এবং খোকনের সঙ্গে দেখা হবে। মনে হচ্ছে ঢাকা বিমানবন্দর দুঃখের এক মহাসমুদ্র হয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ক'ঘন্টা পর আমার জোড়হারা মা'র সঙ্গেও হয়তো দেখা হবে। অন্যসব ভাইবোনও থাকবে সেখানে। শুধু আর কোনওদিন দেখা হবে না আব্বার সঙ্গে। যে বাড়িতে আব্বা কাটিয়ে গেছেন তার জীবনের বেশিরভাগ সময় সেখানে গিয়ে তাঁর দেখা মিলবে না- এটা ভাবতেই সীমাহীন হাহাকার একইসঙ্গে একদিকে আমার দু'চোখজুড়ে বাঁধভাঙা জোয়ার বইয়ে দেয়, অন্যদিকে গলাটাকে শুকিয়ে মরুভূমি বানিয়ে দেয়। তবু আব্বাহীন এই পৃথিবীতে এমন হাহাকারকেই আমি এখন সবচেয়ে ভালোবাসি। এরমধ্য দিয়েই আব্বার অস্তিত্ব প্রতিমুহূর্তে অনুভব করতে চাই। তাঁর জন্য অনেক কাঁদতে চাই। সারাক্ষণই উচ্চারণ করতে চাই- রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানী সাগীরা।
পাঠকের মতামত
রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানী সাগীরা।
আল্লাহ আপনার আব্বাজানকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন এবং আম্মাজানকে সুস্থতার সাথে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন।
Dear MH Bhai . . . Thanks for reminding my all those days . . . Used to come Dhaka for 4/5 days and again flying for work commitments and again travel to Dhaka. Again and again and again. My beloved Papa gone. All NRB,s are really beholdened to time. Time is so cruel. Oh those cruel time ! At least we get peace to say - রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানী সাগীরা। AS (Sydney).
রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানী সাগীরা।