ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

অনলাইন

দিনমজুর থেকে কোটিপতি

আমিরজাদা চৌধুরী, বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে

(১ বছর আগে) ১৬ আগস্ট ২০২২, মঙ্গলবার, ৩:১০ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১০:৩৯ পূর্বাহ্ন

mzamin

মাদক ব্যবসা করে গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি, হয়েছেন বিশাল সম্পদের মালিক। সেই মাদক সম্রাট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণপুর গ্রামের জালাল মিয়া (৫২) মাদকসহ আটকের পর এখন রয়েছেন কারাগারে।  

বিজয়নগর উপজেলার শীর্ষ এই মাদক কারবারি ও তার আরো চার অংশীদারকে গত ৩০শে জুলাই রাতে ৪৫ লাখ টাকা মূল্যের মাদকসহ আটক করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মাদক বিরোধী টাস্কফোর্সের সদস্যরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মিজানুর রহমান জানান, মাদকের ব্যবসা করে বাড়ি-গাড়ি ও বিশাল সম্পত্তির মালিক হওয়া জালাল এক সময় দিনমজুর ছিলেন। তার প্রকৃত বাড়ি বিজয়নগরের পার্শ্ববর্তী হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার মনতলা গ্রামে। অনুমান আট বছর বয়সে জালালের মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এরপর রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিজয়নগরের কালাছড়া গ্রামে আশ্রয় নেয়। সেখানে মানুষের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এভাবে প্রায় তিন বছর যাওয়ার পর কালো পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে জালাল।

জালালের বরাত দিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা জানান, একেবারে ভারত সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম কালাছড়ার অনেকেই বহুবছর আগে থেকে সীমান্ত এপার-ওপার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আশির দশকে ওই গ্রামের এক চোরাচালানি চিনি ও শাড়ি পাচার করতে শ্রমিক হিসেবে জালালকে বেছে নেয়। এভাবে কয়েক বছর যাওয়ার পর অধিক মুনাফার লোভে জালাল নিজেই মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

বিজ্ঞাপন
এরই মধ্যে যুবক হয়ে ওঠা জালাল ওই এলাকার প্রভাবশালী ইউপি সদস্য ও চোরাকারবারি হানিফ মিয়ার শ্যালিকাকে বিয়ে করেন। এরপর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি জালালকে। 

এই কর্মকর্তা আরো জানান, সেই টোকাই জালাল এখন কালাছড়ার পার্শ্ববর্তী বিষ্ণুপুর রানওয়ে বাজার সংলগ্ন এলাকায় জমি কিনে দৃষ্টিনন্দন দ্বিতল ভবন গড়ে তুলেছেন। এছাড়াও কালাছড়া গ্রামে তিনি পাকা ভবন তৈরি করেছেন। বিষ্ণুপুরের বাড়ি সংলগ্ন বাজারে কয়েকটি দোকানও রয়েছে তার। ইতিমধ্যে চারটি বিয়ে করেছেন তিনি। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আখাউড়ায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন। একই উপজেলার আজমপুর গ্রামে তৃতীয় বিয়ে করেন। বিষ্ণুপুর গ্রামে চতুর্থ বিয়ে করে সেখানকার দোতলা ভবনে সেই স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন তিনি। এর মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্ত্রী'র সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তার। চার মেয়ে ও দুই ছেলে সন্তানের জনক জালাল।

মাদকবিরোধী টাস্কফোর্সের অভিযানে জালালের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনসহ পলাতক আরো পাঁচজনের নামে বিজয়নগর থানায় মামলা দায়ের করা হয়। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. রেজাউল করিম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়, কালাছড়া গ্রামের হান্নান মিয়ার দোকানের পশ্চিম পাশের কাঁচা রাস্তার উপর থেকে ১০০ কেজি গাঁজা, ১৬৯৭ পিস ইয়াবা এবং ৭১০ বোতল ফেন্সিডিল ও এস্কফ উদ্ধার করা হয়। 

একই উপজেলার সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের কাশিনগর গ্রামের আরেক কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম (৫৫) এর বাড়িতেও রয়েছে আলিশান দোতলা ভবন। প্রায় ২০ বছর পূর্বে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের আগে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে মাদক পাচারকালে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করেন। সেই গুলি তার বাম হাতে বিদ্ধ হওয়ার পর তিনি এলাকা থেকে পালিয়ে অন্যত্র গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। কিন্তু কয়েক বছর প্রবাসে থেকে ফের দেশে এসে তার বড় ছেলে জুয়েলকে নিয়ে পুরোদমে আগের পেশায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। গ্রামের বাড়িতে খুচরা মাদকের স্পট পরিচালনা করে এবং রাজধানীসহ সারাদেশে বড় বড় মাদকের চালান পাঠিয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই কোটিপতি বনে যান তিনি। 

কুখ্যাত এই মাদক ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীরকে ধরতে গত ১১ই আগস্ট বৃহস্পতিবার তার বাড়িতে অভিযান চালায় র‌্যাব-১৪, ভৈরব ক্যাম্পের সদস্যরা। অভিযানে মাটিতে পুঁতে রাখা অবস্থায় ২১৩ বোতল এস্কফ উদ্ধারসহ তার তিন সহযোগী আমজাদ হোসেন, মাসুম মিয়া ও মো. আকিবকে আটক করেন। এসময় জাহাঙ্গীর ও তার ছেলে জুয়েল দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরদিন ১২ই আগস্ট র‌্যাবের কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে বিজয়নগর থানায় জাহাঙ্গীরসহ চারজনের নামে মামলা দায়ের করেন। 
মামলা দায়েরের দুদিন পর বিজয়নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শরিফুল ইসলাম কাশিনগর গ্রামে বাড়ির সামনে থেকে জাহাঙ্গীরকে আটক করে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠান। এর আগেও পার্শ্ববর্তী আখাউড়া থানায় তার নামে মাদক পাচারের একাধিক মামলা রয়েছে।

বিজয়নগরে মাদক ব্যবসার শীর্ষে যারা :
বিজয়নগরের সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের কাশিনগর গ্রামের হারুন, আলমগীর, মনির, আলাল, মিনার, কোশাই জসীম, ফারুক এবং একই ইউনিয়নের চাউড়া দৌলতবাড়ি গ্রামের শীর্ষ মাদক কারবারি রুবেল গ্রুপের জয়, মান্না, বুলু, শাকিব, আনিস, কাওসার, মাসুম, বিল্লাল ও মাসুদ সরাসরি মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত। একই ইউনিয়নের নলগড়িয়া গ্রামের আমান, ইউসুফ, নাসির, ফর-ইসলাম, তোতলা হাবির, আল-আমিন, জন্টু, দীনা, সেতু, রিতু, পারভেজ, বাছির, সেন্টু, তোফাজ্জল, ইকবাল খাঁ, জোবায়ের, খোকন এবং কাশিমপুর গ্রামের হাফিজুল, এনামুল, দুলাল, বিল্লাল, রিয়াদদ, বাবু, সাবেক নারী ইউপি সদস্য কাকলি মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। তাদের অনেকেই মাদকের মামলায় একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং কারাগারে ছিলেন। কিন্তু তারা ফিরে এসে আবারো পুরনো পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। 

সিঙ্গারবিলের পার্শ্ববর্তী বিষ্ণুপুর ইউনিয়নেও রয়েছে একাধিক কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী। এর মধ্যে বিষ্ণুপুরের জালালসহ স্থানীয় রানওয়ে বাজার এবং বিষ্ণুপুর বিজিবি ক্যাম্পের বিপরীত পাশের বাড়ির বাসিন্দা আনাস মিয়া, কাজল ভুঁইয়া, আলমগীর ভূঁইয়া, নুরুল হক, শিপন, রবিন ভূঁইয়া, মোনায়েম ভূঁইয়া, সাদ্দাম ভূঁইয়া পাইকারি মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। একই ইউনিয়নের কালাছড়া গ্রামের হরমুজ, ইয়াসিন, দুলাল, মোহন, আবু বক্কর, আবু তালেব, দিদার, হারুন, নাদিম, শাহআলম, মাসুম, ফিরোজ ও সবুজ দিব্যি মাদক এপার-ওপার করে যাচ্ছেন। 

বিষ্ণুপুরের উত্তর প্রান্তের তিনটি ইউনিয়ন যথাক্রমে পাহাড়পুর, হরষপুর ও চান্দুরা। এই তিন ইউনিয়নেও ধাপিয়ে বেড়াচ্ছে একাধিক মাদক ব্যবসায়ী। এর মধ্যে পাহাড়পুর ইউনিয়নের চাঁনপুর গ্রামের আব্দুল হক, সালাউদ্দিন মৃধা, মনি, শাহআলম, ইব্রাহিম, শান্ত, আবু জাহের, দেলোয়ার হোসেন দিলু, শানু, শফিক, সেন্টু, কামাল, খাটিঙ্গা গ্রামের নিজাম, সেজামোড়া গ্রামের কাউসার ভূঁইয়া, জাহাঙ্গীর, আলমগীর, ধোরানাল গ্রামের দুলাল খন্দকার ট্রাক, পিকআপ ও মাইক্রোবাস ভর্তি করে রাজধানীসহ সারাদেশে মাদক পাচার করে থাকেন। 

হরষপুর ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রামের মৃত আসকর আলীর ছেলে জাহাঙ্গীর, হোসেনপুরের রুহুল আমিন ওই এলাকার কুখ্যাত মাদক কারবারি। তারা বিভিন্ন খুচরা মাদক স্পটে মাদকের সরবরাহ করাসহ জেলা শহর এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাইকারি মাদক বিক্রি করেন। 

চান্দুরা ইউনিয়নের কালিসীমা, আলা-দাউদপুর ও জালালপুর গ্রাম যেন মাদকের স্বর্গরাজ্য। আলা-দাউদপুর গ্রামের আব্দুর রহিম, তার ছেলে শাহ আলম মাদকের কারবার করে বাড়িতে গড়ে তুলেছেন অট্টালিকা। একই গ্রামের জসিমও মাদক ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছেন। কালিসীমা গ্রামের আয়াত আলী, জুয়েল, সোহেল, মোরাদ ও সাদ্দাম মাদক ব্যবসা করে রাতারাতি ধনাঢ্য হয়েছেন। জালালপুর গ্রামের ফজলুর রহমান ও তার দুই ছেলে আক্তার হোসেন এবং আনোয়ার হোসেন, একই গ্রামের আলী হোসেন, নুরুল আমিন, রুবেল, শফিকুল ইসলাম, তোফাজ্জল হোসেন, ফজু মিয়া পাইকারি ও খুচরা মাদক বিক্রি করে বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। 

অবশ্য সিঙ্গারবিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া দাবি করেন, তার এলাকায় আগের তুলনায় মাদক পাচার কমেছে। তিনি একাধিকবার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, র‌্যাব ও বিজিবি কর্মকর্তাদের নিয়ে মাদকবিরোধী সমাবেশ করেছেন। বিভিন্ন সময় এলাকার একাধিক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীকে ভালো মানুষ হিসেবে প্রত্যয়ন দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো যারা বলছে তারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।’

বিজয়নগর উপজেলায় মাদক পাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাজু আহমেদ বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে বিজয়নগর থানার পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। গত কয়েকদিনে পুলিশের চারটি পৃথক অভিযানে প্রায় ১১৪ কেজি গাঁজা ও একটি প্রাইভেট কার উদ্ধার এবং জাহাঙ্গীরসহ তিনজনকে আটক করা হয়েছে। তিনি সবেমাত্র এই থানায় যোগদান করেছেন জানিয়ে বলেন, পুরো উপজেলার মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে এবং সেই তালিকা অনুযায়ী নিয়মিত অভিযান চলবে।
 

অনলাইন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

অনলাইন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status