অনলাইন
বিশ্ব যেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয়
লাকি করিম
(৬ ঘন্টা আগে) ২১ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার, ১২:৫১ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৫:৪৬ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী বসতি হিসেবে পরিচিত সেগুলোকে ময়লাযুক্ত, জনাকীর্ণ এবং বিপজ্জনক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমার জন্য এই ক্যাম্পগুলো ছয় বছরেরও বেশি সময় ছিল আমার একমাত্র আশ্রয়। ২০১৭ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে আমি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গণহত্যার হাত থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হই। আমি ক্যাম্পে থাকতাম দুই বছর আগে পর্যন্ত, যখন আমি গণহত্যার পর প্রথম দলে যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসিত রোহিঙ্গাদের একজন হিসেবে সুযোগ পাই।
গত মাসে আমি সেই প্রথম পুনর্বাসিত রোহিঙ্গা হিসেবে ক্যাম্পগুলোতে ফিরে যাই।
আমার আগের আশ্রয়স্থলের সামনে দাঁড়িয়ে দুই বছর পর প্রথমবারের মতো আমার দাদিকে জড়িয়ে ধরে আমি আবেগের এক জটিল মিশ্রণে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। একদিকে আমি কৃতজ্ঞ যে, আমার সম্প্রদায়ের পক্ষে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু অন্যদিকে আমি আশঙ্কা করছি, মানুষের মনোযোগ পাওয়া এখন আগের চেয়ে আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। তাই আমি চাই বিশ্ব যা জানুক, তা হলো—
আমার ক্যাম্পে ফিরে যাওয়া তিনটি বিষয়কে স্পষ্ট করেছে। প্রথমত, মানবিক সহায়তা কমে যাওয়া এক কোটি রোহিঙ্গা গণহত্যা-পরবর্তী জীবিত মানুষের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রভাব ফেলছে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা, জীবিকার সুযোগ ও নিরাপত্তার অভাব এই মানুষদের আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। এবং তৃতীয়ত, আমরা রোহিঙ্গারা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার এখনই পাওয়া উচিত।
আমি যখন দুই বছর আগে বাংলাদেশে ক্যাম্প থেকে বের হই, তখন থেকেই রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তা কমে যেতে থাকে, যার ফলে আমার সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা স্পষ্টভাবে বলেছে—যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সহায়তা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত ক্যাম্পজুড়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অন্তত পাঁচটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র শুধুমাত্র জরুরি চিকিৎসা প্রদান করছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রধান সেবা প্রদানকারী সংস্থাটি তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। শত শত স্বেচ্ছাসেবক, যারা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধ, বর্ষা প্রস্তুতি এবং গর্ভবতী নারীদের সহায়তার মতো কাজে নিয়োজিত ছিলেন, তারা কাজ হারিয়েছেন—যার মাধ্যমে তারা যতটুকু ভাতার সুযোগ পেতেন তা দিয়েই তাদের ন্যূনতম খাদ্য চাহিদা মেটানো হতো।
আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাই, সেদিনই বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ঘোষণা করে যে, ক্যাম্পে মাসিক খাদ্য রেশন অর্ধেকেরও বেশি কমিয়ে দেয়া হবে। আমরা জানি, অতীতের ছোট রেশন হ্রাসের অভিজ্ঞতা থেকেই এমন পদক্ষেপ অপুষ্টি বাড়িয়ে দেবে, শরণার্থীদের মানব পাচার বা বাল্যবিবাহের দিকে ঠেলে দেবে এবং প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর সংখ্যা বাড়াবে। অনেক সম্প্রদায়ের মানুষ জানিয়েছেন, তারা আতঙ্কে আছেন। মানবিক সহায়তায় নিযুক্ত কর্মীরা বলেছেন, মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বেড়েছে এবং তারা নিজেরাও এ নিয়ে অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
সৌভাগ্যবশত, শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় যে তারা ডব্লিউএফপি-র জন্য অর্থায়ন পুনর্বহাল করবে, যা রেশন শুধুমাত্র সামান্য পরিমাণে কমানোর সুযোগ দেবে। এই সিদ্ধান্ত অন্তত আপাতত বড় বিপর্যয় থেকে আমাদের রক্ষা করেছে।
দ্বিতীয়ত, যদিও আমি এবং আমার সম্প্রদায় বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ—তারা আমাদের প্রায় আট বছর ধরে আশ্রয় ও সহায়তা দিয়েছেন—তারপরও ক্যাম্পে অনেক বিধিনিষেধ আছে যা আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় আত্মনির্ভরতা অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জীবিকার সুযোগ না থাকায় রোহিঙ্গারা সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যা দিন দিন অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। শিক্ষা সুযোগের অভাব ভবিষ্যতে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার টেকসই পথকে দুর্বল করে দেবে এবং এতে অনেক রোহিঙ্গা যুবক অপরাধ বা সশস্ত্র গোষ্ঠীতে যুক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
তৃতীয়ত, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা বা পরিকল্পনায় আমাদের কণ্ঠ যথেষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। ক্যাম্পে যেসব রোহিঙ্গার সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তারা কেউই মনে করেন না যে তাদের কথা শোনা হচ্ছে — আলোচনায তো দূরের কথা। কেবল অল্প কয়েকজনকেই কথা বলার সুযোগ দেয়া হচ্ছে, আর যারা কথা বলছেন, তারা সশস্ত্র বেসরকারি গোষ্ঠীর হুমকির মুখে পড়ছেন।
তবে এইসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আমি কিছু সুযোগ দেখতে পাই। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে অনেক বেশি খোলামেলা। মিয়ানমারে এখনকার প্রেক্ষাপটে যেখানে একটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী 'আরাকান আর্মি' প্রায় পুরো রাখাইন রাজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং বাংলাদেশের সীমান্তে তৎপর রয়েছে, সেখান থেকে (যদিও এখনো অনিশ্চিতভাবে) নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিয়ে সংলাপের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এবং ক্যাম্পগুলোর সহিংসতা তুলনামূলকভাবে হ্রাস পাওয়ায় এখন রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া ও অর্থবহ প্রত্যাবর্তনের পদক্ষেপ শুরু করার জায়গা তৈরি হয়েছে।
চূড়ান্ত সমাধান অবশ্যই মিয়ানমারে নিহিত। প্রতিটি রোহিঙ্গা আপনাকে বলবে যে, তারা নিজেদের বাড়িতে ফিরতে চায় — তবে কেবল তখনই, যখন এটি নিরাপদ হবে। আরাকান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংলাপ অবশ্যই ফলপ্রসূ হতে পারে, তবে এটি রোহিঙ্গাদের মধ্যে যৌক্তিকভাবে গড়ে ওঠা অবিশ্বাস কাটিয়ে উঠতে সময় নেবে। নিরাপদ ও স্থায়ী প্রত্যাবর্তনের পর্যায়ে পৌঁছানো কঠিন হতে পারে, কিন্তু সেই পথ শুরু করাটা কঠিন হওয়া উচিত নয়।
আরাকান কর্তৃপক্ষ, যারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে আগ্রহী, তারা রাখাইন রাজ্যে এখনো অবস্থানরত কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গাকে — যাদের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত — নিজ নিজ আবাসস্থলে ফিরে যাওয়ার অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সদিচ্ছা দেখাতে পারে । তারা দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে সীমান্ত অতিক্রম করে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিতে পারে এবং যারা আরাকান আর্মির সদস্য হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পারে।
বাংলাদেশ, জাতিসংঘের সংস্থাগুলো ও আন্তর্জাতিক দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এই পথকে বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারে প্রত্যাবর্তনের যেকোনো উদ্যোগে তদারকি করে এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের আত্মনির্ভরতা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ সম্প্রসারিত করে। আর সবচেয়ে জরুরি হলো, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক সহায়তা যেন অব্যাহত থাকে।
সবশেষে, রোহিঙ্গাদের অবশ্যই তাদের ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত করতে হবে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি বৈশ্বিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে — এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। তবে প্রকৃত অংশগ্রহণ মানে হলো-সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অর্থবহভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা ও নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন নিয়ে আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা। এর মানে হবে ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা — কেবল নির্বাচিত কয়েকজন নয় — যেন নির্ভয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং তাদের কণ্ঠ যেন শোনা হয়। এর মানে রাখাইন রাজ্যে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা যেন নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যে ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত পায়। এর মানে হবে, প্রবাসে অবস্থানকারী আমার মতো ব্যক্তিদের এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া চালিয়ে যেতে হবে।
আমি কেবল আশা করি, এই বার্তাটি যেন শোনা হয়।
-লাকি করিম, একজন রোহিঙ্গান-আমেরিকান, তার এ লেখাটি ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিন থেকে অনূদিত।