নির্বাচিত কলাম
চলতি পথে
সুসেবা চাই সদ্ব্যবহারও চাই
শুভ কিবরিয়া
১ জুলাই ২০২২, শুক্রবারপ্রশ্ন হলো রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান কীভাবে জনবান্ধব হয়ে উঠবে, জনসেবা দিয়ে জনতুষ্টি অর্জন করবে? এ প্রশ্নের সমাধান আছে, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার মধ্যে। কেননা প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে জনতান্ত্রিক হবার গুণসমূহ বিরাজমান। রাষ্ট্র যদি গণতন্ত্রের মৌলিক শর্তসমূহ সুবিন্যস্ত করে, সুচারুরূপে পালন করে, কেবল তখনই প্রকৃত জনমত, গণমত প্রকাশের নির্ভয় ব্যবস্থা জারি থাকে। জনপছন্দের সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার ভার নেয়ার বিধি-ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়।
একবার উত্তরবঙ্গ থেকে এলেন আমাদের এক আত্মীয় ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে। তার শরীরের উপসর্গ শুনে স্থানীয় চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানোর। নিয়ে যাওয়া হলো একজন নামি হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। ভদ্রলোক খুবই নামকরা ডাক্তার। সে সময় জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের পরিচালকও হয়েছিলেন। সরকারের স্বাস্থ্য উপমন্ত্রীও ছিলেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই ডাক্তারের অ্যাপয়নমেন্ট পাওয়া গেল।
তখনও এদেশে হৃদরোগের চিকিৎসা এতোটা বিস্তার লাভ করে নাই, এতোটা সহজলভ্যও হয়ে ওঠে নাই। ফলে, রোগী ভীষণ বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। ডাক্তার সেটা বুঝলেন। একনাগাড়ে বলে চললেন, শোনেন চিন্তা করবেন না। ওষুধ খাবেন, নিয়ম মেনে চলবেন। দুশ্চিন্তা করলে আরও ক্ষতি হবে। ডাক্তারের কথা শুনে রোগী মৃদু স্বরে বলে উঠলেন, ‘চিন্তা করে দুশ্চিন্তা ঠেকাবো কেমন করে’!। ডাক্তার সাহেব অবশ্য ততক্ষণে পরের রোগীর প্রতি মনোনিবেশ করেছেন। রোগীকে নানান সান্ত্বনা দিতে দিতে বাসায় নিয়ে এলাম। কিন্তু ডাক্তারের এই কথার পর রোগীর বিষণ্নতা আরও বেড়ে গেল। এ ঘটনা বহু বছর আগের কথা। কিন্তু আমার স্মৃতিতে ডাক্তারের সেই উচ্চারণ, বলার ভঙ্গি, আর রোগীর অসহায়ত্ব এখনো চোখে ভাসছে। আমার এখনো মনে হয়, ডাক্তার সাহেব ওই রোগীর সঙ্গে যদি আরেকটু সফ্ট হতেন, আরেকটু সহমর্মিতা নিয়ে কথা বলতেন, আরেকটু ভরসা দিতেন, তাহলে বোধ হয় রোগীর জন্য সবদিক থেকেই ভালো হতো। বছর দশেক পরের ঘটনা। হঠাৎ করে আমাদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মায়োকার্ডিয়াক অ্যাটাক হলো। ভীষণ বুকে ব্যথা। দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলো।
পান্থপথ এলাকায় তখন তৈরি হয়ে গেছে এক অভিজাত বেসরকারি হাসপাতাল। খুবই তার নামডাক। সুদৃশ্য হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে হাজির হলাম। আমাদের তখন ভূতে পাওয়ার দশা। কী করি, কোথায় যাই, নানারকম ওলটপালট চিন্তা। ফোন দিলাম বিশিষ্ট হৃদরোগ চিকিৎসক বরেণ চক্রবর্তীকে। তিনিও খুব দ্রুত কথা বলেন। ফোনে দ্রুততার সঙ্গে বলে চললেন, শোনেন, রোগীকে এখন কোথাও সরানো যাবে না। ওখানেই চিকিৎসা করান। বাহাত্তর ঘণ্টা অবজারভেশনে রাখতে হবে। যাহোক, ঈশ্বর বরেণ চক্রবর্তীর মঙ্গল করুন। তাঁর পরামর্শ খুবই সঠিক ছিল। পরে আমাদের বন্ধুর হার্টে ব্লক ধরা পড়লো। কিন্তু যে খ্যাতিমান ডাক্তারের অধীনে তার চিকিৎসা, তিনি এতটাই রাশভারি এবং মুডি যে, তার সঙ্গে কথাই বলা যায় না। রোগীর আত্মীয়- স্বজনরা তার কাছে চিকিৎসা করাতে ভরসা পেলেন না। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে, বহু তদ্বির করে সেখানে একজন পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তির আত্মীয় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হলো। তার হাতেই রিং পরতে হলো, মানে স্টেনটিং করানো হলো। বেশ ভালোভাবেই রিং পরানোর কাজটি সম্পন্ন হলো। রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়লেন।
ফলোআপ চিকিৎসার জন্য যখন আবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া হলো, তখন দেখা গেল এ ডাক্তার ভীষণ বকাবকি করেন। কথায় কথায় রোগীকে ধমকান। রোগীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন। রোগীর পক্ষে এ অপমান সহ্য করা সম্ভব হলো না। অসহ্য হয়ে পরে অন্য হাসপাতালে ভালো ব্যবহার করেন এ রকম একজন খ্যাতিমান চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হলো। এ দুই অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা পেলাম নিজের ক্ষেত্রে। তখন করোনার ভরা মৌসুম। মানুষ মানুষকে সশরীরে এড়িয়ে চলছে। এ রকম কঠিনতম সময়ে প্রাতঃভ্রমণে হাঁটতে যেয়ে বুকের মধ্যে একটা কষ্টকর ব্যথা অনুভব করলাম, বাধা পেলাম স্বাভাবিক হাঁটায়। বুকের মধ্যে এমন এক ধরনের অস্বস্তি টের পেলাম যা ঠিক ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। যা হোক নানারকম ডাক্তারের হাত ঘুরে এনজিওগ্রামের জন্য পৌঁছুলাম ঢাকার মিরপুরের হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে। করোনায় তখন এ হাসপাতালের বহু, ডাক্তার-নার্স আক্রান্ত হচ্ছেন। সে এক বিভীষিকাময় অবস্থা। এনজিওগ্রামের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের পুরো পরিবারের জন্য এলো এক ভয়ানক দুঃসংবাদ। জানা গেল আমার হার্টে অনেকগুলো ব্লক আছে, বাইপাস সার্জারি ছাড়া বিকল্প চিকিৎসা নেই। করোনার কারণে তখন ভিন্ন কোনো হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে ছোটার উপায় নেই।
শরীরও পারমিট করবে না। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হলো বাইপাস সার্জারি করার। আমি তখনো করোনারি কেয়ার ইউনিট বা সিসিইউতে আধো ঘুমে আধো জাগরণে। করোনারি কেয়ার ইউনিটে আমাকে নেয়ার ঘণ্টা খানিকের মধ্যে বিকট চিৎকার আর ডাক্তার-নার্সদের ছোটোছুটির মধ্যে ওই ইউনিটে থাকা আমার বেডের কাছাকাছি দু’বেডে দু’জন রোগী মারা গেলেন। আধো ঘুমন্ত অবস্থাতেই শুনতে পাচ্ছি স্বজনদের কান্না। সে এক ভয়াল অভিজ্ঞতা। চোখ বন্ধ করে, ভাবনাগুলোকে কোনোরকমে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে, চিন্তায় শূন্যতা এনে নিজেকে সকল বিপদ আর ভয় থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করছি। এমন সময় টের পেলাম আমার বেডের চারপাশে কথার শব্দ। শুধু শুনলাম ‘বড় স্যার আসছেন’। কে বড় স্যার, কোথাকার বড় স্যার, কেনই বা বড় স্যার কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাবতেও পারছি না। এমন সময় আমার বেডের কাছে এলেন এক ভদ্রলোক। তন্দ্রালু চোখে, শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা সয়ে, শুনলাম, ভদ্রলোক বলছেন, আমার নাম ফারুক আহমদ। আমি এই হাসপাতালের চিফ কার্ডিয়াক সার্জন। আপনার বাইপাস সার্জারি করতে হবে। আপনি সম্মতি দিলে আমিই এ কাজটি করবো।
বহুবছর ধরে আমি হার্টের বাইপাস সার্জারি করি। লোকজনও আমার কাছে করায়। সাধারণ হিসেবে সাকসেস রেট ৯৫%। বাকি আল্লাহ্র ইচ্ছা। এখন আপনি যদি রাজি থাকেন, তাহলে আমার দু’টো শর্ত আছে। প্রথমত, আপনাকে শারীরিকভাবে ফিট হতে হবে। যতদিন ফিট না হবেন ততদিন অপারেশন করবো না। আর অপারেশন করার পর ক’দিন আমরা যে নিয়ম পালন করতে বলবো কষ্ট হলেও তা করতে হবে। এ দু’শর্ত মানলেই কেবল আপনার অপারেশন করাবো। এত মৃদু স্বরে, এতো মমতাভরা কণ্ঠে, এতো সুন্দর করে কথাগুলো বললেন, ডাক্তার সাহেব। কিছুক্ষণ আগের মৃত্যুভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থা কেটে গেল। ওই বিপদাপন্ন অবস্থায় আমার মনে হলো, ঈশ্বর আমার জন্যই দেবদূত পাঠিয়ে দিয়েছেন, ডাক্তারের বেশে। এ অনুভূতি আমি কখনো ভুলি নাই। অপারেশন সফল হলো। আইসিইউতে জ্ঞান ফেরার পর আবার তার নরম স্বর, আর মমত্বমাখা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আইসিইউ’র ভীতিকর-কষ্টকর-যন্ত্রণাদায়ক এক জটিল-কঠিন অবস্থায় ডাক্তারের এ রকম ভালোবাসাঘেরা সহৃদয় ব্যবহার যে কী ভরসা দেয়, সাহস দেয়, শক্তি জোগায় মনে-তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না।
তখন ডাক্তারকেই মনে হয় পরিত্রাতা! করোনা তখন বাড়ছে। একদিন শুনলাম আমার সেই চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। জানতে পারলাম তাকেও আইসিইউতে নিতে হয়েছে। আমি তখন একটু একটু করে সুস্থ হচ্ছি। হাসপাতালের বেডে শুয়ে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি তিনি যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন। যাহোক একটা ভালো লড়াই চালিয়ে সেই ডাক্তার সাহেব সুস্থ হলেন। পরে তার সঙ্গে চিকিৎসাজনিত কারণে যতবার দেখা করেছি আমার সকল উৎকণ্ঠা স্বস্তিতে বয়ে নিয়ে ফিরে এসেছি, তার সুচিকিৎসা ও সুব্যবহারের কারণে। আজ এসব ঘটনা লিখলাম কারণ, আমরা সব জায়গাতেই এই ভরসার জায়গা পেতে চাই। ডাক্তারের কাছে গেলে যেমন সুচিকিৎসা নিয়ে ফিরতে চাই, তেমনি সদ্ব্যবহারও চাই। কেননা চিকিৎসা শুধু শারীরিক নয়, ওটা মনেরও ব্যাপার। ফলে একজন চিকিৎসকের ভালো ব্যবহার, তার সহৃদয়তা, রোগীর মনে ভরসা দেয় যা তার শরীরের রোগ নিরাময়কেই সহায়তা করে। ডাক্তার আর রোগীকে আলোচনায় আনলাম মেটাফোর হিসেবে, রূপক হিসেবে। আমরা আসলে সবার কাছেই এ রকম সুব্যবহার চাই, সুসেবাও চাই। নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রেরও কাছে আমরা চাই রাষ্ট্র আমাদের ধমকাবে না, চমকাবে না, সে আমাদের বন্ধু হবে, আমাদের সু-সেবা দেবে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা, প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের ওপর জুলুম করবে না, আমাদের নিম্নমানের সেবাও দেবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান কীভাবে জনবান্ধব হয়ে উঠবে, জনসেবা দিয়ে জনতুষ্টি অর্জন করবে? এ প্রশ্নের সমাধান আছে, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার মধ্যে।
কেননা প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে জনতান্ত্রিক হবার গুণসমূহ বিরাজমান। রাষ্ট্র যদি গণতন্ত্রের মৌলিক শর্তসমূহ সুবিন্যস্ত করে, সুচারুরূপে পালন করে, কেবল তখনই প্রকৃত জনমত, গণমত প্রকাশের নির্ভয় ব্যবস্থা জারি থাকে। জনপছন্দের সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার ভার নেয়ার বিধি-ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়। তার ফলে, জনরায় পাওয়া সরকারও তার কাজের জন্য জনভয়ে অস্থির থাকে। সে সুসেবা তো বটেই সদ্ব্যবহার দিতেও ব্যস্ত থাকে। কেননা সে জানে ভালো সার্ভিস ডেলিভারি দেবার পরও অমার্জিত ব্যবহারের কারণে জনমনের না-পছন্দ তাকে বিপদে ফেলতে পারে। সম্ভবত গণতন্ত্রের সেটাই সবচাইতে সুন্দর ও কারুময় রূপ। এজন্যই সকল বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে, বন্ধুর পথ মাড়িয়ে জনগণ সেই গণতান্ত্রিক পথেই হাঁটতে চায়। কেননা আমজনতা রাষ্ট্রকে শুধু আপনই ভাবতে চায় না, তাকে জবাবদিহিতার মধ্যেও রাখতে চায়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]