নির্বাচিত কলাম
সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ
অর্থনীতির দুঃসংবাদ
টুটুল রহমান
১ জুন ২০২৫, রবিবার
ড. দেবপ্রিয় বলছেন, আমি আরেকটি উদাহরণ দেই, এই যে স্টক মার্কেটের জীর্ণদশা। এটা আসলেই মৃতপ্রায়। ওটা আইসিইউ’র ভেতরে। ছিল ২৭ শতাংশ, কিন্তু এখনো জিডিপি’র ভ্যালু হিসাবে আছে ৯ শতাংশ। এটাকে চালু করার জন্য যে সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, তাহলে স্টক মার্কেটে যারা অংশীদার রয়েছেন, তাদের সঙ্গে যদি আলোচনা না করে সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন একা করতে যায়, তাহলে কোনোদিনই সম্ভব না। মানুষের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে ঠিক কাজও বেঠিক হয়ে যায় যদি আলাপ আলোচনা উন্মুক্ত না থাকে। এটা আমার প্রথম বক্তব্য আপনার কাছে। আলাপ-আলোচনা করতে হবে এবং সবাইকে সুযোগ দিতে হবে। কী পরিবর্তন করলাম একটা স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর থেকে।
অর্থনীতির দুঃসংবাদ আমাদের দেশে পশ্চিমা দেশগুলো থেকেই আসতে থাকে। কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যখন শুল্কনীতি ঘোষণা করলেন যখন অভিঘাতে আমাদের অর্থথনীতির কি কি ক্ষতি হতে পারে সেটা অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ীরা আলাপ-আলোচনা করলেন। অনেক পথ খোঁজার চেষ্টা করা হলো। শুল্কনীতি স্থগিত আছে। আপাতত বাঁচা গেল। তারপর বাতিল হলো ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা, স্থলবন্দর ব্যবহার ইত্যাদি ইত্যাদি। রপ্তানিকারকরা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। নানা পথ খোঁজা হচ্ছে। আপাতত সমাধান মেলেনি। রপ্তানির বিশাল বাজার হাজারোর শঙ্কার মধ্যে দিন কেটে যাচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ একেবারেই নেই গত দশ মাসে। যাও এসেছে ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিশ্বব্যাংক আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাষ দিয়েছে তাতে কমিয়ে ৩ দশমিক ৯৭ করা হয়েছে। ভাবা যায় আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে চলে গিয়েছিল। না। এখন কোনো রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় নেই। বাড়িয়ে বলার সুযোগ নেই। কেউ বলছেও না। জাতিসংঘ তো বলে দিলো বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা আসছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে সেই ধাক্কা সামাল দিতে পারবে তো বাংলাদেশ?
দেশের ব্যবসায়ী মহল, অর্থনীতিবিদের কথায় সোজাসাপ্টা যা বুঝতে পারছি সমাল দেয়া কঠিন হবে। অর্থনীতি যদি তার গতি না পাল্টায়, দশ মাস আগে যে সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল সেগুলো যদি বাস্তবায়ন না হয়। সব চেয়ে বড় কথা একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যদি না হয় তাহলে অর্থনীতি চরম বিপদে পড়বে। দেশের মানুষ তো বটেই।
গত কয়েক দিন আগে ব্যবসায়ীদের যৌথ সংবাদ সম্মেলন ও একটি বাজেট নিয়ে আয়োজিত সেমিনারের কথাবার্তা খেয়াল করছিলাম। আগামীর বাজেট নিয়ে আয়োজিত আলোচনায় ড. দেবপ্রিয় বললেন, ‘বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ২৭ লাখের বেশি মানুষ আরও বেশি দরিদ্র হয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৮ লাখ নারী।’
একবার ভাবতে পারেন কী ভয়ংকর কথা? এই বিপুল পরিমাণ দরিদ্র মানুষ এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? অর্থনীতিতে এর প্রভাবটা চিন্তা করতে পারেন?
ড. দেবপ্রিয় আরও বলেছেন, বর্তমান সরকারের সময়ে এতগুলো সংস্কারের কর্মসূচি হয়েছে, এত সংস্কারের পথরেখা চান, নির্বাচনের পথরেখা চায়, বিচারের পথরেখা চায়। আমি জিজ্ঞেস করি, আমার অর্থনীতির পথরেখা কোথায়? সরকার বদল হলেও প্রক্রিয়া বদল হলো না। কিন্তু অর্থনীতির পরিকল্পনা কোথায়?
তাহলে তার কথায় অথনীতির পরিকল্পনা ছাড়াই কী সরকার এগুচ্ছে? তাহলে তো আমরা ভয়ানক এক অন্ধকারে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেয়ারবাজার নিয়ে আলোচনা তো কম হয়নি। সেখানেও দুর্বৃত্তায়নের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু গত ১০ মাসে তার চিত্র কী পাল্টালো?
ড. দেবপ্রিয় বলছেন, আমি আরেকটি উদাহরণ দেই, এই যে স্টক মার্কেটের জীর্ণদশা। এটা আসলেই মৃতপ্রায়। ওটা আইসিইউ’র ভেতরে। ছিল ২৭ শতাংশ, কিন্তু এখনো জিডিপি’র ভ্যালু হিসাবে আছে ৯ শতাংশ। এটাকে চালু করার জন্য যে সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, তাহলে স্টক মার্কেটে যারা অংশীদার রয়েছেন, তাদের সঙ্গে যদি আলোচনা না করে সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন একা করতে যায়, তাহলে কোনোদিনই সম্ভব না। মানুষের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে ঠিক কাজও বেঠিক হয়ে যায় যদি আলাপ আলোচনা উন্মুক্ত না থাকে। এটা আমার প্রথম বক্তব্য আপনার কাছে। আলাপ-আলোচনা করতে হবে এবং সবাইকে সুযোগ দিতে হবে। কী পরিবর্তন করলাম একটা স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর থেকে।
বাজেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ড. আনিসুজ্জামান আছে এখানে, সেটা হলো অন্তর্বর্তী বাজেটের বিষয়ে বলেছেন। অন্তর্বর্তী বাজেট কী? যে বাজেট নিয়ে কাজ করছেন সেটা পতিত সরকারের বাজেট। পতিত সরকারের বাজেট নিয়ে আপনি প্রথমে প্রাক্কলন করেছেন জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের দিকে এসে। কিন্তু কাঠামোগত কী উন্নয়ন করলেন? ওই প্রাক্কলনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ধারণা ছাড় দেবেন না বলতেছেন। এখানে কাকে ছাড় দিচ্ছেন, কাকে ভর্তুকিতে রাখছেন? ইন্টারেস্ট রেট কোথায় দিচ্ছেন? কে বলতে পারবে আপনি কী স্বচ্ছতা দিয়েছেন আমাকে। ওই স্বৈরাচারী সরকারের আমলে যে স্বচ্ছতার অভাব দেখেছি, সবাইকে আমাদের থামিয়ে দিয়েছেন। এখনো কাজটা আপনারা একই রকম করলেন। আপনারা কোনো স্বচ্ছতা দিলেন না।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ওই পতিত সরকারের যে এডিপি ছিল, ওই এডিপি থেকে কেমন করে কমানো হলো। ওই মেগা প্রজেক্টগুলো যে অতিমূল্যায়িত ছিল, কোথায় টাকা কমিয়েছেন। আমি তো আবার মেগা প্রজেক্টের অল ইকুয়েশন দেখতে পারছি। আপনি ওখানে কীভাবে সামাজিক সংস্কারের অংশ হিসেবে কীভাবে নতুনভাবে স্থান দিলেন, কোনো নীতিমালা হলো না। এখন সেই আগের এডিপি এখন চলছে। আমি সেটার ভিত্তিতে কাজ করছি।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় বলেন, আমি আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি, যে বাজেট করতে যাচ্ছেন এই সরকার তো নিঃসন্দেহে বৈধ সরকার, তবে নির্বাচিত সরকার তো না। তার তো নিঃসন্দেহে সীমাবদ্ধতা থাকবে। এই সরকার তো পুরা বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারবে না। যদি আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে ফলো করি, তাহলে যারা পরবর্তী বাজেটে আসবে তারা যে এটার ধারাবাহিকতা রাখবে, এটার নিশ্চয়তা কীভাবে রাখবো।
এই বক্তব্যের আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না আমরা কতোটা বদলে যাচ্ছি বা বদলের ইচ্ছে আমাদের আছে। সেই পুরনো পথে হাঁটার যে অভ্যাস সেটা আমাদের পেছন দিকেই টানছে।
এবার একটু ব্যবসায়ীদের কথাবার্তা বলি। সেখানেও ভয়ংকর সব মন্তব্য মিলবে। চাহিদামতো গ্যাস সেই, বিদ্যুৎ নেই, ক্যাশ ফ্লো নেই, একে একে বন্ধ হচ্ছে ফ্যাক্টরি, কিছু ফ্যাক্টরি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। লুটপাট হয়েছে। তবুও ধিকিধিকি তারা জ্বলছিল। এবার বুঝি তা আর পারছে না। একজন তো বলেই দিলেন, আগামী ৬ মাসে ৫০ শতাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেছেন, ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয়েছিল। আর আজকের দিনে অর্থাৎ ২০২৫ সালে শুধুমাত্র শিল্প নয়, শিল্পোদ্যোক্তাদেরও একইভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে।
কতোটা ক্ষোভ, উপায়হীন এবং দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ এমন কথা বলতে পারে? ভাবতে পারছেন?
তিনি আরও বললেন, গ্যাস সংকট চলতে থাকলে ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। শিল্প খাতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, শিল্পে গ্যাসের সমস্যা দিন দিন বাড়ছে, একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু উপদেষ্টা এখনো উটপাখির মতো বালুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছেন, বাস্তবতা দেখতে পারছেন না।
শিল্প বাঁচানো না গেলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ধ্বংস হতে পারে, যা দুর্ভিক্ষ ও বিশৃঙ্খলার কারণ হবে। তিনি আরও বলেন, শিল্পবিরোধী কার্যক্রমের মাধ্যমে আমাদের শিল্পকারখানাগুলো প্রায় ধ্বংস হয়ে পড়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে, মূলধন কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী ঈদে কারখানাগুলো বেতন ও ভাতা দিতে পারবে কি না তা অনিশ্চিত।
শওকত আজিজ রাসেল বলেন, দেশের বহুল প্রচারিত জাতীয় পত্রিকায় গ্যাস সংকটের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে বিজ্ঞাপন প্রদান করা হলেও অদ্যাবধি এই সংকটের কোনো সমাধান হয়নি। বিটিএমএ, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিটিএলএমইএর অধীনের টেক্সটাইল এবং অ্যাপারেল পোশাক কারখানাগুলোর দেশের রপ্তানিতে প্রায় ৮৫ শতাংশ অবদান। গ্যাস সরবরাহ পাওয়ার ক্ষেত্রে রপ্তানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রাধিকার প্রদান করা উচিত হলেও তা করা হচ্ছে না বরং রপ্তানি আয়ের মূল উৎসের প্রতিষ্ঠানগুলো গ্যাসের অভাবে স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। অধিকাংশ টেক্সটাইল মিল এবং পোশাক কারখানায় গ্যাসের শূন্য চাপের প্রমাণ রয়েছে। গ্যাস সরবরাহের এই অবস্থা চলতে থাকলে বিটিএমএ, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিটিএলএমইএ এর অধীনের টেক্সটাইল এবং পোশাক খাতের প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
আর দু’জনের বক্তব্য দিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে কারখানাগুলোর উৎপাদন কার্যক্ষমতা ৬০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ঋণের সুদের হার বৃদ্ধির কারণে শিল্পোদ্যোক্তারা বিপাকে পড়েছেন। তিন মাস সুদ না দিলে ব্যাংক ঋণখেলাপি ঘোষণা করছে, যা শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ।
বিটিটিএলএমইএর চেয়ারম্যান হোসেন মেহমুদ বলেন, গ্যাসের অভাবে ইতিমধ্যে পাঁচ-ছয়টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ সমস্যা সমাধান করতে না পারলে সামনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। বিটিএমএ পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, সরকার কি টেক্সটাইল শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে চায়, নাকি পাট ও চিনি শিল্পের মতো অন্যদের হাতে দিয়ে দিতে চায় তা বুঝতে পারছি না। গ্যাস না থাকলেও অদ্ভুত বিল করা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীররা যে সমস্ত সংকটের কথা বলেছেন, একেবারে গলা শুকিয়ে যাওয়ার মতো। অর্থনীতির এই ঘোরতর বিপদের দিনে জাতিও আজ চরম বিভক্তি আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। আপাতত কোনো সমাধান চোখে পড়ছে না। সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আসছে বাজেট। হয়তো একটা ঘোষণা করা যাবে সেটা বাস্তবায়ন, অথনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণ কতোটুকু ঘটবে সেটা দেখার বিষয়। গত ১০ মাসে ২৭ লাখ মানুষ দরিদ্র হলে আগামী এক বছরে এই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হবে। সেই চাপ সামাল দিতে পারবে তো সরকার। ধরা যাক নির্বাচিত সরকার এলো তাদের জন্যই বা কেমন অর্থনীতি রেখে যাবে অন্তর্বর্তী সরকার?