নির্বাচিত কলাম
বেহুদা প্যাঁচাল
এসব কিসের লক্ষণ?
শামীমুল হক
৮ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতের কোনো অমিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। উভয়পক্ষই চান সংস্কার এবং বিচার। ইইউ গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছে- রাজনৈতিক পট পরিবর্তন সংস্কারে বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। ঠিক তাই। যদি রাজনৈতিক পট পরিবর্তন না হতো তাহলে আমরা এখনো গুম, খুন আর অরাজকতার দেশেই পড়ে থাকতাম। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় লাঠি হাতে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরোধী দলকে ঠেঙ্গাতে দেখতাম। বিশেষ করে স্বৈরাচারী সরকারের শেষ বছরে বিরোধী দল কোনো আন্দোলনের ডাক দিলেই আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশের নামে লাঠি হাতে মাঠে নেমে আসতো। তারা লাঠি দিয়ে মেরে শান্তি বজায় রাখতো দেশের।
নির্বাচন নিয়ে বিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলো। কেউ চান সংস্কারের পর নির্বাচন। আবার কেউ চান প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর নির্বাচন। যারা সংস্কারের পর নির্বাচন চান তারা আবার ২০২৪-এর গণহত্যার বিচার, গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন। তারা বলছেন, গণহত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন নয়। প্রতিটি দলই যার যার অবস্থান থেকে তাদের অবস্থান তুলে ধরছেন জাতির সামনে। কারও দাবিই অযৌক্তিক বলা যাবে না। তারপরও কথা থেকে যায়। দলগুলোর এ অনৈক্য আসলে দেশের জন্য কতোটুকু মঙ্গল? নিশ্চয় বিবেকবান যারা আছেন তারা এই অনৈক্যকে সমর্থন করবেন না। কারণ দীর্ঘ প্রায় ষোল বছরের অপশাসন, অপরাজনীতি, অপকর্ম, অপ-মানসিকতা দেশের মানুষকে কোণঠাসা করে রেখেছিল। গুম, খুন, অপহরণ, আয়নাঘরকে আপন করে নিয়েছিল দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা। এক বিকৃত রুচির সরকার ছিল গত ষোল বছর। যার ফলে জুলাইয়ে গণ-অভ্যুত্থান বলি কিংবা বিপ্লব বলি তার উদ্ভব হয়। সফল বিপ্লবের ফলে আসে দেশের মানুষের বহুল আকাঙ্ক্ষিত অন্তর্বর্তী সরকার। যার প্রধান নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই অন্তর্বর্তী সরকারই রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। একে একে গঠন করে সংস্কার কমিশন। এরইমধ্যে কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদনও তুলে দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। এরমধ্যে একটি কমিশন হলো ঐকমত্য কমিশন। যার প্রধান ড. ইউনূস। এই ঐকমত্য কমিশন একে একে সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসছেন। আলোচনা করছেন। কোনো কোনো দলের সঙ্গে একাধিকবার বসেছেন। এ পর্যন্ত সবক’টি দল ঐকমত্য কমিশনের দেয়া ১৬৬ প্রস্তাবের মধ্যে ১১২টিতে একমত হয়েছে। যেসব প্রস্তাবে দ্বিমত রয়েছে সবাইকে নিয়ে বসলে একটা পথ অবশ্যই সামনে আসবে। যে পথ পরবর্তী ধাপে এগুতে সহায়তা করবে।
আসা যাক নির্বাচন প্রসঙ্গে। বিএনপি বলছে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেয়া সম্ভব। তারা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায়। আবার জামায়াত বলছে, আগামী রমজানের আগে নির্বাচন দিতে হবে। তারাও প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বলছে। আগামী রমজান হবে ফেব্রুয়ারিতে। বিএনপি আর জামায়াতের মধ্যে মাত্র দুই মাসের ব্যবধান। অপরদিকে বিএনপি সমমনা দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে। সমমনা দলগুলোও চাচ্ছে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন। নুরের দল গণঅধিকার পরিষদ অবশ্য আগে বিচার ও সংস্কার চায়। এরপর নির্বাচন চায় তারা। এবি পার্টিও সংস্কার চায় আগে। মূল কথা সংস্কার সবাই চায়। কেউ প্রয়োজনীয় কেউ পুরোপুরি।
এরই মধ্যে সংস্কারের জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ‘পর্যাপ্ত’ সময় দেয়ার পক্ষে ইউরোপের ২৭ রাষ্ট্রের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) মত দিয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ ডেলিগেশন প্রধান মাইকেল মিলার সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে কূটনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ডিকাবের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠান ডিকাব টক-এ তিনি জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ড, দায়ীদের বিচার, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম এবং আগামীর নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আকাঙ্ক্ষাসহ সমসাময়িক নানা বিষয়ে কথা বলেন।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন কখন হতে পারে? উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে ইইউ কি চায়? নির্বাচন কমিশন, সরকার এবং অন্য স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনায় ইইউ কী বুঝতে পেরেছে? এসব প্রশ্নের জবাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশে কখন পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত-সে বিষয়ে বাংলাদেশই সিদ্ধান্ত নেবে। তবে তার আগে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ হওয়া উচিত, কারণ এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। তার কথা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে সংস্কার এখন বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। নির্বাচনের আগে সংস্কার চেয়ে ইইউ দূত বলেন, এখানে আমি একটি বিষয় স্পষ্ট করতে চাই, তা হলো নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর আমাদের পক্ষ থেকে কোনো চাপ নেই। একই সঙ্গে তিনি জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের বিচার স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হওয়ার আশা করেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতের কোনো অমিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। উভয়পক্ষই চান সংস্কার এবং বিচার। ইইউ গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছে- রাজনৈতিক পট পরিবর্তন সংস্কারে বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। ঠিক তাই। যদি রাজনৈতিক পট পরিবর্তন না হতো তাহলে আমরা এখনো গুম, খুন আর অরাজকতার দেশেই পড়ে থাকতাম। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় লাঠি হাতে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরোধী দলকে ঠেঙ্গাতে দেখতাম। বিশেষ করে স্বৈরাচারী সরকারের শেষ বছরে বিরোধী দল কোনো আন্দোলনের ডাক দিলেই আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশের নামে লাঠি হাতে মাঠে নেমে আসতো। তারা লাঠি দিয়ে মেরে শান্তি বজায় রাখতো দেশের। কতো চমৎকার খেলা ছিল আওয়ামী লীগের। এসব খেলায় মানুষ আরও বিরক্ত হতো। কেউ কেউ আড়াল থেকে গালি দিতো। সামনে এসে গালি দেয়ার সাহস কারও ছিল না। ভয়ের সংস্কৃতি কুরে কুরে খাচ্ছিল দেশবাসীকে। এ সংস্কৃতি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রেহাই দিয়েছে ছাত্র-জনতা। কোটা আন্দোলন থেকে একদফার আন্দোলনের সফল রূপকার তারাই। যদিও এ পর্যন্ত এনে দিয়েছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। তাদের ষোল বছরের একেকটি দিন গেছে জাহান্নামের আগুনে। আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপি’র কতো নেতা যে গুম হয়েছেন ইয়াত্তা নেই। খুন হয়েছেন প্রকাশ্যে। মামলা আর হামলা তো ছিল মামুলি ব্যাপার। এভাবে ষোলটি বছর পেরিয়ে ছাত্রদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করেছে। এ ছাড়া জুলাই আন্দোলনে বিএনপি’র পাশাপাশি জামায়াতের ভূমিকা ছিল ব্যাপক। সব মিলিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম এক স্বৈরাচারের পতন হয়। এই পতনের পর সব রাজনৈতিক দলগুলোকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে সুর তোলার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। মতপার্থক্য রয়েই গেছে। এর সুযোগ যে স্বৈরাচার হাসিনা নিচ্ছে না এটা হলফ করে কে বলতে পারে? এখনো শেখ হাসিনা ভিন দেশে বসে অডিও রেকর্ড ছাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়া এসব অডিও রেকর্ডে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও জুলাই আন্দোলনের সমন্বয়কদের ওপর রাগ ঝাড়ছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের সরাসরি উস্কে দিচ্ছেন। এই উস্কে দেয়া তার স্বভাব। ক্ষমতায় থাকতেও তাই করেছেন। বিরোধী দলে থাকাকালেও একই কাজ করেছেন। আর এখন পালিয়ে বিদেশ গিয়েও সেই কাজই করছেন।
এখন যদি প্রশ্ন রাখি জুলাই আন্দোলনের সমন্বয়ক এনসিপি’র দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ’র ওপর হামলা এ উস্কানিরই ফসল? তাহলে কি ভুল বলা হবে? শুধু হামলাই নয়, তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নেয়ারও চেষ্টা হয়েছিল। এর আগে এনসিপি’র সেক্রেটারি আবদুল কাদেরের ওপর হামলা হয়েছে হাতিয়ায়। এসব কিসের লক্ষণ? এমন হতে থাকলে দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে যে হবে না- এটাই বা কে বলতে পারে? তাই বলছি, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই এক হতে হবে। হাসনাত আবদুল্লাহ হামলার শিকার হয়েছে এতে আনন্দের কিছু নেই। এই হামলা আরেকদিন আপনার ওপরও হতে পারে। সরকারের উচিত এ হামলায় কারা জড়িত? তাদের বের করে শাস্তির আওতায় আনা। তা না হলে সন্ত্রাসীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। অবশ্য হাসনাতের উপর হামলার ঘটনায় অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখানে দেখতে হবে সত্যিকারভাবে এ হামলার সঙ্গে কারা জড়িত?
সবশেষে সেই একই কথা বলবো। সংস্কার দ্রুত শেষ করে জাতীয় নির্বাচনের দিকে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এরপর নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করবে। এক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশনকে প্রয়োজনে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে বোঝাতে হবে। দেশের মানুষ ঐকমত্য কমিশনের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কমিশনকে মনে রাখতে হবে। আরেকটি কথা না বললেই নয়, মুক্তগণমাধ্যম দিবস গেল রোববার। গণমাধ্যম কতোটুকু মুক্ত বিষয়টি সবাইকে ভাবতে হবে। যারা দেশ চালাচ্ছেন, যারা দেশ চালাবেন-সবাইকে এটা নিয়ে ভাবতে হবে। আর গণমাধ্যমগুলোকেও তাদের নিজেদের নিয়ে আত্মসমালোচনা করতে হবে। তারা নিজেদের মুক্ত রাখতে পেরেছে কিনা? তারা তাদের দায়িত্ব কতোটুকু পালন করেছে? সব পক্ষই যখন মুক্ত গণমাধ্যম নিয়ে নিজেদের ভাবনাগুলো মেলাবেন তখনই নিজেরা বুঝতে পারবেন আসলে গণমাধ্যম কতোটুকু মুক্ত।