ঢাকা, ২৫ জুন ২০২৫, বুধবার, ১১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৭ জিলহজ্জ ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

আ ন্ত র্জা তি ক প্রসঙ্গ

ইরাক যুদ্ধের একই ভুল কী ট্রাম্পও করলেন ইরানে?

মোহাম্মদ আবুল হোসেন
২৩ জুন ২০২৫, সোমবার
mzamin

ট্রাম্পও কি একই ভুল করলেন। বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার সহ বিশ্বনেতাদের উদ্বেগকে উপেক্ষা করে ইরানে সত্যিই হামলা চালিয়ে বসলেন তিনি। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি কোনো যুদ্ধ শুরু করবেন না, বরং ক্ষমতায় যাওয়ার একদিনের মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন। কিন্তু তা পারেননি। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রায় ৬ মাস তিনি ক্ষমতায়। ইউক্রেন যুদ্ধ চলছেই। এর মধ্যে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকে বরখেলাপ করে ইরানে হামলা করে বসলেন। এই হামলার কারণ হিসেবে বলেছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। অথচ মার্চে তার জাতীয় গোয়েন্দা প্রধান তুলসি গ্যাবার্ড কংগ্রেসের কাছে দেয়া সাক্ষ্যে বলেছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না। এ নিয়ে তুলসির প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন ট্রাম্প। ফলে তুলসি ইউটার্ন নিয়ে বলেছেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারে। সর্বোচ্চ নেতার বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলেন এমন সাহস কার! কিন্তু ট্রাম্প যে অভিযোগের ভিত্তিতে হামলা করলেন তার স্বপক্ষে প্রমাণ কি? এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ একটি ছায়া ছায়া অভিযোগের ভিত্তিতে একটি দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে যুদ্ধ শুরু করেছে। আসলে এর মধ্যদিয়ে যা বোঝানো হচ্ছে তা হলো মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমরা মাথানত করে রাখো। আমরা যা বলবো, তোমাদেরকে সে মতো চলতে হবে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চাইতে পারবা না। আল আকসার দিকে চোখ দিতে পারবা না। আমরা যা খুশি করবো, তোমরা চোখ বন্ধ করে সহ্য করবা সব। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো করছেও তাই। তা নাহলে ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে দু’টি দেশ। একটি সিরিয়া। অন্যটি জর্ডান। তারা তাদের আকাশসীমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছে বলেই ইসরাইল ইরানে হামলা করতে পেরেছে। আবার এমনও তথ্য এসেছে, ইরান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোনকে জর্ডানের আকাশসীমায় অকার্যকর করেছে জর্ডান। আপনাদের মনে আছে সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল শারা’র সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাক্ষাৎ এবং সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার কথা। আহমেদ আল শারা নিশ্চয় শুধু নিজের দেশের স্বার্থ দেখেছেন এবং কার্যত সেইদিনই মাথানত করেছেন। এখানে একটি কথা বলার আছে, তা হলো এই আহমেদ আল শারা কিন্তু আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তার মাথার মূল্য ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন তিনি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র। কারণ, তিনি ট্রাম্পকে তার কার্যসিদ্ধির সুযোগ দিয়েছেন।

আবার আসি সেই ভুলের কথায়। ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে- এমন কোনো অকাট্য প্রমাণ দিতে পারেনি কেউ। পক্ষান্তরে ইরান বার বার বলে আসছে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উপায়ে বেসামরিক উদ্দেশ্যে। কিন্তু বার বার যুক্তরাষ্ট্র, তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইল এবং পশ্চিমা কিছু দেশ বলে আসছে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। অবশ্য যদি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা আইএইএ’র নির্দেশনার বাইরে গিয়ে ইরান সত্যি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে থাকে, তাহলে তা নিন্দনীয়। কিন্তু তারা যে সেটা করছে, সেই তথ্যপ্রমাণ তো আগে দিতে হবে। এক্ষেত্রে ট্রাম্পও কি তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক নেতাদের মতো ভুল করে বসলেন! যুক্তরাষ্ট্র ভুল করেছে ইরাকে। ভুল করেছে আফগানিস্তানে। ভুল করেছে লিবিয়ায়। তারা মুসলিম বিশ্বের যেখানেই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য হাত বাড়িয়েছে, সেখানেই দেখা দিয়েছে গৃহযুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ইরাক যুদ্ধ।  সেখানে আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত। এই আগ্রাসনের পক্ষে নানা ধরনের যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছিল: যেমন, ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের সরকার নাকি গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করছিল এবং আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিংবা বিশ্বাস ছিল, আমেরিকা ইরাককে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারবে, যা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ও শান্তি আনবে। কিন্তু এসব যুক্তি দুর্বল ছিল এবং ইরাক কখনোই আমেরিকার মৌলিক নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি ছিল না। প্রথম থেকেই এটা স্পষ্ট ছিল যে, আমেরিকা একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে ইরাকি সমাজকে পাল্টাতে পারবে না- আফগানিস্তানেও একই লক্ষ্য ছিল এবং তা ব্যর্থ হয়েছে।

আমেরিকান নীতিনির্ধারকরা ইরাকের বাস্তব সমাজ কাঠামো সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন এবং তারা দেশটির দীর্ঘদিন ধরে দমন করা সাম্প্রদায়িক ও গোষ্ঠীগত বিভাজন নিয়ে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই সেখানে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। সাদ্দাম  হোসেনকে অপসারণ করার ফলে যে শূন্যতা তৈরি হয়, তা অস্থিরতা ডেকে আনে। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। দলে দলে। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে। আমেরিকান দখলদার বাহিনীর একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত, যেমন- ইরাকি সেনাবাহিনীকে দ্রুত ভেঙে দেয়ায় বহু তরুণকে বিদ্রোহের দিকে ঠেলে দেয়। পরবর্তীতে নতুন শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার আসে। তারা আগে সুন্নি নেতৃত্বাধীন সাদ্দাম সরকারের হাতে নির্যাতিত ছিল, তারা সুন্নিদের একপেশে করে তোলে। ফলে বিদ্রোহ আরও বাড়ে এবং দীর্ঘস্থায়ী সাম্প্রদায়িক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। এই বিশৃঙ্খলা আইএসআইএস-এর উত্থানের পথ তৈরি করে। ২০১৪ সালে যখন আইএস আক্রমণ শুরু করে, তখন ইরাকি সেনাবাহিনী কার্যত কোনোরূপ প্রতিরোধ ছাড়াই পিছু হটে এবং তাদের ফেলে যাওয়া বিপুল পরিমাণ মার্কিন অস্ত্র আইএসআইএস সহজেই দখল করে নেয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আইএসআইএস-এর ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে ব্যবহৃত গুলির এক-পঞ্চমাংশই ছিল যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি- সম্ভবত সেগুলো আগে ইরাকি সেনাবাহিনীর হাতে ছিল। ফলে আইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমেরিকান সেনারা বাধ্য হয়ে ইরান-সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়াদের সঙ্গে সহযোগিতা করে। ফলে ইরাক আরও দৃঢ়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের প্রভাবে চলে যায়। যদিও আমেরিকা একজন স্বৈরশাসক (সাদ্দাম)কে সরাতে পেরেছিল, তবে এর পরিণতিতে যেসব বিপর্যয় নেমে আসে- তা দীর্ঘমেয়াদে আমেরিকান সেনা এবং ইরাকি জনগণের জন্য ভয়াবহ হয়ে ওঠে।

ইরাক যুদ্ধ কি ভুল ছিল?
হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হয়নি ইরাকে হামলা চালিয়ে শাসন পরিবর্তন ও রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করা। এই যুদ্ধ আমেরিকার জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল না। বিশেষ করে তখন, যখন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানেও একটি ব্যর্থ জাতি-গঠন ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে লিপ্ত ছিল। সাদ্দাম হোসেনের শাসন ছিল নিঃসন্দেহে নিষ্ঠুর ও মানবতাবিরোধী। তবুও প্রেসিডেন্ট জন কুইন্সি অ্যাডামসের ভাষায় বললে, বিশ্বের প্রতিটি ‘দানব’ দমন করা আমেরিকার দায়িত্ব নয়। আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত শুধু জাতীয় স্বার্থে কেন্দ্রীভূত।
৯/১১ হামলার পর এক অনিশ্চয়তার সময়ে বহু আমেরিকান ভুলভাবে বিশ্বাস করেছিলেন যে, ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। তারা যুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন। তখন বেশির ভাগ আমেরিকান এই যুদ্ধকে সমর্থন করলেও, কিছু সাহসী বিশেষজ্ঞ তখনও প্রকাশ্যে বলেছিলেন- এই যুদ্ধ হবে ভয়ানক ভুল। ২০০২ সালের শেষভাগে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একটি বড় দল নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি পূর্ণপৃষ্ঠার চিঠি প্রকাশ করেন। সেখানে বলা হয়- ‘ইরাক যুদ্ধ আমেরিকার জাতীয় স্বার্থে নয়।’ তারা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন- আমেরিকার কোনো নির্দিষ্ট প্রস্থানের পরিকল্পনা থাকবে না, এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা বাড়াবে, এবং এটি আল-কায়েদার বিরুদ্ধে লড়াই থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেবে। এই সতর্কবার্তাগুলোকে আমলে নেয়া উচিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের এবং ভবিষ্যতের পররাষ্ট্রনীতিতে সেই শিক্ষা প্রয়োগ করা উচিত।

ইরাক যুদ্ধের ফলাফল
ইরাক যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপরীতমুখী প্রভাব ফেলেছে। এটি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর শক্তি বাড়িয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির কস্ট অব ওয়ার প্রজেক্ট অনুসারে ২০০১ সাল থেকে ২০২২ অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধের খরচ দাঁড়িয়েছে ২.০৫৮ ট্রিলিয়ন ডলার। যেখানে ভবিষ্যতের যোদ্ধাদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য আরও ১ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হয়। এই যুদ্ধও মূলত ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হয়েছিল। ২০৫০ সালের মধ্যে শুধু সুদের পরিমাণেই অতিরিক্ত ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হবে। অর্থনৈতিক ক্ষতির বাইরেও, এই যুদ্ধের মানবিক মূল্য ভয়াবহ। এতে নিহত হন ৪৫৯৮ মার্কিন সেনা, ১৫ জন প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মী এবং ৩৬৫০ জন আমেরিকান ঠিকাদার। পাশাপাশি, লক্ষাধিক ইরাকি বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন।

আফগানিস্তান যুদ্ধে কী ভুল হয়েছিল? 
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশৃঙ্খল প্রস্থানের দৃশ্যপট অনেকের কাছে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষ দিনগুলোর কথা- কাবুল বিমানবন্দরে উড়ন্ত বিমানে ঝুলে থাকা আতঙ্কিত আফগান, আর তার পাশেই সরকারি ভবনে, ট্যাঙ্কে ও অস্ত্রে অধিকার প্রতিষ্ঠা করছে তালেবান সেনারা। এর পরেই গোটা আফগানিস্তানে নেমে আসে তালেবানি শাসন। নারীদের কাজ ও জনসমক্ষে আসার অধিকার রাতারাতি কেড়ে নেয়া হয়। যারা প্রতিবাদ করেন, তাদের উপর নেমে আসে কঠোর শাস্তি। সরকারি দপ্তর থেকে নারীদের বহিষ্কার করা হয় এবং ষষ্ঠ শ্রেণির পর মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া দারিদ্র?্য, অনাহার ও প্রসূতি-মৃত্যুর হার বেড়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। অর্থ জব্দ করা হয়েছে এবং কেবল মানবিক সহায়তা ছাড়া অন্য সব সহায়তা বন্ধ রয়েছে। 

তথ্যসূত্র:
১. কনসার্নড ভেটেরানস ফর আমেরিকা ফাউন্ডেশন
২. কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্স ও ইন্টারনেট

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ/ এক যুগ আগে ড. ইউনূসকে যা বলেছিলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status