নির্বাচিত কলাম
আ ন্ত র্জা তি ক প্রসঙ্গ
যুদ্ধাপরাধ: সংজ্ঞা কি দুই রকম!
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
২২ জুন ২০২৫, রবিবার
ইসরাইলের বিরশেভায় একটি হাসপাতালে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হলো খবর। একে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করা হলো। পশ্চিমা মিডিয়া এ বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে খবর প্রচার করেছে। অবশ্যই হাসপাতালে বোমা হামলা বা যেকোনো হামলা নিন্দনীয়। তবে একখানা কথা আছে। ইরানে আগ্রাসন চালাচ্ছে ইসরাইল। নজর দিতে চাই ২০শে জুন তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুতে। সেখানে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে শুক্রবার শুরুর দিকে তেহরানে আরও একটি হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এ নিয়ে রাজধানী শহরে মোট ৩টি হাসপাতালে হামলা চালালো ইসরাইল। শুক্রবারের হামলায় ৬টি এম্বুলেন্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থাপনার বড় রকমের ক্ষতি হয়েছে। মেডিসিন সান ফ্রন্টিয়ার্সের মতে, ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পর্যায়ক্রমিকভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। জাতিসংঘে মানবাধিকার বিষয়ক সমন্বয়কের অফিসের (ওসিএইচএ) তথ্যমতে, গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৭টি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শুরু পর্যন্ত আংশিক কার্যকর ছিল। অন্য ১৯টি বন্ধ হয়ে গেছে।
এ সময়ে হত্যা করা হয়েছে কমপক্ষে এক হাজার স্বাস্থ্যকর্মীকে। ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে সব মেডিকেল স্থাপনা, মসজিদ, স্কুল-কলেজ, আশ্রয়শিবির, অনাহারী মানুষ খাদ্য সংগ্রহ করতে গেলে তাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে। এটা করছে ইসরাইল। এখন যদি প্রশ্ন তোলা হয় ইসরাইলের এ সব কর্মকাণ্ড কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়? এ সব কি যুদ্ধাপরাধ নয়? ঠুঁটো জগন্নাথের মতো জাতিসংঘ শুধু বক্তব্য, বিবৃতি দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করছে। জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট, হামাসের একজন নেতাকে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। তা সত্ত্বেও তিনি হাঙ্গেরি সফর করেছেন। সেক্ষেত্রে বিশ্ববাসীর ভূমিকা কী? জাতিসংঘের ভূমিকা কী? ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের যেসব ফিরিস্তি দিলাম তাতে, তাদেরকে যুদ্ধাপরাধী বলবেন না আপনি? উল্টো তারা যখন ইরানে হাসপাতালে হামলা চালালো, নিরীহ মানুষকে হত্যা করলো তাকে ন্যায়বিচারের কোন পাল্লায় পরিমাপ করবেন। ইরানের হাসপাতাল আক্রান্ত হওয়ারও পরে ইসরাইলে হামলা হয়েছে, বিরশেভায় হাসপাতাল আক্রান্ত হয়েছে। তাহলে ইসরাইলের হামলাকে যদি আপনি যুদ্ধাপরাধ না বলেন, তবে কেন ইরানের পাল্টা আঘাত হবে যুদ্ধাপরাধ? শক্তিধরের জন্য এক নিয়ম। দুর্বলের জন্য আরেক নিয়ম। যতদিন বিশ্বে এই বিভাজন মানবজাতিকে ভাগ করে রাখবে, ততদিন এই সংঘাত চলতেই থাকবে। আজ এখানে, কাল ওখানে।
এজন্যই মধ্যপ্রাচ্যের বাতাস ভরে গেছে বারুদের গন্ধে। আগ্রাসনের শিকার ইরান। ইরান এবং ইসরাইলের মাঝখানে দু’টি দেশ। সিরিয়া ও জর্ডান। তাদেরকে অতিক্রম করে ইরানে নৃশংস হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। তবুও বিশ্বের তাবৎ মোড়লদের অবস্থান ইসরাইলের পক্ষে। তাদের অভিযোগ, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। তারা ওই অঞ্চলে হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতিদের মতো সংগঠনকে মদত দিয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে ইরান বার বার বলে যাচ্ছে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উপায়ে ব্যবহারের জন্য। তা সত্ত্বেও সেখানে প্রতিক্ষণ ইসরাইলি যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেলা হচ্ছে। ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে এসে পড়ছে। এই সংঘর্ষ ক্রমশ এক পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই যুদ্ধে একটু একটু করে জড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রা। এই মুহূর্তে গোটা বিশ্ব এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যার ফলাফল হতে পারে বিস্ময়কর কিংবা ধ্বংসাত্মক। এখানে আমরা পর্যবেক্ষণ করবো এই সংকটের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ পক্ষগুলোর অবস্থান, হুমকি, উদ্যোগ এবং সম্ভাব্য সমঝোতা প্রক্রিয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রস্তুতি: ইসরাইলের প্রতি দীর্ঘদিনের সমর্থনের ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র এখন যুদ্ধ সাজে সজ্জিত। দু’টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ- ইউএসএস নিমিটজু এবং ইউএসএস কার্ল ভিনসন- মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করছে। পেন্টাগনের তরফে জানানো হয়েছে, এই প্রস্তুতি প্রতিরোধের জন্য। তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন- এটি পূর্ণাঙ্গ হামলার প্রস্তুতি নির্দেশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান জানিয়ে দিয়েছেন, ইরান যদি সরাসরি ইসরাইল আক্রমণ করে, তবে আমরা নীরব থাকবো না। মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন মার্কিন ড্রোন, ফাইটার জেট ও ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম ইতিমধ্যেই প্রতিরক্ষার নামে আক্রমণাত্মক মোড় নিচ্ছে। এর পাশাপাশি সাইবার যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের যৌথ ‘অ্যাক্টিভেশন’ রীতিমতো ইরানকে অস্থির করে তুলেছে। তবে এখনও ঘোষণা দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেনি যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুদ্ধে যোগ দেয়ার অনুমোদন দিয়েছেন। তবে সিদ্ধান্ত দেননি। তিনি ইরানকে আপস করার জন্য দুই সপ্তাহ সময় দিয়েছেন।
রাশিয়ার হুঁশিয়ারি: রাশিয়া দীর্ঘদিনের কৌশলগত মিত্র। ইরানের পক্ষ নিয়ে সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ একাধিকবার বলেছেন, ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ হলে রাশিয়া চুপ থাকবে না। মস্কোর মতে, এই যুদ্ধে ইরানকে দুর্বল করা মানেই সিরিয়া, লেবানন ও দক্ষিণ ককেশাসে পশ্চিমা আধিপত্য বিস্তার। রুশ প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা আলেক্সেই ঝুরাভলেভ একধাপ এগিয়ে বলেছেন, ইরান যদি বিপর্যস্ত হয়, তাহলে আমরা তাকেও অস্ত্র ও গোয়েন্দা সহায়তা দেবো। আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তা সেই পরিসরে জড়িত। ক্রেমলিনের সাম্প্রতিক ইরান-রাশিয়া চুক্তি নবায়ন কৌশলগত বার্তা দেয় যে, যুদ্ধের ছায়া যদি রাশিয়ার প্রভাবিত অঞ্চলে পড়ে, সেক্ষেত্রে মস্কো সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে।
চীনের প্রতিক্রিয়া: চীনের জ্বালানি সরবরাহের বড় অংশ আসে ইরান থেকে। তারাও এই উত্তেজনায় শঙ্কিত। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একাধিকবার বলেছে, এ যুদ্ধ শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতি ও জ্বালানি বাজারকে ধ্বংস করবে। চীন দ্বিপক্ষীয় শান্তি প্রতিষ্ঠায় একাধিক বৈঠক আয়োজন করেছে, যার একটি অনুষ্ঠিত হয়েছে কাতারে, আরেকটি ভিডিও কনফারেন্সে রিয়াদ ও তেহরানের প্রতিনিধিদের নিয়ে। চীন সরাসরি কোনো পক্ষ না নিলেও ইসরাইলকে সতর্ক করেছে যুদ্ধ থামাতে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছে- উস্কানিমূলক নীতি এড়াতে। বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে, এই সংঘাত বন্ধ করা এখন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, যাতে জাতিসংঘও কার্যকরভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।
তুরস্কের কূটনৈতিক উদ্যোগ: তুরস্কের অবস্থান মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সংযোগস্থলে। তারা কূটনীতিতে সক্রিয়। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান এ পর্যন্ত দু’বার তেহরান সফর করেছেন এবং একবার ফোনে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করে বলেছেন, এ যুদ্ধ মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পরিণত হতে পারে। তুরস্ক একটি সমঝোতা পরিকল্পনা জাতিসংঘ ও ওআইসি উভয়কে পাঠিয়েছে। এর মূল বিষয়: একমাস যুদ্ধবিরতি, এবং পরবর্তী বৈঠকে স্থায়ী শান্তি কাঠামো নির্ধারণ। তবে এরদোগানের ‘মুসলিম ঐক্যের ডাক’ আবারো ওয়াশিংটনের সন্দেহকে বাড়িয়েছে যে, তুরস্ক হয়তো রাশিয়া-চীন-পূর্ব এশিয়া জোটে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে।
হিজবুল্লাহ্র হুমকি: ইসরাইল মনে করছে হিজবুল্লাহর হুমকি বাস্তব। একাধিক ইসরাইলি শহরে বোমাশেল্টার প্রস্তুত করা হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে- হিজবুল্লাহর প্রায় ৩০,০০০ রকেট এবং বহু সুড়ঙ্গ সিস্টেম যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। এটি একটি ‘মাল্টি-ফ্রন্ট ওয়ার’ এর ইঙ্গিত দেয়।
সমঝোতা প্রক্রিয়া: যুদ্ধ এড়াতে কূটনৈতিক আলোচনা চলছে। কাতার, ওমান, চীন, তুরস্ক ও ফ্রান্স পৃথক পৃথকভাবে আলোচনার উদ্যোগে নিয়েছে। তবে এসব আলোচনা ‘শর্তহীন’ নয়। যুক্তরাষ্ট্র চায়- ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি স্থগিত করুক এবং হিজবুল্লাহ-হামাসকে ‘নিয়ন্ত্রণে’ আনুক। ইরান চায়- ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করুক এবং পশ্চিম তীর থেকে সেনা প্রত্যাহার করুক। এই ‘অচলাবস্থায়’ কূটনৈতিক চেষ্টা স্তব্ধ নয়, কিন্তু গতি নেই। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি তিনদফা শান্তি প্রস্তাব প্রস্তুত রয়েছে, কিন্তু তা এখনও কোনো পক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেনি।
ইরানি নেতাদের প্রত্যয়: ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সরাসরি বলেছেন, ইসরাইল ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের আমরা প্রতিরোধ করবো। তেহরানের পতন নয়, বরং জেরুজালেমের মুক্তিই আমাদের লক্ষ্য। ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডের মুখপাত্র জানান, আমরা সাইবার, ড্রোন এবং ব্যালিস্টিক শক্তিতে শতভাগ প্রস্তুত। যদি আমাদের ওপর হামলা হয়, তাহলে হাইফা, তেল আবিব এবং মার্কিন ঘাঁটিগুলো অগ্নিগর্ভ হবে।