নির্বাচিত কলাম
সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ
পর্যালোচনা- নারী ‘প্রতিনিধি’ না ‘প্রতিনিধিত্ব’
শহীদুল্লাহ ফরায়জী
১৯ জুন ২০২৫, বৃহস্পতিবার
নারী ‘প্রতিনিধি’ এবং ‘প্রতিনিধিত্ব’-এই দুই ধারণাগত পার্থক্যের অন্তর্নিহিত রাষ্ট্রীয় ও সাংস্কৃতিক জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে আলোচ্য প্রবন্ধের অবতারণা।
দীর্ঘদিন যাবৎ আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অর্থাৎ জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে রাজনৈতিক পরিসরে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা এবং বিদ্যমান বাস্তবতায় সংস্কার কমিশনসমূহ এই বিষয়ে প্রস্তাবনা দিয়েছে। ’৯১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩২ বছর নারী প্রধানমন্ত্রী-বিরোধী দলের নেত্রীসহ অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রচণ্ড উপস্থিতি ছিল। কিন্তু নারীরা আরও বঞ্চিত হয়েছে, নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে এবং বৈষম্যের শিকার হয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়-তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নারী সমাজের অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের ভাষ্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে তারা ‘নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধি’ হিসেবে বিবেচিত হন না। নারী প্রতিনিধিত্বের অভাবে নীতিনির্ধারণে নারীদের স্বার্থ ক্রমাগতভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে।
১৯৭২ সালের সংবিধানে সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে নারীদের সংসদ সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে নারী সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ রাজনীতিতে সীমিতভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়-পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও। সংরক্ষিত আসনের নারীরা সংসদ সদস্য হিসেবে চিহ্নিত হলেও মর্যাদা পায়নি। ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব-কোনোটারই প্রয়োগ করতে পারেনি। সংরক্ষিত আসনের নিয়োগ প্রক্রিয়া নারীর আত্মমর্যাদাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল, ফলশ্রুতিতে এরশাদ আমলে তাদেরকে একসেট অলংকার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। যদিও সেই অপমানকর অবস্থা থেকে এখন কিছুটা মুক্তি মিলেছে, তবে পুরোপুরি রেহাই মেলেনি। দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত নারী সংসদ সদস্যগণের অনেকেই ছিলেন ৩০০ আসনের সংসদ সদস্যদের আত্মীয়-স্বজন বা পারিবারিক বন্ধনের স্বীকৃতি। ফলে পাঁচ বছর সংসদে যাওয়া-আসা করলেও দলে বা সমাজে কিংবা রাজনৈতিক পরিসরে তাদের খুব জায়গা হয়নি। পরবর্তী মেয়াদে সংরক্ষিত আসনে আবার মনোনয়ন না পেলে সেসব নারী প্রতিনিধিগণ রাজনীতির মাঠ থেকে দ্রুতই হারিয়ে যায়। সংরক্ষিত পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট কিছু নারী ব্যক্তিত্ব উপকৃত হলেও, বৃহৎ নারী জনগোষ্ঠীর পক্ষে এটি প্রকৃত অগ্রগতি নয়।
নারীর প্রতিনিধিত্ব বলতে শুধু একজন নারী ব্যক্তিত্বের সংসদে পৌঁছানোকে বোঝানো হবে না, বরং প্রশ্ন তোলা হবে-নারী জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অভিপ্রায়, চেতনা ও অভিজ্ঞতার সত্যিকারের প্রতিফলন হচ্ছে কিনা। এখানে গণতন্ত্র, প্রতিনিধিত্ব, লৈঙ্গিকরাজনীতি ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার-এই সবকিছুকেই দার্শনিক বিশ্লেষণে হাজির করা দরকার।
প্রতিনিধিত্ব ধারণার তাত্ত্বিক পটভূমি:
১. হান্না আরেন্ট, জন স্টুয়ার্ট মিল ও এডমান্ড বার্কের প্রতিনিধিত্ব বিষয়ক তত্ত্ব অনুযায়ী-একজন প্রতিনিধি তখনই বৈধ হন যখন তিনি প্রতিনিধিত্বকারীদের ‘ইচ্ছা, দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতা ও দাবি’কে রাষ্ট্রযন্ত্রে বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ধারণ করতে সক্ষম হন। শুধুমাত্র ‘উপস্থিতি’ নয়, ‘অভিজ্ঞতার ভাষ্য’ উপস্থাপন করাই সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব।
২. পিয়ের বোর্দিও (Pierre Bourdieu)-এর মূল ধারণা: প্রতিনিধি হওয়া মানে কেবল নির্বাচনে জেতা নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূলধন (Social cultural capital) ব্যবহার করে একটি গোষ্ঠীকে ‘দৃশ্যমান’ করে তোলা।
তিনি বলেন-প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি নিজেই গোষ্ঠীকে নির্মাণ করেন। (He creates the group he claims to represent)-যেটি একটি প্রতীকী ক্ষমতার ব্যবহার।
৩. শ্যিলা বেনহাবিব (Seyla Benhabib) ধারণা: প্রতিনিধিত্বকে শুধু সাংবিধানিক কাঠামোর প্রশ্নে নয়, বরং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusive) গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখতে হবে।
নারীবাদী ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব প্রশ্নে তিনি-‘Deliberative Democracy’ ও ‘Narrative Agency’-এর গুরুত্ব দেন।
৪. বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন (Benedict Anderson) “Imagined Communities” তত্ত্বের মাধ্যমে বলেন-প্রতিনিধি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনেক সময় এমন এক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব দাবি করে, যেটি কেবল একটি কল্পিত বা গঠিত সত্তা। এর মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বের রাজনৈতিক দাবিগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
সংসদে একজন নারী সদস্যের উপস্থিতি মানেই কি নারীর প্রতিনিধিত্ব? একটি অঞ্চলের পুরুষ ও নারী উভয়ের ভোটে একজন নারী নির্বাচিত হলে তিনি কি নারী সমাজের বিশেষ রাজনৈতিক চেতনা, অভিজ্ঞতা ও দাবি-দাওয়ার প্রতিনিধি হন? এই প্রশ্নটি কেবল পরিসংখ্যানগত নয়, বরং এক গভীর দার্শনিক ও রাজনৈতিক সমস্যার কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়। ‘প্রতিনিধিত্ব’ বলতে আমরা কী বুঝি, আর ‘নারী’ বলতে আমরা কাকে বুঝি? এই দৃষ্টিকোণ থেকে একজন নারী রাজনীতিক যদি পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় আত্মীকৃত হন এবং নারীর পক্ষে রাজনৈতিক এজেন্ডা তুলে না ধরেন, তবে তিনি হয় তো নারী ‘নামধারী প্রতিনিধি’ হতে পারেন, কিন্তু নারীর ‘রাজনৈতিক প্রতিনিধি’ নন।
লিঙ্গ ও ভোটাধিকার: গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব: একটি নির্বাচনী ব্যবস্থায় যদি নারী ও পুরুষ উভয়েই ভোট দিয়ে একজন নারীকে নির্বাচিত করেন, তবে এই নারী কি নারীর অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা দাবির প্রতিনিধিত্ব করেন, নাকি কেবলমাত্র ‘জনপ্রিয় প্রার্থী’ হিসেবে নির্বাচিত হন? জন স্টুয়ার্ট মিল “Subjection of Women” গ্রন্থে বলেন-’ Without the freedom to express collective interests, no class or gender can represent itself’-অর্থাৎ, যদি নারীসমাজ নিজেদের বিশেষ অভিজ্ঞতা ও দাবির ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচন না করতে পারে, তবে সেই প্রতিনিধিত্ব আসলে পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত কাঠামোরই প্রতিচ্ছবি।
অনেকে বলেন-সংরক্ষিত নারী আসন ও কোটাব্যবস্থা নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সংরক্ষিত নারী আসনগুলোতে নির্বাচিত ব্যক্তিদের উপর দলীয় নেতার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে, জনসাধারণের ভোট বা নারীর সম্মিলিত নির্বাচনী শক্তির প্রতিফলন সেখানে দেখা যায় না।
এইখানে মাইকেল ওয়ালজারের ‘Spheres of Justice’ বইয়ের এক প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়-যদি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবন-অভিজ্ঞতা এক ধরনের সামাজিক ‘স্বতন্ত্রতা’ তৈরি করে, তবে সেই অভিজ্ঞতার রাজনৈতিক প্রতিফলনের মাধ্যমও আলাদা হওয়া উচিত। অর্থাৎ, নারীর জীবনের অভিজ্ঞতা যে-পুরুষের মতো নয়, তার প্রতিনিধিত্বও আলাদা রূপে আসা উচিত।
নারীর প্রতিনিধিত্ব: একটি বিকল্প রূপরেখা: নারীর সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হলে কেবলমাত্র নারী প্রার্থীর উপস্থিতি যথেষ্ট নয়, বরং নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে, নারী ভোটারদের সক্রিয় রাজনৈতিক মাঠে নারীসমাজকে সংগঠিতকরণ, নারীর রাজনৈতিক চেতনা ও দাবির স্পষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন, নারী প্রার্থীর প্রতি নারীদের সমন্বিত সমর্থন ও মূল্যায়ন দরকার। তাই রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে নারীর জন্য একটি স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক প্ল্যাটফরম গড়ে তোলা দরকার। পুরুষ নেতৃত্বের অনুগ্রহে নয়, নিজেদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতায় তারা নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবে।
রাষ্ট্র ও সংসদের কাঠামোতে নারী প্রতিনিধিত্ব কেবল লিঙ্গের প্রশ্ন নয়, এটি একটি রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রশ্ন। একজন নারী নির্বাচিত হলেই নারী সমাজের মুক্তি ঘটে না, যদি না তিনি নারীত্বের অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা, সামাজিক বঞ্চনা, অর্থনৈতিক নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক বাধাগুলোর ভাষ্যকে রাজনৈতিক পরিসরে তুলে ধরেন। তাই, প্রতিনিধিত্ব মানে কেবল ‘আমি নারী, আমি নারীসমাজের প্রতিনিধি’-বলা নয়। প্রতিনিধিত্ব মানে-নারী হয়ে দেখা, বোঝা, অনুভব করা এবং সেই অভিজ্ঞতাকে রাজনৈতিক ভাষায় রূপ দেয়া ও সেসব চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে নারী অধিকারকে সমতাপূর্ণ করতে পারা-তবে, তা-ই হবে নারীর প্রতিনিধিত্ব।
বাংলাদেশে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রসহ সমাজব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার যেমন প্রয়োজন, তেমনি নারীর অগ্রগতিকে নিশ্চিত করতে হলে নিম্নকক্ষে এবং উচ্চকক্ষে নারীদের সরাসরি ভোটে নারী প্রতিনিধি নির্বাচন করাই হবে অগ্রগতির প্রাথমিক ধাপ। এ ছাড়া সংসদে নারীর আসন ’৭২ সালের সংবিধানে ছিল ১৫, পর্যায়ক্রমে তা ৫০-এ উন্নীত হয়েছে। কিন্তু নারীর অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তায় দৃষ্টান্তমূলক অগ্রযাত্রা নেই। সংবিধান সংস্কার কমিশন নিম্নকক্ষে নারী সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দিয়েছেন। ভবিষ্যতে ৩০০ আসন দিলেও নারী, পুরুষতন্ত্রের বা দলতন্ত্রের অধীনেই পিষ্ট হবে।
নারীদের নিয়ে মায়াকান্না স্থগিত করে রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রার্থী মনোনয়নে ৩০% নারী অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ‘নারী প্রতিনিধি’ নয়-নারী হয়ে দেখার অভিজ্ঞতাই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের পরিমাপক হয়ে উঠবে।
সুতরাং সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থার ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি নারী প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হলে তা হবে খুবই যৌক্তিক এবং ভারসাম্যপূর্ণ।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]