নির্বাচিত কলাম
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন
রাষ্ট্রীয় রাজনীতির নতুন দর্শন
শহীদুল্লাহ ফরায়জী
৫ জুন ২০২৫, বৃহস্পতিবার
‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’-এর সংলাপ একদিকে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দার্শনিক ভিত্তি উপস্থাপন করছে, অন্যদিকে রাষ্ট্র সংস্কারের বাস্তব সম্ভাবনাকেও সামনে হাজির করছে।
স্বাধীনতা অর্জনের পর এই প্রথম-রাষ্ট্রীয় রাজনীতির প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, অন্তর্বর্তী সরকার ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করেছে। এই উদ্যোগ অভূতপূর্ব ও ইতিহাসে বিরল, রক্তস্নাত গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রীয়চেতনা বিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক গুণগত রূপান্তরের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। এর দার্শনিক ভিত্তি সুদূরপ্রসারী। গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রজাতন্ত্র বিনির্মাণের লক্ষ্যে এই কমিশন গঠন-সময়োপযোগী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। এটি একক ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর পরিবর্তে সকল অংশীজন, মত ও শ্রেণি-পেশার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দার্শনিক প্রতিশ্রুতি বহন করে।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে কিংবা ১৯৭৫ সালের একদলীয় শাসনের পূর্বে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গঠনের জন্য এমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। গত ৫৪ বছর জুড়ে আমরা দলীয় বা সামরিক শাসনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। দলীয় রাজনীতিকেই রাষ্ট্রীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ভাবতে শিখেছি। ফলে, রাষ্ট্র সাধারণ জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এর পরিণতিতে দু’জন রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ড এবং সর্বশেষে শেখ হাসিনা সরকারের দেশত্যাগ-সেই ব্যর্থতারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। বহুদলীয় রাজনীতির আড়ালে দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বাসনায় গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। সংসদ কার্যকর হয়নি, রাষ্ট্রের তিনটি প্রতিষ্ঠানের ভারসাম্য সুরক্ষিত হয়নি, গণতান্ত্রিক মনষ্কতা বিকশিত হয়নি এবং প্রকৃত অর্থে একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি।
বাংলাদেশে বহুদলীয় রাজনীতির ইতিহাস মূলত সংঘাত ও রক্তপাতের ইতিহাস। রাষ্ট্রীয় সহিংসতা বহুবার দলীয় উল্লাসে পরিণত হয়েছে। হত্যার শিকার নাগরিকের লাশকে দলীয় রাজনীতি-প্রায়শই রাজনৈতিক অর্জন হিসেবে গণ্য করেছে। ২০২৪-এর গণজাগরণ ও গণবিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ যখন নৈতিকভাবে ভেঙে পড়েছে, তখন ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ রাজনৈতিক বিবেচনা ও মননের দিক থেকে জাতীয় জীবনে এক দিকনির্দেশক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের অভিন্ন অভিপ্রায়-সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারভিত্তিক প্রজাতন্ত্র, এই কমিশনের কার্যক্রমে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। আত্মদানকারী শহীদদের আকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে এই ‘জাতীয় সংলাপ’ এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
সংলাপের ধারণাগত ভিত্তি: অ্যারিস্টটলের ‘Zoom Politikon’ তত্ত্ব রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের এক মৌলিক দার্শনিক ভিত্তি। তার মতে-মানুষ কেবল সামাজিক নয়, সে ন্যায়বিচারপ্রবণ, যুক্তিবান, রাজনৈতিকজীব, যার প্রকৃত বিকাশ ঘটে রাষ্ট্রজীবনে। ভাষা, যুক্তি ও ন্যায়-অন্যায়ের ধারণার ভিত্তিতে মানুষ রাষ্ট্রে মতবিনিময় করে, বিচারবোধ গড়ে তোলে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংলাপের প্রাসঙ্গিকতা গুরুত্বপূর্ণ। যখন রাজনৈতিক দলসমূহ রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেই আলোচনায় বসছে, তখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অ্যারিস্টটলের তত্ত্বের বাস্তব অনুশীলন করছে। তারা সংঘাত নয়, যুক্তির মাধ্যমে মতপার্থক্য নিরসনের পথ খুঁজছে, যা মানুষের প্রকৃত রাজনৈতিক স্বভাবেরই প্রকাশ। এই প্রেক্ষিতে জার্মান দার্শনিক যুর্গেন হ্যাবারমাসের ‘Deliberative Democrac’-এর ধারণা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। হ্যাবারমাস বলেন-গণতন্ত্র কেবল ভোটের ব্যাপার নয়, এটি যুক্তিনির্ভর সংলাপের উপর দাঁড়ানো এক সামাজিক ও নৈতিক কাঠামো। তার ‘Communicative Rationaliti’ অনুযায়ী তথ্যনির্ভর, মুক্ত ও পক্ষপাতহীন আলোচনার মাধ্যমে ন্যায্য সিদ্ধান্ত গঠিত হয়। অংশগ্রহণের মাধ্যমেই রাষ্ট্র বা আইনের বৈধতা সৃষ্টি হয় খবমরঃরসধপু ঃযৎড়ঁময চধৎঃরপরঢ়ধঃরড়হ.
বাংলাদেশে যেখানে গণতন্ত্র এখনো কেবল নির্বাচনকেন্দ্রিক, সেখানে হ্যাবারমাসের চিন্তা দেখায়-গণতন্ত্রের প্রকৃত শক্তি নিহিত জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ, যুক্তিবোধ ও পারস্পরিক বোঝাপড়ায়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে রাজনৈতিক দলসমূহের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ হ্যাবারমাসের এই দর্শনের বাস্তব অনুশীলন। যখন চট্টগ্রাম, খুলনা বা কুমিল্লায় ভিন্নমত নিষ্পেষিত হয়, তখন রাজধানীতে সকলপক্ষ একত্র হয়ে মত প্রকাশ করছে-এটি গণতান্ত্রিক সম্ভাবনার এক সাহসী সূচক। এই উদ্যোগ সহিষ্ণুতা, আলোচনার সংস্কৃতি এবং বহুমতের সহাবস্থানের ভিত্তিতে রাষ্ট্রচিন্তার নতুন ভিত্তি তৈরি করছে। অতীতে রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন কোনো ফোরাম ছিল না, যেখানে ডান-বাম সকল রাজনৈতিক শক্তি একত্র হয়ে সংলাপে অংশ নিতে পারতো।
বধান, নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা ও নিরাপত্তা সংস্কারের মতো মৌলিক বিষয়ে ভিন্নমতের প্রকাশ ঘটাতে এই কমিশন একটি যুগান্তকারী চর্চার ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। এটি ক্ষমতা দখলের কৌশল নয় বরং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে যৌথ চিন্তার ক্ষেত্র। গণতন্ত্র কেবল ভোট নয়-এটি অবিচ্ছিন্ন সংলাপের প্রক্রিয়া।
সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা: এই সংলাপে সমাজশক্তির সরাসরি অংশগ্রহণ অর্থাৎ পেশাজীবী, শ্রমজীবী, কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী, নারী, আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত ছিল। এটি কমিশনের একটি মৌলিক সীমাবদ্ধতা। কারণ, সমাজের প্রকৃত চিত্র রাষ্ট্রে প্রতিফলিত হয় তখনই, যখন সকল শ্রেণির কণ্ঠস্বর সেখানে উপস্থিত থাকে। সমাজশক্তির অংশগ্রহণ ছাড়া ‘জাতীয় ঐকমত্য’ আক্ষরিক অর্থে পূর্ণতা পায় না। ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ যদি সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে প্রজ্ঞা ও দক্ষতার সঙ্গে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে, ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করতে পারে, তবে তা হবে ঐতিহাসিক কর্তব্য সম্পাদন।
ভবিষ্যতের চুক্তির ভিত্তি: কমিশনের কোনো নির্বাহী বা সাংবিধানিক ক্ষমতা নেই। ফলে, এই সংলাপ-প্রক্রিয়া কার্যকর হবে কিনা, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও বাস্তব প্রয়োগের উপর। যদি গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায়কে বাস্তব নীতি ও কাঠামোয় রূপ দিতে ব্যর্থ হয়, তবে তা হবে এক ভয়ঙ্কর আত্মঘাত। এই সংলাপ একটি প্রাক-নৈতিক কাঠামো তৈরি করতে পারে, যার ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে এক নতুন সামাজিক চুক্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। কেবল যদি ক্ষমতা ভাগাভাগি বা ক্ষমতাকেন্দ্রিক হীনস্বার্থে ব্যবহৃত হয়, তবে প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে এক অজানা ও বিপজ্জনক দিগন্তে ঠেলে দেয়া হবে। গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো যদি যথাযথ প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে শাসনব্যবস্থা রূপান্তর করতে ব্যর্থ হয়, তবে বাংলাদেশ কেবল গণতন্ত্রই হারাবে না; হারাবে প্রজাতন্ত্রের নৈতিক ভিত্তিও।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল: [email protected].