ঢাকা, ৬ জুলাই ২০২৫, রবিবার, ২২ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৯ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ

তরুণরা কতোটা নির্বাচন সচেতন?

মো. শাহেদুল ইসলাম
৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার
mzamin

তরুণদের কি আদৌ নির্বাচন নিয়ে আলাদা কোনো আগ্রহ আছে? জাতিসংঘের সংজ্ঞায় যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর তারাই তরুণ। প্রশ্ন উঠছে তরুণরা কতোটা নির্বাচন সচেতন?  আমাদের দেশে নির্বাচন বলতে আমরা প্রথমেই যেটাকে বুঝি সেটা হলো জাতীয় নির্বাচন। স্বাধীনতার পর এদেশে এখন পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তরুণ বয়সে পা দেয়ার পর আমরা প্রথম যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি পেয়েছিলাম সেটি ছিল বহুল আলোচিত “এক এগারো” সরকার আয়োজিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর। আমরা তখন সবেমাত্র স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছি, নির্বাচনের উৎসব আর আমেজটাই তখন আমাদের কাছে মুখ্য, নির্বাচনী হিসাবনিকাশ বোঝার বা এ নিয়ে ভাবার সময় এবং আগ্রহ কোনোটাই তখন ছিল না। তবে স্মৃতিতে নির্বাচন ঘিরে এই দেশের মানুষের চিরচেনা যে উৎসব আর নির্বাচনী আমেজ ২০০৮ এর নির্বাচন আজও আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে আছে। কারণ সেটাই ছিল আমাদের তারুণ্যের শেষ উৎসবমুখর নির্বাচন। 

২০০৮ এর নির্বাচনের সময় কেউই আমরা ভোটার হইনি। আমরা তখনকার তরুণরা প্রথম ধাক্কাটা খাই, প্রথম ভোটার হয়ে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম ভোট দেয়ার সময়ে। ২০০৮ সালে ইতিহাস সৃষ্টি করা ২৩০ আসন নিয়ে বিজয়ী আওয়ামী লীগ এবং মাত্র ৩০ আসন নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে বিএনপি। এরপর যে ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল পরবর্তীতে ২০১৪ এর নির্বাচনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটি হলো ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। এর মাধ্যমে চলমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে এবং সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান করা হয়। মূলত তখন থেকেই বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হয় এবং একই সঙ্গে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তখনকার সময়ে আমাদের তরুণদের প্রথম ভোটটি কেমন ছিল তা খুব সংক্ষেপে বুলেট পয়েন্ট আকারে বলে যাবো; কারণ পরবর্তীতে আমরা ২০১৮ এবং ২০২৪ এর নির্বাচনেরও সাক্ষী হয়েছি। 

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলো ৫ই জানুয়ারি ২০১৪। প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিলো। মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টিও প্রাথমিকভাবে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো, পরবর্তীতে যদিও তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। বিএনপি নির্বাচন প্রতিরোধের জন্য টানা অবরোধ কর্মসূচি দিলো কিন্তু দিনশেষে বিএনপি’র বর্জন সত্ত্বেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। তার মানে কি আমরা তরুণরা সবাই প্রথমবার ভোট দেয়ার সুযোগ পেলাম? ঘটনা মোটেও তেমন হলো না। ২০১৪ এর এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ও এর জোটভুক্ত দলগুলো সহ মাত্র ১২টি দল অংশ নিলো। ভোট অনুষ্ঠানের আগেই ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেল। ভোটের মাঠের যে চিরচেনা লড়াই, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, উৎসব, আমেজ আমাদের তরুণদের সবকিছু মূলত তখনই শেষ হয়ে গেল। তবে এখানেই শেষ না, নির্বাচনী সহিংসতার দিক দিয়েও এ নির্বাচন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২৫শে নভেম্বর ২০১৩ তফসিল ঘোষণার পর থেকে ৪ঠা জানুয়ারি ২০১৪ ভোটের আগের দিন পর্যন্ত নিহত হয় ১২৩ জন এবং ৫ই জানুয়ারি ২০১৪ ভোটের দিন নিহত হয় ১৯ জন। মোটামুটি উৎসব আমেজ ছাড়া ৩০০ আসনের মধ্যে বাকি থাকা ১৪৭টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর আওয়ামী লীগ একাই ২৩৪টি আসন পেয়ে বিজয়ী এবং জাতীয় পার্টি ৩৪টি আসন পায়। সেই সঙ্গে তাদের থেকে মন্ত্রীও করা হয়, তাদের দলীয় প্রধান এরশাদকে করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “বিশেষ দূত”। এভাবে আওয়ামী লীগের দলভুক্ত অন্য জোটভুক্ত দলগুলোও কিছু আসন নিয়ে একটা সরকার গঠন হলো। বিরোধী দল আসলে কে হলো আমরা তখনকার তরুণরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না তখনো। কারণ আগেই বলেছি- এটা ছিল আমাদের তরুণদের ভোটার হিসেবে প্রথম ভোট।

ভোটার আইডি কার্ড হাতে পাওয়ার পর আমাদের তরুণদের প্রথম ভোটটি এভাবে শেষ হয়েছিল। নির্বাচন পরবর্তীতে বিএনপি’র লাগাতার অবরোধ এক সময় গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো। নির্বাচন পরবর্তীতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই আওয়ামী লীগ প্রথম যে বড় কাজটি করলো তা ছিল আইন সংশোধন করে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত নিলো। জাতীয় নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর এবার স্থানীয় নির্বাচনও ভেঙে পড়ার একটা উপক্রম বা বন্দোবস্ত হলো। যাই হোক আমরা স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে কথা বলবো না, আমরা তরুণরা এবার পরবর্তী নির্বাচন অর্থাৎ একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

অবশেষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলো; ২০১৪ সালের মতো ২০১৮ সালেও দলীয় সরকারের অধীনে ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৮ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ চূড়ান্ত হলো। এরই মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত যে ঘটনাটি ঘটেছিল তা হলো একই বছর ৮ই ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলার প্রেক্ষিতে বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এবং নির্বাচনকালীন সময়ে তিনি কারাগারেই বন্দি ছিলেন। এরই মধ্যে বিএনপি’র ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করাটা ঠিক ছিল কিনা- ভুল ছিল সে প্রশ্ন বিএনপিকে তাড়া করে বেড়াতো সর্বক্ষণ। সেই সঙ্গে দলের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়ারও বাধ্যবাধকতা ছিল। বিএনপি’র সঙ্গে কিছু দল যুক্ত হয়ে জাতীয়  ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি রাজনৈতিক জোট গঠন হলো, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই জোটসহ আরও কিছু দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপ করলো এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলো। অবশেষে যথাসময়ে নির্বাচন হলো, আওয়ামী লীগ একাই ২৫৮টি, জাতীয় পার্টি ২২টি, ঐক্যফ্রন্টভুক্ত বিএনপি ৬টি- এভাবে আরও কিছু দল বাকি ১৩টি আসনে জয়ী হলো। এই নির্বাচনে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল ঘোষণার পর কিছু অবিশ্বাস্য ও অভূতপূর্ব ঘটনা দেখা গেল। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে ২১৩টি কেন্দ্রে ভোটের হার শতভাগ। এসব কেন্দ্রে মৃত মানুষের নামেও ভোট পড়ে, যা তীব্র বিতর্কের জন্ম দেয়। ১ হাজার ৪১৮টি কেন্দ্রে ৯৬ শতাংশের উপর ভোট পড়েছে। ১ হাজার ১৭৭টি কেন্দ্রে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা কোনো ভোট পান নি। সুশাসনের জন্য নাগরিকের এক বিশ্লেষণে দেখা যায় ৭৫টি আসনের ৫৮৬টি কেন্দ্রে যত বৈধ ভোট পড়েছে, তার সবগুলোই পেয়েছে ক্ষমতাসীন নৌকা মার্কার প্রার্থীরা। কিন্তু বাস্তবে এবং টেলিভিশনে আমরা দেখছিলাম মানুষ দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও ভোট দিতে পারছে না। দিনের মাঝামাঝি সময়েই একটা আওয়াজ উঠে গিয়েছিল যে, বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট দেয়ার জন্য ব্যালট পেপার নেই। পরবর্তীতে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তার “নির্বাচননামা” বইয়ে এই বিষয়টি তুলে ধরেন এবং এই নির্বাচনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন “এই নির্বাচন জনগণের কাছে রাতের নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে”। এই নির্বাচনটি কেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ছিল তা একটি আসনের ফলাফল তুলে ধরলে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে। নড়াইল-২ আসনে এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা, নৌকা প্রতীক নিয়ে ’১৮ সালের এই নির্বাচনে তিনি ভোট পেয়েছিলেন ২ লাখ ৭১ হাজার ২১০ ভোট যা তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের ৩৪ গুণ। তার নিকটতম প্রার্থী ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ৭ হাজার ৮৮৩। এ নির্বাচনে মাশরাফির ভোটের হার ছিল ৯৬% এবং তার নিকটতম প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। সচেতন মহলে এই ভোট এবং এই রকম ফলাফল নিয়ে তখন অল্পবিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হলেও তরুণ প্রজন্ম ছিল প্রতিবাদহীন আর এতদিনে আওয়ামী লীগ হ্যাটট্রিক জয় নিয়ে জনগণের ধরাছোঁয়ার অনেক উপরে উঠে গিয়েছে।   
আমি আগেই বলেছি- আজকে যে তরুণদের নিয়ে লিখছি তারা ২০০৮ এ সদ্য তরুণ তখনো ভোটার হয়নি, ২০১৪ তে ভোট দিতে পারে নি, ২০১৮ তে আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে ফেলায় আরও একবার ভোটবঞ্চিত হয়। মূলত এরপর তরুণরা সহ দেশের অন্যান্য বয়সী ভোটাররাও ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এরই মধ্যে আমাদের সামনে চলে এসেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং এই নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ হয়েছে ৭ই জানুয়ারি, ২০২৪। এর মধ্যে আমরা তরুণরা তারুণ্যের শেষ বয়সে চলে এসেছি।  ১৫ই নভেম্বর ২০২৩-এ বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর নাম রাখেন ডামি নির্বাচন। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে উৎসবমুখর এবং নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে এই ডামি প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী থিউরি নিয়ে হাজির হয়। ৭ই জানুয়ারির এই নির্বাচনে মোটামুটি অনুষ্ঠান করে আওয়ামী লীগ জাতিকে বোকা বানিয়েছিল। 

আজকে যে তরুণের বয়স ২৯ বছর, ২০০৮ সালে তার বয়স কতো ছিল? পুরো একটা জেনারেশন এভাবে একটা উৎসবমুখর ভোট আয়োজন থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। আজকের দিনে এসে তরুণরা চায় ভোট দিতে। এ অবস্থায় বলতে চাই দ্রুততম সময়ে একটা গ্রহণযোগ্য, উৎসবমুখর নির্বাচন দিয়ে আমাদের ভোটের সংস্কৃতিতে সংযুক্ত করুন।

পাঠকের মতামত

এখন দ্রুত সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান বাধা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়া যাদের কাছে ভোটার নাই তারাই এই পদ্ধতিতে নির্বাচন চাচ্ছে। ভোট দিলাম সন্দ্বীপে এমপি পেলাম মালদ্বীপে। এটা কখনো সম্ভব নয়

সাইফুল আলম ফারুক
৫ জুলাই ২০২৫, শনিবার, ১২:৩২ অপরাহ্ন

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ/ এক যুগ আগে ড. ইউনূসকে যা বলেছিলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status