ঢাকা, ৮ মে ২০২৪, বুধবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

এই সময়ের চিন্তা

সহিংসতার রাজনৈতিক ব্যবহার

রেজাউল করিম রনি
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শনিবার
mzamin

অনেকদিন ধরেই এই দৃশ্যটি আমরা দেখছি- পাইকারি হারে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের আগে এক বা একাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এবং আমাদের ধারণাকে কখনো ভুল প্রমাণ না করেই সরকারের পক্ষে বিনা তদন্তে কে বা কারা এটার সঙ্গে জড়িত, তারা কতো খারাপ তার প্রচারণা শুরু হয়। তদন্তের আগেই দোষী চিহ্নিত হয়ে যায়। কিন্তু এইসব ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত সেই প্রশ্ন সব সময়ই ‘ব্লেইম গেম’ এর রাজনীতির শিকলে আটকে থাকে। কিন্তু তাই বলে এটা মনে করার কোনো কারণ নাই যে জনগণ বুঝতে পারেন না-আসলেই কারা এটার পিছনে আছেন। এই ধরনের ইভেন্ট বা ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে হতে জনগণের কাছে এখন এটার সবগুলো দিক পরিষ্কার হয়ে গেছে। সরকার যখন ক্ষমতায় থাকার জন্য মামলাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তখন মামলার রিজন বা কারণ বা ছুতা হিসেবে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এই ধরনের ঘটনার বেনিফিশিয়ারি ও ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য থেকেও জনগণ বুঝতে পারেন কারা এই ধরনের ঘটনার পিছনে আছেন। 

মোট কথায় ‘ইউজ অব ভায়োলেন্স’ বা সহিংসতার ব্যবহারের বহুমুখী ধরনই বলে দেয় কাদের জন্য এইসব নির্মম ঘটনা জরুরি ছিল। ভায়োলেন্স বা সহিংসতা নিয়ে দুনিয়াতে অনেক তাত্ত্বিক কাজ করেছেন। বিশেষ করে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন-এর ‘ক্রিটিক অব ভায়োলেন্স’ প্রবন্ধটি খুবই বিখ্যাত।

বিজ্ঞাপন
এবং এটার উপর বিরাট এক প্রবন্ধ লিখেছেন ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদা। প্রবন্ধটার নাম- ‘ভালোলেন্স এন্ড মেটাফিজিক্স’। এই লেখায় এইসব জটিল তাত্ত্ব্বিকদের বয়ান ধরে আলাপের সুযোগ নাই।  বাংলাদেশে আমরা দেখি সহিংসতার সময় বিপুল পুলিশ আশপাশে থাকলেও ঘটনার সময় পুলিশের কোনো ভূমিকা সাধারণত দেখা যায় না। সহিংসতাটা ঘটে অরাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে বা সিভিল বা জনপরিসরে। ভুক্তভোগী বা ক্ষতিগ্রস্তরা-  সাধারণ মানুষ। এবং পুলিশের উপস্থিতি আমরা দেখতে পারি ঘটনার পরপরেই। মানে সহিংসতার ঘটনাটির যত রকম ব্যবহার সম্ভব সবই আমরা ঘটনার পরে দেখতে শুরু করি। প্রথমে এই ঘটনার সঙ্গে বিরোধীদের ট্যাগ করে বিনা তদন্তে তাদের দোষী হিসেবে আখ্যায়িত করে মিডিয়াতে ব্যাপক খবর প্রকাশ করা হয়। রাজনৈতিকভাবে তাদের বিচারের আগেই ক্রিমিনাল হিসেবে হাজির করা হয়। সামাজিক ও মানবিক স্তরে তাদের পশু ও জানোয়ারের সঙ্গে তুলনা করে ডি-হিউম্যানাইজ করা হয় এবং এর পরেই নেমে আসে কাঙ্ক্ষিত বা অতি সাধারণ চোখেও অনুমিত রাজনৈতিক ক্র্যাকডাউন। মোটা দাগে সংক্ষেপে এই হলো সহিংসতাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কমন চিত্র। এতকিছু ঘটে গেল কিন্তু মূল প্রশ্নটাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে- কে বা কারা এমন জঘন্য সহিংসতা করে নিরীহ প্রাণ কেড়ে নিলো? এই প্রশ্নের উত্তর আইনিভাবে পাওয়ার অধিকার আমাদের আছে। কিন্তু আমরা তা পাই না। আমরা কেবল দেখি সহিংসতার বহুমুখীন রাজনৈতিক ব্যবহার। মিথ্যা বনাম বিকল্প সত্য: এবারের ডামি নির্বাচনের পরে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ এর পরে দেশে সবচেয়ে সফল ও শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়েছে। আর জনগণ মনে করেন এটি ভোটারবিহীন নির্বাচন। 

এখন যারা জনগণ আর যারা আওয়ামী লীগ-এর নেতাকর্মী-সমর্থক তাদের মধ্যে কারা আসলে মিথ্যা বলছেন? এই নির্বাচনে জনগণ টাটকা অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, ভোট বর্জন করেছে। তারপরেও যখন সরকার দলের নেতারা এভাবে বলেন তখন আসলে কে সত্য বলছেন, আর কে মিথ্যা বলছেন- সেই তর্কই অর্থহীন। আসলে এগুলোকে ‘বিকল্প সত্য’ হিসেবে বলেন। মানে- কথাগুলো রাজনৈতিক পারপাস সার্ভ করলেই হলো। এর কোনো সত্য-মিথ্যা বিবেচ্য বিষয় না। ফলে ক্ষমতাসীনদের চোখে এগুলো ‘বিকল্প সত্য’। আপনি যাকে ভোটবিহীন মনে করেন, লজ্জার মনে করেন, ক্ষমতাসীনরা মনে করে এটা গৌরবের, এটা তাদের অধিকার। এটা পুরস্কার।  নির্বাচনের আগে আগে এক বা একাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটার পরে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার করা হলো। সারা দেশেই নেতাকর্মীরা ফেরারি হয়ে গেলেন। মাঠ ফাঁকা করে নির্বাচন করা হলো। বলা হলো- বিরোধীদের আন্দোলনের শক্তি নাই। এরা আন্দোলন করতে পারে নাই। একটা শন্তিপূর্ণ সমাবেশ তাদের কাছে আন্দোলন মনে হয় নাই। এবং নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কিন্তু সহিংসতার ঘটনাকে ব্যবহার করে। নির্বাচন শেষে সরকারের শপথের পরে আমরা দেখলাম বিরোধী নেতাদের জামিনও হতে শুরু করেছে।  আমাদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে। সরকারি দল বিএনপি বা বিরোধীদল বিষয়ে যা বলে আসলে তা মিন করে না। কারণ তারা বাস করে বিকল্প সত্যের জগতে। মিন করে বরং উল্টাটা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- বিএনপি’র আন্দোলন দমনে সরকার সফল হয়েছে এটা কোনো আওয়ামী লীগের লোকও মনে করে না।

 তারা  একটা ডামি নির্বাচন করতে পেরেছেন এবং তার জন্য বাংলাদেশেকে যে পরিণতি বরণ করতে হতে পারে তার দায়ও এড়াবার সুযোগ নাই। কিন্তু বিরোধী দল অহিংসভাবে যে অসহযোগের ডাক দিয়েছিল তা কার্যত জনগণের নীরব সমর্থনে সফল হয়েছে। কিন্তু সরকার এই ঘটনার উল্টাটা প্রচার করছে। নির্বাচন করাটাই যেন সফলতা! জনগণকে দিয়ে যে নির্বাচনের ভোট বর্জনে বিরোধী দল সফল হলো সেই চিত্রটি আড়ালে চলে যাচ্ছে।  অন্যদিকে ২০১৮ এর নির্বাচনের আগেই প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে আটকে ফেলার কারণে সরকার বিএনপিকে নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে। এবং সফলও হয়। কিন্তু এবার ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। বিপুল গ্রেপ্তারের পরেও বিএনপি রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্রেই থেকে যাচ্ছে। গ্রেপ্তারের কৌশল যে সফল হলো না, দলকে ভাঙা গেল না- এর একটা কারণ হলো, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে লন্ডনে থাকা বেগম খালেদা জিয়ার বড় পুত্রকে অকার্যকর করা যায় নাই। তাই সরকার কথায় কথায় বলে বিরোধী দলের নেতা কে? এই প্রশ্ন যখন আলোচনায় সামনে আনা হয় এর মানে হচ্ছে- বিদেশে থাকাতে তাকে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। নেতা ফাংশন করছে। এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। ঢাকার এক সমাবেশে অডিও ভাষণও দিয়েছেন তিনি। পরে যদিও বিরোদী দলকে জানানো হয় তার সব রকম বক্তব্য প্রচার আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে থাকাতে গ্রেপ্তারের কৌশল শতভাগ সফল হতে পারছে না দেখে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভও লক্ষ্য করা গেছে। 

 নির্বাচনের আগে যেভাবে দলের প্রধান প্রধান নেতাদের ধরে ফেলা হয় তাতে সাধারণ সমর্থকদের মনোবল সহজেই ভেঙে যাওয়ার কথা। নির্বাচনের আগে আগে সরকার আশা করেছিল বিরোধী দলকে ভেঙে ফেলতে পারবে। কিন্তু কার্যত এটাও ব্যর্থ হয়েছে। মনমতো কিংস পার্টি তৈরি করতে পারে নাই।  কে বিরোধী দলের নেতা? এই প্রশ্নের উত্তরের চেয়ে বড় কথা হলো জেলে থাকার চেয়ে বিদেশে থাকা এই প্রযুক্তির যুগে বেশ সুবিধাজনক। বিএনপি যাতে আবার চূড়ান্ত হার্ডলাইনে না চলে যেতে বাধ্য না হয় সেই জন্যদেশে থাকা নেতাদের গ্রেপ্তার করে এখন আবার ধীরে ধীরে জামিনে ছেড়ে দেয়ার কৌশল সরকার যে নিতে পারছে তার কারণ- ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রাজনৈতিকভাবে দলটিকে ফাংশনাল রেখেছেন। জেলে থাকলে তা সম্ভব হতো না। এতে গ্রেপ্তারের রাজনীতির শতভাগ ফায়দা তারা তুলতে পারছেন না। আমরা আগে গ্রেপ্তার বাণিজ্য ও ক্রসফায়ার বাণিজ্য নিয়ে মিডিয়াতে অনেক সংবাদ পড়েছি। কিন্তু এবারের গ্রেপ্তারের রাজনীতি পুরোই ভিন্ন। এটা বলেই শেষ করি। 

  আমি কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব চর্চা পছন্দ করি না। ফলে সরকারের সঙ্গে গোপনে বিরোধীদের একটা আঁতাত হয়েছে আর তাতেই জামিন হচ্ছে এমন মুখরোচক আলাপের দিকে আগ্রহী নই। বেগম খালেদা জিয়া এখনো বন্দি আর বিরোধীদের দাবি একটা নীতিগত অবস্থান অর্জন করে নিয়েছে ইতিমধ্যে। ফলে, ক্ষমতায় না আসতে পারলেও রাজনৈতিকভাবে তাদের অর্জন বিপুল। এখানে আঁতাতে ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু নাই।  বিদেশি চাপ ও সরকারের ভেতরে বাইরে যে হিসেবই কাজ করুক না কেন এই ধরনের চর্চার রাজনৈতিক ভাগ্য ভালো হতে পারে না। হওয়ার সুযোগ নাই। ক্ষমতার প্রয়োজনে গ্রেপ্তার, রাজনীতির প্রয়োজনে জামিন-এই খেলার পরিণতি দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের করুণ চিত্র ও শাসনতান্ত্রিক সংকটকে উদাম করে দিয়েছে। 

লেখক: চিন্তক ও সম্পাদক জবান  

 

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status