ঢাকা, ২ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

আন্তর্জাতিক

নাভালনি: পথের কাঁটা সরিয়ে দিলেন পুতিন!

মোহাম্মদ আবুল হোসেন
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, সোমবারmzamin

তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে পাকিস্তানের নির্বাচন, নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠন নিয়ে নাটকীয়তা, রাওয়ালপিন্ডির কমিশনারের বিস্ফোরক মন্তব্য-পদত্যাগ। সর্বশেষ সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘোর শত্রু অ্যালেক্সি নাভালনির জেলখানায় মৃত্যু। কেউ কেউ বলছেন, পথের কাঁটাকে সরিয়ে দিয়েছেন পুতিন। কারণ, তার শাসনকে নানাভাবে চ্যালেঞ্জ করছিলেন নাভালনি। খুব একটা বয়স হয়নি তার। মাত্রা ৪৭/৪৮ বছর বয়সেই পুতিনের জেলে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে


মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের আবহ। পাকিস্তানে নির্বাচনের ১০ দিন পরে বোমা ফাটিয়েছেন রাওয়ালপিন্ডির কমিশনার লিয়াকত আলি চাত্তা। নির্বাচনে জালিয়াতির যে অভিযোগ তিনি তুলেছেন তাতে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে পাকিস্তানে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুলতান রাজা ও প্রধান বিচারপতি কাজী ফয়েজ ইসার পদত্যাগ দাবি করেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ পার্টি (পিটিআই)। এর কারণও আছে। পিটিআই ভোট জালিয়াতির যে অভিযোগ করে আসছে, তারই প্রমাণ দিয়েছেন লিয়াকত আলি। দৃশ্যত, মনে হচ্ছে এই জালিয়াতি না করলে পিটিআই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতো।  পাকিস্তানের নির্বাচনের ফল ঘোষণায় বিলম্বও সেই জালিয়াতির পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। অন্যদিকে মিয়ানমারে চলছে গৃহযুদ্ধ। তার উত্তাপ বাংলাদেশ সীমান্তে বিরাজ করছে। মিয়ানমারের  ভেতরের সমস্যার কারণে বার বার বাংলাদেশ এভাবে দুর্ভোগে পড়তে পারে না। থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা (৭৪) প্যারোলে মুক্তি পেয়েছেন। ব্যাপক জনপ্রিয় এই নেতা রোববার মুক্তি পেয়ে রাজধানী ব্যাংককে নিজের বাসভবনে চলে যান। উত্তর কোরিয়া তো লম্ফজম্ফ চালিয়েই যাচ্ছে। চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ত্রিপক্ষীয় এক কূটনৈতিক লড়াই চলছে। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের লড়াই চলছে। সব মিলে অস্থির এক বিশ্ব বর্তমান। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে পাকিস্তানের নির্বাচন, নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠন নিয়ে নাটকীয়তা, রাওয়ালপিন্ডির কমিশনারের বিস্ফোরক মন্তব্য-পদত্যাগ। সর্বশেষ সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘোর শত্রু অ্যালেক্সি নাভালনির জেলখানায় মৃত্যু। কেউ কেউ বলছেন, পথের কাঁটাকে সরিয়ে দিয়েছেন পুতিন। কারণ, তার শাসনকে নানাভাবে চ্যালেঞ্জ করছিলেন নাভালনি। খুব একটা বয়স হয়নি তার। মাত্রা ৪৭/৪৮ বছর বয়সেই পুতিনের জেলে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তিনি রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা, আইনজীবী, দুর্নীতিবিরোধী অধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক বন্দি। 

তিনি পুতিনবিরোধী বিক্ষোভ প্রতিবাদ আয়োজন করেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাশিয়ায় সংস্কার, পুতিনের বিরুদ্ধে এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।  রাশিয়ান অপজিশন কো-অরডিনেশন কাউন্সিলের একজন সদস্য ছিলেন এই নেতা।  নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রাশিয়া অব দ্য ফিউচার পার্টির। প্রতিষ্ঠা করেছেন এন্টি-করাপশন ফাউন্ডেশন। তাকে বিবেকের বন্দি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করার জন্য তিনি অভিজাত সাখারভ পুরস্কার জিতেছেন। ইউটিউবে ২০২১ সাল নাগাদ তার ছিল কমপক্ষে ৬০ লাখ সাবস্ক্রাইবার। এসব চ্যানেলের মাধ্যমে তিনি এবং তার দল রাশিয়ার দুর্নীতির বিষয় প্রকাশ করে দিতেন। আয়োজন করতেন রাজনৈতিক প্রতিবাদ বিক্ষোভ। ২০১১ সালে তিনি রেডিওতে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে ক্ষমতাসীন দল ইউনাইটেড রাশিয়াকে ‘ক্রক’ এবং চোরের দল বলে বর্ণনা করেন। তিনি এবং তার প্রতিষ্ঠিত এন্টি-করাপশন ফাউন্ডেশন রাশিয়ার সরকার ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করেন। তা প্রকাশ করতে থাকেন। এসব কারণে তিনি পুতিনের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন। ভ্লাদিমির পুতিন যে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছেন সেখানে অন্য কারও কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সাবেক কেজিবি পুতিনকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস দেখিয়েছিলেন নাভালনি। এ কারণে তাকে বার বার জেলে যেতে হয়েছে। তার ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। নাভালনি মরতে মরতে বেঁচে উঠেছেন। তাকে বিষ প্রয়োগ করার পর অচেতন অবস্থায় বিদেশে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এরপর দেশে না ফিরলেও নিজে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারতেন। কিন্তু রাশিয়ায় যে দুর্নীতি চলছে তা তাকে পীড়া দিয়েছে সব সময়। তাই জীবনের ঝুঁকির কথা জানা সত্ত্বেও তিনি দেশে ফেরেন। তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। 

২০১৩ সালে তাকে অর্থ আত্মসাতের এক মামলায় স্থগিত সাজা দেয়া হয়। তাকে ওই বছর মস্কোতে মেয়র নির্বাচনের অনুমতি দেয়া হয়। এতে তিনি শতকরা ২৭ ভাগ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। এর মধ্যদিয়ে তিনি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ভালো ফল দেখান। কিন্তু পুতিনের মনোনীত ক্ষমতাসীন মেয়র সের্গেই সোবিয়ানিনের কাছে হেরে যান। অর্থ আত্মসাতের মামলায় নাভালনিকে আবারো স্থগিত সাজা দেয়া হয় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। এ দুটি মামলাকে তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে দেখা হয়। এর উদ্দেশ্য, তিনি যেনো ভবিষ্যতে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন। পরে ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস এক রায়ে বলে, নাভালনিকে সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই শাস্তি কখনো বাতিলও করা হয়নি। এরই মধ্যে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় রশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সে জন্য ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি এই নির্বাচনের জন্য প্রচারণা শুরু করেন। কিন্তু তার আগের শাস্তির জন্য নির্বাচনে তাকে নিষিদ্ধ করে রাশিয়ার সেন্ট্রাল ইলেকশন কমিশন। এ আদেশের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেন। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে রাশিয়ান সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রামাণ্যচিত্র ‘হি ইজ নট ডিমন টু ইউ’। এতে দুর্নীতির জন্য তখনকার প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট দমিত্রি মেদভেদেভকে অভিযুক্ত করা হয়। ফলে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়। ২০১৮ সালে স্মার্ট ভোটিং নামে একটি উদ্যোগ শুরু করেন নাভালনি। যারা ইউনাইটেড রাশিয়ার বিরোধিতা করে তাদের ভোটকে সুসংহত করার উদ্দেশ্যে এটা হলো তার একটি কৌশলগত বিষয়।

 নোভিচক নার্ভ এজেন্টের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ করা হয় নাভালনির শরীরে। ফলে মারাত্মক অবস্থায় তাকে ২০২০ সালের আগস্টে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বার্লিনে। একমাস চিকিৎসা দিয়ে তাকে মুক্ত করে দেয়া হয়। তার ওপর বিষ প্রয়োগের জন্য সরাসরি পুতিনকে দায়ী করেন নাভালনি। এ নিয়ে শুরু হয় ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের তদন্ত। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে রাশিয়া ফিরে যান তিনি। সঙ্গে সঙ্গে জার্মানির হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার সময় প্যারোলের শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে তাকে আটক করা হয়। ওদিকে ‘পুতিনস প্যালেস’ নামে আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশ করা হয়। তাতে পুতিনের দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরা হয়। এর ফলে রাশিয়া জুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হতে থাকে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার স্থগিত শাস্তিকে পরিবর্তন করে আড়াই বছরের জেলের রায় দেয়া হয়। 

অর্থ আত্মসাৎ ও আদালত অবমাননার মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে তাকে দেয়া হয় আরও ৯ বছরের জেল। এ রায়কে প্রতারণা হিসেবে অভিহিত করেছে অ্যামনেস্টি। তিনি এর বিরুদ্ধে আপিল করেন। কিন্তু জুনে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। পক্ষান্তরে তাকে স্থানান্তরিত করা হয় উচ্চ নিরাপত্তা যুক্ত একটি জেলে। উগ্রপন্থির অভিযোগে নাভালনিকে আরও ১৯ বছরের জেল দেয়া হয় ২০২৩ সালের আগস্টে। এর অর্থ তার জেলের শাস্তি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০৩৮ সালের ডিসেম্বরে। এরপর নাভালনি দাবি করেন যতদিন তিনি বাঁচবেন অথবা দেশে রাজনীতি করবেন ততদিনই তাকে জেল দেয়া হবে। এক পর্যায়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রায় তিন সপ্তাহ জেল থেকে নিখোঁজ ছিলেন নাভালনি। পরে তাকে ইয়ামালো-নেনেটস অটোনমাস ওকরাগে আর্কটিক সার্কেলে একটি কারাগারে আকস্মিকভাবে দেখা যায়। কিন্তু গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার জেল কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে যে, তিনি জেলখানায় মারা গেছেন। এর প্রতিবাদে দেশে এবং বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়। 

তার মৃত্যুর জন্য পুতিনকে সরাসরি দায়ী করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। পশ্চিমা সরকারগুলো এবং  আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো এ মৃত্যুর জন্য রাশিয়া কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে। সর্বশেষ তার মৃতদেহ নিয়েও নাটকীয়তা বিরাজ করে। তার মা দাবি করেছেন আর্কটিক জেলে নাভালনি মারা গেলেও তার মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলেছে পুতিন প্রশাসন। রোববার এই লেখা যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত তিনি সন্তানের মৃতদেহ পাননি। তবে লাশের পোস্টমর্টেম হওয়ার পরই তা হস্তান্তর করার কথা। নাভালনি টিম বিশ্বাস করছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো নাভালনিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। অধিকার বিষয়ক একটি গ্রুপ বলেছে, নাভালনির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর জন্য ৩০০ নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে কর্র্র্র্র্তৃপক্ষ। ধনী দেশগুলোর সংগঠন জি-৭ এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এই মৃত্যুকে ঘিরে যে রহস্য দেখা দিয়েছে সে সম্পর্কে জরুরিভিত্তিতে পরিষ্কার করতে রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। শুক্রবার জেল কর্তৃপক্ষ নাভালনির মৃত্যুর খবর প্রচার করার পর থেকে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি পুতিন। তবে ক্রেমলিন থেকে বলা হয়েছে, তারা বিষয়টি জানে এবং প্রেসিডেন্টকে জানানো হয়েছে।  

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ/ এক যুগ আগে ড. ইউনূসকে যা বলেছিলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ/ এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status