মত-মতান্তর
রম্য
বইমেলা নিয়ে কাঙ্ক্ষিত-অনাকাঙ্ক্ষিত আলাপ
গাজী মিজানুর রহমান
(১ বছর আগে) ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৬:১৭ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:০৮ পূর্বাহ্ন

গাজী মিজানুর রহমান
চালের আড়তে চাল কিনতে গিয়ে দোকানগুলোর দিকে তাকাই, দেখি থরে থরে বস্তা সাজানো। ৫০ কেজি, ২৫ কেজি, ২০ কেজির বস্তা। ঠিক সেভাবে বই ছাপা হয় ফর্মা অনুযায়ী। এক ফর্মা্র সমান ১৬ পৃষ্ঠা। আমাদের ঝোঁক মোটা কলেবরের, লম্বা দৈর্ঘ্যের, এবং চওড়া প্রস্থের দিকে। গত ফুটবল বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে ঝিনাইদহ, মাগুরা, ময়মনসিংহ জেলার কয়েকজন বাসিন্দা তাদের পছন্দের টিমের দেশের যেসব পতাকা বানিয়েছিলেন, তা লম্বায় কিলোমিটার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এসব নিয়ে উৎসাহের অন্ত ছিল না। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইয়ের প্রতিযোগিতার আয়োজন করলে আমাদের দেশ পুরস্কার পেয়ে যেতে পারে, এতে সন্দেহ নেই ।
দেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য ৪২৪৬ কিলোমিটার। আর দেশের মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। তারা যার যার দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে দুই দিকের অন্যজনের হাত ধরে দাঁড়ালে ১,৮১,৯২৭ কি মি দূরত্ব ঘিরে ফেলা যায়। সেখানে আমাদের সীমান্ত হচ্ছে ৪২৪৬ কিলোমিটার । অর্থাৎ শুধু ভোটারদের দাঁড় করালে সীমান্ত বরাবর ৪২ টা সারি হবে। ভোটার ছাড়াও কিশোর-কিশোরীরা আছে, যারা লাইনে দাঁড়াতে পারে। আমরা সবাই জানি, কোনো এলাকায় ভিআইপি গেলে এদেরকে দিয়েই বেশি বেশি শো-ডাউনের লাইন করা হয়। অতএব কিশোর-কিশোরী-সহ অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা গুনলে লাইনের অবয়ব আরো অনেক বেড়ে যাবে। অতএব, এ বদ্বীপে মানুষ বেশি হলেও এর ভেতর থেকে ভালো কিছু বের করে আনা সম্ভব।
সংখ্যার বিচারে জ্ঞানের আর সংস্কৃতির মাত্রা পরিমাপ না হলেও বিশালত্বের প্রতি একটা সহজাত আকর্ষণ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, আগে দর্শনধারী, পরে গুণ বিচারি। আমাদের বইমেলা আয়তনের দিক দিয়ে আর লোক সমাগমের দিক দিয়ে বিশ্বে উপরের দিকের কয়েকটির মধ্যে রয়েছে। ১৭ কোটি মানুষের দেশ–লেখকের সংখ্যা তো বেশি হবেই। অধিক সংখ্যক লেখকের দেশে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও বেশি হবে। যত বেশি বই প্রকাশিত হবে, তত জ্ঞান, তত সংস্কৃতির প্রসার – অজ্ঞানতা দূরীভূত হওয়া, পুস্তক-ব্যবসায়ের সাথে জড়িত মানুষদের জন্য লাভ আসা- দেশ থেকে অপসংস্কৃতি, অপগণ্ডতা নিষ্ক্রান্ত হওয়া। বইমেলায় মানুষ বেশি হয়েছে বলে বলা যায়, বেশি বই বিক্রি হয়েছে। অনেক বই প্রকাশিত হলে বলা যায়, এর মধ্যে অনেক ভালো বইও প্রকাশিত হয়েছে ।
কিন্তু পরিমাণভিত্তিক সদর্থক চিন্তা এবং অনুমান সবসময় খাটে না। চালের গুদামে বস্তাভরা মোটা চাল থাকলে, তার ওজন বেশি হলেও লাভ কম। হাজার বস্তার মোটা চালের দোকান-মালিকের চেয়ে ৫০০ বস্তার বাঁশমতি চাল বা দিনাজপুরের কাটারিভোগের দোকান-মালিক বেশি বড় মহাজন। আমাদের প্রতিবেশী দেশের কলকাতা শহরে প্রতিবছর বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের মেলা মাস-ব্যাপী চলে, ওদেরটা পনেরো দিনের। দেশ বড়, দেশের মধ্যে নানা ভাষা-ব্যবহারকারী মানুষ রয়েছে, ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলও বড়। তাই ওদের বইমেলার আকর্ষণ বেশি হওয়া স্বাভাবিক। আবার কলকাতা বইমেলা আন্তর্জাতিক মেলা। বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অংশগ্রহণকারীগণ আসেন। আমরাও সেখানে যাই। অন্যদিকে, আমাদের বইমেলা আমাদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য – প্রতিযোগিতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার লক্ষ্য নিয়ে আয়োজিত। তাই এ মেলা জাতীয় মেলা। কিন্তু নিজেদেরকে প্রস্তুত করার উৎকর্ষ অর্জনের বিপরীতে ’আমরা আর মামুরা’ হওয়ার সুবাদে যদি বইমেলায় হালকা মনোবৃত্তির ছাপ পড়ে, বইমেলা গতানুগতিকতার তল্পিবাহক হয়ে পড়ে, লেখক হওয়ার পরে ভাইরাল না হয়ে ভাইরাল হওয়ার পর লেখক সৃষ্টি হয়, পুরোনো লেখক না হয়েই গল্পসমগ্র বা কবিতাসমগ্র প্রকাশের দিকে ঝোঁক আসে, তাহলে তা নিশ্চয়ই সার্বিকভাবে ভালো ফলাফল আনতে পারবে না ।
(রম্যলেখক এবং প্রবন্ধকার )