ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

নিঃশব্দ মৃত্যু- হেলাল উদ্দিনই শেষ নন

যুক্তরাজ্য থেকে ডাঃ আলী জাহান

(৬ মাস আগে) ১৯ অক্টোবর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৩:২৬ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৯:৩২ পূর্বাহ্ন

mzamin

লেখক

. রোগী ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে চায়। সরাসরি কনসালট্যান্টের সঙ্গে। অনেকদিন থেকে ঔষধ দেয়া হচ্ছে, কিন্তু তার Anxiety কমছে না।  বেশ কিছু ঔষধ ইতিমধ্যে দেয়া হয়েছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। তাই রোগী কনসালট্যান্টের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চায়। আমার অধীনে ভর্তি এ রোগীর সঙ্গে মঙ্গলবার কথা বলার কথা ছিল। তাকে ব্যাখ্যা করার কথা ছিল কোন কোন ঔষধ দেয়া হয়েছে এবং কোন কোন ঔষধ বাকি আছে। আদৌ নতুন ঔষধগুলো তাকে দেয়া যাবে কিনা। এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলার জন্য একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু আমি সে অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে পারিনি।

বিজ্ঞাপন
রোগীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছি। হঠাৎ করে একটি মৃত্যু সংবাদ আসায় আমার পক্ষে মঙ্গলবার কাজে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাকে আমি এ শুক্রবার দেখবো। তার সঙ্গে ঔষধ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলবো। সেক্রেটারিকে সেভাবেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করার জন্য বলেছি। এ মঙ্গলবার হঠাৎ করেই আমার মামাতো ভাই হেলাল উদ্দিন বাংলাদেশে মারা যান।


. উনি কোনো রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। বড় কোনো সরকারি-বেসরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না। তাই তার মৃত্যু নিয়ে কোনো কথাবার্তা হয়নি। হবার কথাও নয়। একজন খুব সাধারণ হেলাল উদ্দিনের মৃত্যু আমাদের জন্য শিক্ষনীয় হতে পারে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মৃত্যু হলে এজন্য কাউকে জবাবদিহিতা করতে হয় না। সাধারণ হয়ে জন্ম নেয়াটাই ওখানে একটা পাপ। আর নিজের মৃত্যু দিয়েই  সে পাপের প্রায়াশ্চিত্ত করতে হয়।

 

ককটেল চিকিৎসার শিকার হেলাল উদ্দিন

 

. হেলাল উদ্দিন ছিলেন আমার মামাতো ভাই। ঢাকা মেডিকেল কলেজে যখন পড়তাম তখন মাঝেমধ্যেই উনি ফজলে রাব্বি হোস্টেলে আমাকে দেখতে আসতেন, কিছুদিন থাকতেনও।পড়াশোনা করেছেন ফেঞ্চুগঞ্জ কলেজে।বয়সে কয়েক বছরের বড়। বড় কোনো রোগব্যাধি ছিল না। হঠাৎ করে শরীরে কিছুটা রক্তশূন্যতা এবং লবনের পরিমাণ কমে যায়। বাংলাদেশের ককটেল চিকিৎসায় কয়েক দিনের ভেতরে তার অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়। আইসিইউতে কয়েকদিন থাকার পর দুদিন আগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। চিকিৎসায় অবহেলা ছিল কিনা তা দেখার মতো কেউ নেই। অনেক কষ্ট করে উনার যে চিকিৎসাপত্র ছিল তার একটি কপি জোগাড় করি। উনাকে যে পরিমাণ ঔষধ দেয়া হয়েছে তা সহ্য করে বেঁচে থাকা তার জন্য অসম্ভব ছিল। আমি যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু কারো সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। ‘স্যাররা’ ব্যস্ত। রোগীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। উনাদের ককটেল চিকিৎসায় যে হেলাল উদ্দিন মারা যাননি  তা প্রমাণ করবে কে?  একটা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষকে কেন সামান্য রক্ত এবং লবণশূন্যতায় আইসিইউ-এ ভর্তি করা হবে? ককটেল চিকিৎসার যুক্তি কী? কোনো জ্বর না থাকা সত্ত্বেও তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করলো কারা?
এ ওষুধগুলোর ক্রস রিঅ্যাকশনে যে তার মৃত্যু হয়নি তা আমি নিশ্চিত হই কীভাবে? সিলেটের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রাইভেট হাসপাতালে তার চিকিৎসা হয়েছিল। অবস্থার দ্রুত অবনতি হলে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওখানে আইসিইউতে থাকা অবস্থায় ২৪ ঘণ্টার কম সময়ে তার জীবন প্রদীপ নিভে যায়।

. মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, দু’সপ্তাহের চিকিৎসার জন্য উনাকে তিনটি হাসপাতালে থাকতে হয়। সিলেটের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রাইভেট হাসপাতালে ছিলেন ১২ দিন, আরেক হাসপাতালে ১ দিন আর মৃত্যুর আগে ওসমানী হাসপাতালের আইসিইউতে ১ দিন। তিন হাসপাতালের চিকিৎসার ৯০% একটার সাথে আরেকটা মেলে না। কেন?

. উনার প্রেসক্রিপশন আমি দেখেছি। ইংল্যান্ডের কিছু স্পেশালিস্টের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছি। সবারই একমত। এ ককটেল চিকিৎসাপত্র উনার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে। এ ধরনের চিকিৎসাপত্র এখানে (ইংল্যান্ডে) দিলে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের লাইসেন্স চলে যাওয়ার কথা।

. নামের আগে ডাক্তার লাগানো হয় বাংলাদেশে এমন পেশার সংখ্যা কত? হোমিও ডাক্তার, ইউনানী ডাক্তার, আয়ুর্বেদিক ডাক্তার, ফার্মেসি ডাক্তার… এদের সংখ্যা কত?  এই ভুয়া ডাক্তারদের রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে। আর এ স্বীকৃতির কারণেই এমবিবিএস ডাক্তার নিয়ে মানুষের এক ধরনের অনিহা সৃষ্টি হয়েছে।

.মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু সে মৃত্যু যদি হয়  অচিকিৎসা বা কুচিকিৎসার কারণে তখন কষ্টটা অনেক বেড়ে যায়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে যারা চিকিৎসা পেশার সাথে জড়িত তাদের প্রত্যেককে জবাবদিহিতার অধীনে নিয়ে আসা। তাদের যথাযথ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা।রোগীকে বা রোগীর আত্মীয়-স্বজনকে এ অধিকার দিতেই হবে যে, তারা জানতে পারবে  রোগীকে কেন এবং কোন চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসা নিয়ে যদি প্রশ্ন থাকে তাহলে তাদেরকে বলে দিতে হবে কোথায় অভিযোগ করতে হবে। এর কোনোটাই বাংলাদেশে নেই।

. যতদিন না চিকিৎসা পেশায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত হেলাল উদ্দিনদের মৃত্যু হতেই থাকবে। কাউকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। কোনো অভিযোগ করা যাবে না। কারণ অধিকাংশ মানুষ জানেই না যে, ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়ে তাদের প্রশ্ন করার এবং অভিযোগ জানানোর অধিকার আছে।

. ভালো কথা, চিকিৎসা নিয়ে রোগীর সঙ্গে এ শুক্রবারে যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে সেখানে  যদি আমি তার চিকিৎসা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা না করি তাহলে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার জন্য PALS ( Patient Advice  and Liaison Service) আছে।  বাংলাদেশে? ওখানে নিঃশব্দ মৃত্যুই আপনার নিয়তি|

ডা: আলী জাহান 
কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য।
[email protected]

 

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status