ঢাকা, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

‘অন্তর্ভূক্তিমূলক রাষ্ট্রকাঠামোই জাতীয়তাবাদের উপহার’

ড. মোর্শেদ হাসান খান

(২ দিন আগে) ২৭ এপ্রিল ২০২৫, রবিবার, ৬:১৩ অপরাহ্ন

mzamin

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা প্রবাহমান। বিশেষ করে এই ভূখণ্ডে আগামীর জাতিসত্তা বিনির্মাণে কেমন রাজনীতি প্রয়োজন কিংবা রাজনীতিবিদদের মধ্যে কোন আঙ্গিকের সংস্কার প্রয়োজন, সেটি নিয়ে বেশ যুক্তি-পাল্টা যুক্তি চোখে পড়ছে। একজন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বিষয়টি আমাকেও ভাবিয়েছে।
আমি মনে করি আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর বাংলাদেশকে তার শিকড়ে ফিরে আসতে হবে। জাতি-ধর্ম, গোত্র-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য জাতীয় পরিচয় নির্ধারণ করার এখনই সময়। আমাদের মন ও মগজে ‘নেশন ফার্স্ট’- এই চেতনার প্রবেশ এবং তার সংরক্ষণ যতদিন না সঠিক ভাবে করানো যাবে, ততোদিন আমরা একটি সত্যিকারের দেশপ্রেমিক জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারব না। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থাণ সেই চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছে। এখন সেটি পরিচর্যা করে ছড়িয়ে দেয়ার সময়। আর এ জন্য মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে রাজনীতিবিদদেরই। 

প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের মতে, ‘জাতীয়তাবাদ অন্যের প্রতি ঘৃণা, অপরের বিপক্ষে যুদ্ধোন্মত্ততা, শক্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহার, নিজেদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির শিক্ষা দেয় না।’ তার মতে ‘নেশন’ বা জাতি একটি ‘ইম্যাজিন্ড কম্যুনিটি’ বা অনুধাবন নির্ভর গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় এবং এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ দিন শেষে এই স্বগোত্র-ভাবটিই পরস্পরের প্রতিও ভালোবাসা ও দায়িত্বের মনোভাব জিইয়ে রাখে। 

অ্যান্ডারসনের এই ইম্যাজিন্ড কম্যুনিটির জন্য আত্মবিসর্জনের উদাহরণ দেখতে পাই মুক্তির যুদ্ধে, বহিশত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যোগ দেবার মধ্যে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের স্বৈরাচার বিরোধী গণ-আন্দোলনের ক্ষেত্রেও আমরা অ্যান্ডারসনের এই থিউরির সাযোজ্য খুঁজে পাই।

গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে। আমরা একটি মুক্ত সময় পেয়েছি। পেয়েছি একটি নতুন বাংলাদেশ। যেই বাংলাদেশে আমরা কথা বলছি রাজনৈতিক সংস্কার কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি-পদ্ধতি নিয়ে। সেখানে সরকারের যেমন সমালোচনা করা হচ্ছে, তেমনি সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে শোধরানোরও। অর্থাৎ নাগরিক তার রাষ্ট্রকে পরামর্শ দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এই অন্তর্ভূক্তিমূলক রাষ্ট্রকাঠামোই মূলত জাতীয়তাবাদের উপহার।

চব্বিশের জুলাইয়ে যখন দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় তখন এটি নিছকই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল। ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এই আন্দোলনের ব্যপ্তি ছিলো অনেকটাই সীমাবদ্ধ। মধ্য জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে সারাদেশের শিক্ষার্থী এবং পরে তা সারাদেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে দ্রোহের আগুন জ্বেলে দেয়। এর প্রধান কারণ ছিল, সাধারণ মানুষ একটি বিষয়ে অলৌকিকভাবে একমত হয় তা হলো- দেশ আমার, এই ভূখণ্ড আমাদের এবং আমরা সবাই মিলেই একটি জাতি।

এই জাতিসত্তাকে টিকিয়ে রাখতে হলে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অটুট রাখতে হলে ভারতীয় সেবাদাস ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীটিকে পরাজিত করার কোনো বিকল্প নেই। এই চেতনায় উজ্জীবীত হয়ে দেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরেবন্দরে সকল শ্রেণি-পেশার, সকল বয়সী মানুষ রাজপথে নেমে আসে। তাদের সম্মিলিত প্রতিরোধ ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীটির বুলেটকে পরাস্ত করে বাংলাদেশকে দান করে পুনর্জীবন। পুরো জাতিকে গেঁথে দেয় ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও দায়িত্বের অদৃশ্য বাঁধনে।

১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর এই বিষয়টিকে প্রথমে চিহ্নিত করেন। কেননা একাত্তরে স্বাধীনতা লাভ করলেও আমরা আসলে কোন জাতিসত্তায় বিশ্বে বিকাশ লাভ করব, তা অনেকটাই ছিল অনির্ধারিত। ভাষা ও ভৌগলিক দৃষ্টিকোন থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিচয় আমাদের একচ্ছত্রভাবে পরিচিত করে না। সে কারণে পাহাড় থেকে সমতলের মানুষকে একই ছাতার নিচে রাখতে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তণ করেন। 

এর মাধ্যমে ভাষা থেকে শুরু করে গোষ্ঠী, বর্ণ ও ধর্মীয় বিভাজনের বিতর্কের অবসান ঘটে। এসব পরিচয়ের বাইরে এসে সার্বভৌমত্বের পরিচয় আমাদের কাছে প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমরা ‘এক দেশ-এক জাতি’ পরিচয়ে নিজেদের পরিচয় দিতে গর্ববোধ করা শুরু করি। কেননা এই চেতনা আমাদের একত্রিত করে, ঐক্যবদ্ধ করে। সঙ্কট কিংবা সম্ভাবনায় একে  অপরের পাশে দাঁড়ানোর প্রেরণা যোগায়।

আগেই বলেছি, চব্বিশের গণআন্দোলনের মূল চেতনা ছিলো ‘নেশন ফার্স্ট’ বা সবার আগে জাতি। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিলো ফ্যাসিবাদীদের হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা এবং আধিপত্যবাদী প্রতিবেশীর প্রভাব থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা। দীর্ঘ হাসিনা শাসনামলে এদেশের মানুষ ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য স্পষ্টভাবে দেখেছে। পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভারতের প্রকাশ্য সমর্থন এবং বিরোধী রাজনৈতিক মত দমনে আওয়ামী লীগের দমনমূলক নীতির প্রতি তাদের সহযোগিতা ছিল সুস্পষ্ট। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশটির বিজেপি সরকারকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতেও দেখা গেছে। 

হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে কর্তৃত্বপূর্ণ অধীনতার সম্পর্ক স্থাপন করেছে, যেখানে কার্যত কোনো ন্যায্য দাবি আদায় করা যায়নি। মুখে মুখে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলা হলেও, বাস্তবে এটি ছিল এক প্রকার একতরফা নির্ভরশীলতার সম্পর্ক। এই পরিস্থিতি আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত।

গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে। আমরা একটি মুক্ত সময় পেয়েছি। পেয়েছি একটি নতুন বাংলাদেশ। যেই বাংলাদেশে আমরা কথা বলছি রাজনৈতিক সংস্কার কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি-পদ্ধতি নিয়ে। সেখানে সরকারের যেমন সমালোচনা করা হচ্ছে, তেমনি সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে শোধরানোরও। অর্থাৎ নাগরিক তার রাষ্ট্রকে পরামর্শ দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এই অন্তর্ভূক্তিমূলক রাষ্ট্রকাঠামোই মূলত জাতীয়তাবাদের উপহার।

তরুণ মার্কিন রাষ্ট্রচিন্তক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এডওয়ার্ড স্লোডেনের  মতে, ‘নাগরিকরা সরকারকে ভয় পাওয়ার বদলে সরকারের উচিত নাগরিকদের ভয় পাওয়া’। সে হিসেবে চব্বিশের নতুন এই বাংলাদেশে নাগরিকরা সরকারের সমালোচনা করলে বরং তাতে সরকার ও রাষ্ট্রেরই কল্যাণ। এই সমালোচনা আমাদের রাষ্ট্রের সংস্কার প্রক্রিয়ার জন্য যেমন অপরিহার্য, তেমনি তা প্রয়োজন জাতি ও জাতীয়তাবাদ ধারণার বিস্তৃতি ও শেকড়ের মজবুতির জন্যও।

লেখক: প্রফেসর, মার্কেটিং বিভাগ ও আহবায়ক, সাদা দল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status