মত-মতান্তর
বিশ্ব তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্মেলন: বৈশ্বিক তামাক নিয়ন্ত্রণের অগ্রগতি এবং বাংলাদেশে অবস্থান ও কৌশল পর্যালোচনা
অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী
(১ সপ্তাহ আগে) ১৩ জুন ২০২৫, শুক্রবার, ৮:০৬ অপরাহ্ন

বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্য যখন নানাবিধ সংকটে, তখনও তামাকের মতো মারাত্মক ও বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত ক্ষতিকর পণ্যটির নিয়ন্ত্রণে নেই পর্যাপ্ত অগ্রগতি। অথচ এখনই সময় এই ইস্যুকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে জরুরি ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে তামাকজনিত রোগে মারা যান অন্তত ৮০ লাখ মানুষ। বাংলাদেশেই এই সংখ্যা বছরে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি। এ এক ভয়াবহ চিত্র যা শুধু জনস্বাস্থ্যের নয়, জাতীয় অর্থনীতির ওপরও ফেলে বিপর্যয়কর প্রভাব।
তামাক একটি প্রতিরোধযোগ্য মহাবিপদ, যার ভয়াবহ প্রভাব নীতিনির্ধারকদের কার্যকর উদ্যোগ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমেই ঠেকানো সম্ভব। বিশ্বব্যাপী সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে ২০০৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ২২.৭% থেকে কমে ১৭.৩%-এ নেমেছে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩)। কিন্তু বাংলাদেশে এই অগ্রগতি আশানুরূপ নয়।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এঅঞঝ ও ঝঞঊচঝ জরিপ অনুযায়ী, ২৫–৬৯ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহার মাত্র ১৩% আপেক্ষিক হ্রাস পেয়েছে (৫৪% থেকে ৪৭%)। একই সময়ে ধূমপান ২৭% থেকে কমে ২২% (১৯% হ্রাস) এবং ধূমপানবিহীন তামাক ৩৬% থেকে ৩১% (১৪% হ্রাস) হয়েছে। এই গতি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যানে নির্ধারিত ৩০% হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়।
তরুণদের অবস্থা আরও উদ্বেগজনক। ১৩–১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯.২% তামাক ব্যবহার করে (এণঞঝ, ২০১৩)। দোকানে শিশুদের চোখের সমান উচ্চতায় পণ্য রাখা, ই-সিগারেটকে ফ্যাশন হিসেবে তুলে ধরা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আকর্ষণীয় প্রচারণা এসবই তরুণদের আসক্তির ফাঁদে ফেলছে। জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার স্কুলসংলগ্ন দোকানের ৯৬%-এ শিশুদের নাগালে তামাকপণ্য রাখা হয়। এটি একটি বিপণন কৌশল, যার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আসক্তির ফাঁদে ফেলা হয়।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ। ‘টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি ইন্টারফিয়ারেন্স ইনডেক্স ২০২৩’-এ দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এই হস্তক্ষেপে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে। ঈঝজ-এর নামে কোম্পানিগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করছে। এতে আইন সংশোধনে বিলম্ব, দুর্বল তদারকি এবং প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা ক্রমশ তামাক নিয়ন্ত্রণকে ব্যর্থ করে তুলছে। সব মিলিয়ে এটি জনস্বাস্থ্য ও গণতন্ত্র উভয়ের জন্যই হুমকি।
অন্যদিকে, বিশ্বের বহু দেশ তামাক নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে সাহসী ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। পাকিস্তান ২০২৩ সালে কর বাড়িয়ে তামাক ব্যবহার ১৯.২% কমিয়েছে এবং রাজস্ব বেড়েছে ৬৬%। চীনের ২৪টি শহরে শতভাগ ধূমপানমুক্ত আইন কার্যকর হয়েছে—বেইজিংয়ে লক্ষাধিক ধূমপায়ী কমেছে এবং শিশুদের হাঁপানি কমেছে। মেক্সিকো, উরুগুয়ে, ইউক্রেন কিংবা ইথিওপিয়া—সব দেশই কঠিন বাস্তবতায়ও সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়েছে। আমাদের পিছিয়ে থাকার কারণ আইনের সঠিক বাস্তবায়নে কার্যকর কর্মপরিকল্পনা না থাকা।
তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে এখন যেসব পদক্ষেপ জরুরি: প্রথমত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী অবিলম্বে পাস করতে হবে, যাতে বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ, ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বিলুপ্তি, ই-সিগারেট ও ভ্যাপিং পণ্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা ৫০% থেকে ৯০%-এ উন্নীত করা। দ্বিতীয়ত, সিগারেট কর কাঠামো সংস্কার করতে হবে। বাংলাদেশে বহুস্তরভিত্তিক করব্যবস্থা কর ফাঁকির সুযোগ তৈরি করছে। পাশাপাশি ধূমপায়ীদের সস্তা ব্র্যান্ড বেছে নেয়ার পথ খুলে দেয়। তাই নিম্ন ও মধ্য স্তরের সিগারেট একীভূত করে দাম বাড়ালে কর সহজ হবে, ভোক্তারা সস্তা বিকল্পে ঝুঁকতে পারবে না এবং তরুণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী ধূমপান থেকে বিরত হতে উৎসাহিত হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র গবেষণা বলছে, তামাকপণ্যের দাম ১০% বাড়লে ব্যবহার ৪%–৭% পর্যন্ত কমে। ফলে এই কর সংস্কার জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও রাজস্ব বৃদ্ধির দুটি লক্ষ্যই পূরণ করতে পারবে।
তৃতীয়ত, ডঐঙ ঋঈঞঈ-এর ৫.৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিরোধে একটি সুস্পষ্ট প্রশাসনিক নীতিমালা, কর্মপরিকল্পনা এবং পর্যবেক্ষণ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। চতুর্থত, তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়াসহ সব মাধ্যমে তামাকপণ্যের প্রচারণা ও স্পনসরশিপ নিষিদ্ধ করতে হবে।
পঞ্চমত, স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ থেকে সংগৃহীত অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ তামাক নিয়ন্ত্রণে ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে, যাতে বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়ে। পাশাপাশি, জাতীয় পর্যায়ে তামাক আসক্তি নিরাময়ের লক্ষ্যে কুইটলাইন, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবাদানকারী এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
এমতাবস্থায় এক সময়োপযোগী বার্তা নিয়ে আসছে ২৩–২৫ জুন আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্মেলন (ডঈঞঈ)। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারক, গবেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে আয়োজিত এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য—তামাক নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক অগ্রগতি পর্যালোচনা, উদীয়মান চ্যালেঞ্জ শনাক্ত করা এবং সমন্বিত ও কার্যকর নীতিমালা নিয়ে আলোচনার পথ তৈরি করা। বাংলাদেশের জন্য এটি শুধু আন্তর্জাতিক সংযোগের সুযোগ নয় বরং বাস্তবসম্মত নীতি শেখা এবং প্রয়োগের সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ। এই সম্মেলন এক আয়নার মতো, যেখানে বিশ্ব দেখায় তামাক নিয়ন্ত্রণে কোথায় কতটা অগ্রগতি হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কি এখনো তামাক কোম্পানির ছায়া থেকে বেরিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পক্ষে দাঁড়াবে না?
তাই এখনই সময় সাহসী সিদ্ধান্তের। তরুণদের রক্ষা করতে হবে তামাকের ছলনাময় ফাঁদ থেকে। এটি কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং একটি টেকসই ও সুস্থ জাতি গঠনের পূর্বশর্ত। বিলম্ব মানেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য চরম মূল্য। সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট।