মত-মতান্তর
বেসিক ইনস্টিংক্টঃ জামালপুর থেকে শরীয়তপুর
ডা. আলী জাহান
(১৯ ঘন্টা আগে) ২৬ জুন ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৯:২০ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৯:৫৩ পূর্বাহ্ন

ডা. আলী জাহান।
১. বেসিক ইনস্টিংক্টের (Basic Instinct) গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদানকে লাগাম দিয়ে রাখার কথা ছিল জামালপুরের তৎকালীন (২০১৯) ডিসি জনাব আহমেদ কবিরের। নিজের সরকারি অফিসে নারী নিয়ে একান্তে সময় কাটানোর আগে নিশ্চয়ই তিনি চিন্তা করতে পারেননি যে, তার অপকর্মের ভিডিও ফাঁস হয়ে যাবে। তিনি একান্ত আনন্দে সময় কাটিয়েছেন। অফিস সময়ে একবার নয়, বারবার। সরকারি অফিসের একটি কক্ষে এক নারী নিয়ে একান্ত সময় কাটিয়েছেন। কীভাবে জানি ৪ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের সেই রগরগে ভিডিও সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিভাগীয় অপরাধ ছাড়াও ফৌজদারি (criminal offence) অপরাধ করেন কবির সাহেব। অবশ্য কোনো ফৌজদারি মামলা হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একটি তদন্ত কমিটি করে। সেই তদন্তে আহমেদ কবির সাহেব দোষী সাব্যস্ত হন। আপনারা কি জানেন কবির সাহেবের কী শাস্তি হয়েছিল? Basic question! একটু পরেই উত্তর দিচ্ছি।
২. এবার নাট্যমঞ্চে আরেক ডিসি। শরীয়তপুরের সদ্য ওএসডি হওয়া এ জেলা প্রশাসকের নাম মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন। তিনি তার বেসিক ইনস্টিংক্টের চাহিদা মিটিয়েছেন একটু অন্যভাবে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে তিনি এক নারীর সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে মিশছেন। সেই নারী আবার ওনার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়। সেই নারী তখনও বিবাহিত। আশরাফ সাহেব বারবার এ নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। তাকে বিয়ে করবেন বলে ওই নারী স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছেন। হিসাব নিকাশে কিছু গরমিল হওয়ায় সেই নারী ভিডিও এবং স্থিরচিত্রসহ তার রঙ্গলীলার কাহিনী প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আগের মতো এবারও একটি তদন্ত কমিটি করেছেন। আশরাফ সাহেবকে আপাতত ওএসডি করা হয়েছে। সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া নারী অবশ্য বলছেন আশরাফ সাহেব তাকে বিয়ে করার কথা বলে বারবার ধর্ষণ করেছেন। এখন বিয়ে করতে অস্বীকার করছেন। এখানেও দুটো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। বিভাগীয় অপরাধ এবং ফৌজদারি অপরাধ। পুলিশ এবং আদালত এখানেও নীরব। কেন নীরব?
৩. Basic Instinct (মৌলিক প্রবৃত্তি)-এর আরেক যোদ্ধা ময়মনসিংহ-৩ আসনের সাবেক এমপি এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার, আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন। চাকরি দেয়ার কথা বলে ৩৩ বছর বয়সী এক নারীর সঙ্গে তিনি শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হন। ২০২০ সালের ঘটনা। সাবেক এই এমপির সেই রগরগে ভিডিও ক্লিপ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। না বিভাগীয়, না ফৌজদারি-তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। ভুক্তভোগী নারী থানায় মামলা দিতে গেলে তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ বিশিষ্ট যোদ্ধা এবং এমপি অবশ্য তৎকালীন সংসদে বাংলাদেশে ইউটিউব বন্ধ করে দেয়ার অনুরোধ করেছিলেন।
৪. জেলা প্রশাসক আহমেদ কবিরের (জামালপুরের সাবেক ডিসি, ২০১৯) বিরুদ্ধে যে বিভাগীয় শাস্তি গ্রহণ করা হয় তা অদ্ভুত। তার চাকরি জীবনে আর কোনো প্রমোশন হবে না এবং তাকে এক গ্রেড নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি উপসচিব থাকবেন। বেতন পাবেন সিনিয়র সহকারী সচিবের সমান। ব্যাস এইটুকুই। এখানেই শেষ।
৫. দুই সাবেক ডিসি এবং এক সাবেক এমপি basic Instinct-এর যে সাগরে হাবুডুবু খেয়েছেন তাকে আইনের ভাষায় অপরাধ বলে। বিভাগীয় অপরাধ এবং ফৌজদারি অপরাধ। ধর্ষণ এবং adultery দুটোই বাংলাদেশি আইনে গুরুতর অপরাধ। একজনের বিভাগীয় শাস্তি হয়েছে, একজনের হয়তো হবে এবং আরেকজন ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকায় এর কোনটাই তাকে স্পর্শ করেনি।
৬. প্রশ্ন হচ্ছে যে ফৌজদারী অপরাধ কি সরকারি কর্মকর্তাদের বা মন্ত্রী এমপিদের ক্ষেত্রে অপরাধ নয়? একই অভিযোগে গায়ক নোবেলদের বা মাঝেমধ্যে আবাসিক হোটেলে পুরুষ-নারীকে গ্রেফতার করা হলে, ফৌজদারি মামলা করা হলে, উপরোক্ত তিন ব্যক্তি কীভাবে এর বাইরে অবস্থান করেন?
৭. সরকার কি দেশের মানুষকে একটি কঠিন বার্তা দিচ্ছে? আর এই বার্তা হলো যে আইন সকলের ক্ষেত্রে সমান নয়। যদিও সংবিধান নামক কিতাবে বলা আছে আইনের দৃষ্টিতে দেশের সকল নাগরিক সমান।
৮. আশরাফ এবং কবির সাহেবরা সমাজের মেধাবী অংশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। গৌরীপুরের এমপির কথা বাদ দিলাম। জেলা প্রশাসক এবং সরকারের সকল কর্মচারী কর্মকর্তাদের মনে রাখা উচিত যে আপনারা যা শুরু করেছেন তাতে শুধু আপনাদের কলিগরা নন, দেশের সাধারণ মানুষও লজ্জিত, বিব্রত এবং মর্মাহত। বেসিক ইনস্টিংক্টকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেই বলে মানুষ ‘মানুষ’ হয়ে ওঠে। নিয়ন্ত্রণ না থাকলে মানুষ আর পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। মানুষ আপনাদের কাছে ‘মানুষ’ হওয়ার শিক্ষা ও আদর্শ খোঁজে, যদিও আপনাদের সঙ্গে যায় আসে না। আপনাদের কেউ কেউ প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে মনুষ্যের কাতার থেকে সরে যাচ্ছেন। সরে যেতেই পারেন। আপনাদের ইচ্ছা। রাষ্ট্র এর আগে আপনাদেরকে কিছু করতে পারেনি। এবারও কি কিছুই করতে পারবে না?
লেখক: কনসালট্যান্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য
পুলিশের সাবেক সার্জন, যুক্তরাজ্য পুলিশ
সাবেক সরকারি কর্মকর্তা (বিসিএস স্বাস্থ্য)
[email protected]
পাঠকের মতামত
ধন্যবাদ স্যার সুন্দর একটি আরটিক্যাল লেখার জন্য। পরিবর্তীত বাংলাদেশে এই কাল্চারের পরিবর্তন চাই।
বাংলাদেশের আইন হলো গরীব মানুষদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য।