মত-মতান্তর
মানুষ গড়ার নিভৃতচারী এক কারিগরের নিঃশব্দ প্রয়াণ
সিরাজুল ইসলাম কাদির
১৭ জুন ২০২৫, মঙ্গলবার
কৈশোরের কথা। শিক্ষক পিতার হাত ধরে গ্রামের স্কুলে আসা-যাওয়া করি। পথে যেতে যেতে তিনি আমাকে নানারকম কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। আমাকে দিয়ে মুখস্থ করাতেন। এ রকম একটি কবিতা ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’। কাজী কাদের নেওয়াজের লেখা।
কবিতার বিষয়বস্তু ছিল এ রকম: একদিন প্রভাতে দিল্লির বাদশা আলমগীর পায়চারি করার সময় দেখতে পান তার পুত্র শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে। আর শিক্ষক নিজের হাতে পায়ের সকল মালিন্য পরিষ্কার করছেন। তিনি এটা দেখার পর নিজের মসনদে ফিরে গেলেন। পরের দিন পুত্রের এই গুরুর দরবারে ডাক পড়লো। শিক্ষকের বুঝতে আর কষ্ট হলো না যে আজ আর তার রক্ষা নেই। কবির ভাষায় পুরো কাহিনী শোনা যাক:
বাদশাহ আলমগীর-
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধূলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।
শিক্ষক মৌলভী
ভাবিলেন, আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝি তাঁর সবি।
দিল্লীপতির পুত্রের করে
লইয়াছে পানি চরণের পরে,
স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন্ কালে!
ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তাঁর ভালে।
হঠাৎ কী ভাবি উঠি
কহিলেন, আমি ভয় করি না’ক, যায় যাবে শির টুটি,
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,
ভয় করি না’ক, ধারি না’ক ধার, মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে।
তার পরদিন প্রাতে
বাদশাহর দূত শিক্ষককে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে।
খাস কামরাতে যবে
শিক্ষককে ডাকি বাদশা কহেন, শুনুন জনাব তবে,
“পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,
নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা”
শিক্ষক কন-“জাহপানা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়,
কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?”
বাদশাহ্ কহেন, “সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালণ,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।”
উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
“আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।”
আমার পিতা একজন শিক্ষক ছিলেন। অর্থ-সম্পদ কিংবা জৌলুস কোনো কিছুর প্রতি তার মোহ ছিল না। আজীবন গ্রামের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। এতেই তিনি পরম আনন্দিত ও পরিতৃপ্তি লাভ করতেন। বৈবাহিক জীবনে আমার শিক্ষিকা শাশুড়ির মধ্যে সেই একই আদর্শের প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়েছি। কি সুশৃঙ্খল জীবন। কোনো অহংকার নেই। দম্ভ নেই। যা আছে তা হলো সেই সম্মানবোধ।
কবির ভাষায় সেই দুই চরণ-
‘আজ হতে চির উন্নত হ’ল শিক্ষাগুরুর শির
সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’
১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসে আব্বার ইন্তেকালের পরে আমার এক সময়কার কর্মস্থল দৈনিক সংবাদে নিজ হাতে একটি সংবাদ লিখি। সংবাদটি পরের দিন দৈনিক সংবাদের তৃতীয় পাতায় সিঙ্গেল কলামে ছাপা হয়। প্রায় গুরুত্বহীনভাবে ব্যবহৃত ও মুদ্রিত সেই সংবাদের শিরোনাম ছিল- ‘একজন মহতী শিক্ষকের প্রয়াণ’। এরপরের দিন এই ছোট্ট, নজর না কাড়া সংবাদটি নিয়ে সংবাদ সম্পাদকীয় লেখে। সম্পাদকীয় কলামের বিষয়বস্তুতে শিক্ষক, বিশেষ করে একজন আদর্শ শিক্ষকের সমাজের জন্য কতো প্রয়োজন তা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। একজন শিক্ষক কীভাবে প্রকৃত অর্থে মানুষ গড়ার কারিগর হয়ে উঠেন সেই আলোচনা ছিল লেখার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে।
১৯৮৭ থেকে ২০২৫- দীর্ঘ ৩৮ বছর পর একজন আদর্শবান, মহতী শিক্ষকের প্রয়াণের সাক্ষী হই গত মে মাসে। নাম তার গোলাম রহমান। ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক। ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ এবং ইডেন কলেজসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কলেজে অধ্যাপনা করেেেছন। আত্মীয়তা সূত্রে এই শিক্ষককে প্রায় ৯ বছর কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। তিনি ছিলেন মৃদু ও মিতভাষী, নিভৃতচারী, পাঠানুরাগী এবং স্নিগ্ধ স্বভাবের। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক শামীম আল মামুন ছিলেন তার একজন ছাত্র। একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, “স্যারের ক্লাসে আমাদের মনোযোগ ধরে রাখতে হতো। তিনি শ্রেণিকক্ষে এসে এক মুহূর্তও অপচয় করতেন না। এমনভাবে পড়াতেন যেন বিষয়টি আমাদের জন্য সহজবোধ্য হয়ে উঠতো। শেকসপীয়র, টি. এস. ইলিয়ট, রোমান্টিক কবি শেলী এবং জন কীটস-তাদের রচনাগুলো তিনি আমাদের কাছে এতটাই মনগ্রাহী করে উপস্থাপন করতেন যেন মনে হতো কেউ একজন বাচ্চার হাতে চকলেট তুলে দিচ্ছে, আর সেই চকলেট মুখে পুরে অনায়াসে স্বাদ গ্রহণ করছে। তার কারণেই পরবর্তীতে আমি মিল্টনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। অমায়িক ব্যবহারে তিনি ছিলেন খুব স্নেহবন্ত একজন মানুষ এবং জ্ঞান বিতরণে ছিলেন এক অক্লান্ত সাধক।”
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন ঢাকা কলেজে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “কলেজের প্রশস্ত বারান্দায় চলাচলের সময় তার সাক্ষাৎ পেতাম। সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবি ছিল তার পোশাক। স্মিত হেসে কুশলাদি জানতেন। স্বভাবে নিভৃতচারী অধ্যাপক গোলাম রহমান গল্পবাজ ছিলেন না। তাই কখনোই তার সঙ্গে আমার খুব একটা অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়নি। তিনি ছিলেন সদালাপী এবং প্রতিটি মুহূর্ত পড়াশোনা ও ছাত্রদের পাঠদানে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। তিনি ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের আর আমি বাংলার-সে কারণেও হয়তো তার সঙ্গে তেমন একটা মেলবন্ধন রচিত হয়নি।”
দীর্ঘ শিক্ষক জীবনে তিনি নিজের আদর্শ আর দৃষ্টিভঙ্গির আদলে চার সন্তানকে গড়ে তুলেছেন। তারা আজ নিজ নিজ কর্মস্থলে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছেন। এ প্রসঙ্গে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ড. আমিনুর রহমান বলেন, ‘আব্বা একা বই পড়তেন না। মাকেও তার সহপাঠী করে নিতেন। আমাদের ইংরেজি সাহিত্যের যারা দিকপাল তাদের লেখা বই পড়ে শোনাতেন, এভাবে আমাদের কান ও মনকে প্রস্তুত করে দিয়ে গেছেন।’
অধ্যাপক রহমান ৯১ বছর বয়সে গত ২৮শে মে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অসীমের পথে পাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু এই বিশ্বচরাচরে তিনি রেখে গেছেন তার যোগ্য অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। যারা আগামী দিনে তার আলোর শিখা শুধু নিজেদের মধ্যে নয়-উত্তরসূরির মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়ে জীবনকে করবেন আলোকিত, দ্যোতনাময়। হয়তো কোনো একদিন তার কোনো এক উত্তরসূরি কণ্ঠ উঁচু করে বলবেন-
‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন ছার...।’
লেখক: রয়টার্সের সাবেক ব্যুরো প্রধান এবং বর্তমানে অ্যামচ্যাম জার্নালের সম্পাদক।