ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

পহেলা বৈশাখ সাম্য বৈচিত্র্য উদযাপনের সংস্কৃতি

অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

(১ সপ্তাহ আগে) ১৩ এপ্রিল ২০২৫, রবিবার, ৮:৫৭ অপরাহ্ন

mzamin

পুরনোকে বিদায় দিয়ে নতুনকে বরণ করে নেয়াই মানুষের সহজাত প্রবণতা। এই প্রবণতা বাঙালির মধ্যেও রয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস হাজার বছরের। আর বাঙালির জীবনে সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ। সমৃদ্ধ এই সংস্কৃতির সঙ্গে বর্ষবরণ উৎসব নিবিড়ভাবে জড়িত। বাংলা নববর্ষ যেমন সুর ও সংগীতের, মেলা ও মিলনের, আনন্দ অবগাহনের, তেমনিই সাহস ও সংকল্পের। নতুন প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যাশায় বুক বেঁধে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায় বাংলা নববর্ষ। বৈশাখের স্পর্শে যেন আনন্দের কোলাহল জেগে ওঠে সারাদেশের সর্বত্র। এক প্রাণচাঞ্চল্যে দুর্দমনীয় গতির ঘোড়ায় আসে বৈশাখ। এসেই সর্বদিকে তোলপাড় করে। বৃক্ষ থেকে বাতাস পর্যন্ত অন্যরকম দোলায় দুলতে থাকে। প্রকৃতির সকল কিছু যেন ব্যস্ততায় মেতে ওঠে। এলায়িত অবয়বে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন স্বাগত জানায় বৈশাখি নব আনন্দের দিনকে। মানুষ পরিবর্তন ভালোবাসে খুব। এক জায়গায় কিংবা এক রকমের গতি মানুষের সয় না। নিত্যদিন মানুষেরা নতুনের সন্ধান করে। মানুষের এ চাওয়াও চিরকালীন। প্রতিটি দিনকে মানুষ আলাদা করে দেখতে ভালোবাসে। আলাদা আয়োজনে উদ্যাপন করতে চায় জীবনের প্রতিটি সকাল। যেভাবেই হোক মানুষের জীবনের প্রতিটি দিন আলাদা। প্রতিটি সকাল আলাদা। প্রতিটি দুপুর কিংবা সন্ধ্যা অথবা রাত আলাদা। গতকালের সমস্ত বৈশিষ্ট্য গতকালই নিয়ে যায়। চলে যায় অতীত নামক মহা সমুদ্রের দিকে। আজ যা ঘটে তা আগামীকাল কিছুতেই ঘটে না। এভাবে মানুষের জীবনে বদলে যায় সব। নতুন হয়ে আসে সব কিছু। বৈশাখ সেই নতুনকেই আহ্বান জানায়। সেই বদলকেই নিয়ে হাজির হয়। আমাদের জাতীয় কবির উচ্চারণে তারই দুর্দান্ত প্রতিধ্বনি শুনি 
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে
কালবোশেখীর ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর।
এই যে নূতনের কেতন ওড়ে এটাই আনন্দের। এটাই উৎসাহের। এটাই সাহসের। সাহসই মানুষকে নতুন পথে তুলে দিতে সাহায্য করে। নতুনেরজয়গানে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষ গায়। নতুন করেই গায়। হোক পুরোনো গান কিন্তু কণ্ঠে বাজে নতুন করেই। নতুনের এই চির চেতনার ধ্বনি বৈশাখে তাইযেন প্রকাশিত হয়। পহেলা বৈশাখ পরমতসহিষ্ণুতা, সদ্ভাব, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং বিবেক ও মনুষ্যত্বের দীক্ষা দিয়ে যায় আমাদের। তাই তো আমরা বলে উঠি- 'প্রাণে প্রাণে লাগুক শুভ কল্যাণের দোলা, নব আনন্দ বাজুক প্রাণে'। আজ 'মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা'। বৈশাখের প্রথম সকালে রাজধানীর রাজপথে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে মঙ্গল উচ্চারিত হতো- 'মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে'। বৈশাখের আছে বাইরের এক সাজ, সে সঙ্গে আছে অন্তর্জগৎ। বাইরের সাজ আমাদের নজর কাড়ে প্রবলভাবে, সেটা নিয়ে বাদ-বিসম্বাদও কম নেই। কিন্তু ভেতরের তাৎপর্য থাকে অনেকটা আড়ালে। ১৯৬৭ সালে পহেলা বৈশাখ প্রভাতে রমনার পাকুড় ছায়াতলে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলসহ বাঙালির চিরায়ত গান, কবিতায় বর্ষবরণ ছিল অভিনব আয়োজন, যা আলোড়িত করে জাতির চিত্ত। পহেলা বৈশাখের ভিন্নতর জাগরণী শক্তি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে পৌঁছে দিয়েছিল একাত্তরের মহান সংগ্রামের দুয়ারে যা আমাদের এনে দিয়েছিল মহান স্বাধীনতা ।

পূর্ব বাংলার বাঙালি তার শিকড় অনুসন্ধান করে নতুনভাবে সাজায় বাংলা নববর্ষের উৎসবকে। সুদীর্ঘ ৫৬ বছরে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। রমনা বটমূলের এ নববর্ষ উদ্যাপন এখন সারাদেশ ও বাঙালি অধ্যুষিত বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। লাখ লাখ বাঙালি বাংলা নববর্ষে পথে নেমে পড়ে। নতুন জামাকাপড় পরে এক উজ্জ্বল সকালে তাদের আনন্দঘন উপস্থিতি বাঙালির অস্তিত্বের জানান দেয়। পাশাপাশি চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের এক অসাধারণ অগ্রযাত্রার প্রতীক বাঙালির এসব আয়োজন। এই ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা ‘ছায়ানট’ (১৯৬১)-এর। ছায়ানট সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটি রমনার বটমূলে ১৯৬৭ সাল থেকে চালু করে নববর্ষের এই উৎসব। এই উৎসব বাঙালির জাতিসত্তার সঙ্গে যুক্ত বলেই অতি দ্রুত তা জনপ্রিয় হয় এবং প্রতিবছরই বিশাল থেকে বিশালতর হয়ে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের উৎসব হয়ে ওঠে। নানা ডিজাইনের রং-বেরঙের পাঞ্জাবি-পায়জামা-শাড়িতে সজ্জিত বাঙালি পুরুষ-নারীর বিপুল সমাগমে এই উৎসব এখন বাঙালির সর্ববৃহৎ জাতীয় অনুষ্ঠানে রূপ লাভ করেছে। এই উৎসব একসময় গ্রাম থেকে গ্রামে শুরু হয়েছিল কিন্তু পরে আর খুব বড়ো আকার গ্রহণ করেনি। এখন এই উৎসব গ্রাম থেকে বর্ণাঢ্য সাজে সজ্জিত হয়ে রাজধানী ছাড়িয়ে বিভাগ, বিভাগ ছাড়িয়ে জেলা, জেলা ছাড়িয়ে উপজেলা এবং গ্রাম পর্যন্ত নব আঙ্গিকে এবং নব সাজে চালু হয়ে গেছে। এই উৎসব বাঙালি জীবনে যে আনন্দ বয়ে আনে, তার তুলনা বিরল। জীবন তৈরি হয় স্থান, কাল ও পাত্রের চালচিত্রে। আর জীবন এক জায়গায় থেমে থাকে না; সমাজের মানুষ জ্ঞাতসারে কী অজ্ঞাতে পালটাতে-পালটাতেই এগিয়ে যায়। কালস্রোতে মানুষের দৃষ্টিকোণ পরিবর্তিত হয়, সামাজিক আচরণ ও অভ্যাসে ভিন্নতা আসে, শিল্পের সাধনায় বৈচিত্র্য দেখা দেয়, মোড়বদল ঘটে। খাদ্যের অভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, বান্তুনির্মাণ, ভাষা, ধর্ম, সামাজিক সংস্কার, এমনকি কুসংস্কারও এবং মনের গড়ন ও কল্পনার ধাঁচ সবই একটি জাতির সাংস্কৃতিক উপাদান।

কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ার কারণে উৎসব-পালাপার্বণের সঙ্গে উৎপাদন ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। জীবনকে বাদ দিয়ে তাই সংস্কৃতির অস্তিত্ব নেই। বাঙালি সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশে অনেকে পহেলা বৈশাখে নববর্ষের উন্মাদনায় বাউল বা বৈরাগীর বেশ ধারণ করে। কিন্তু যাদের কারণে, যাদের শ্রমে, যাদের মেহনতে, যাদের ঘামে, যারা রোদে-পুড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে, ঝড়ের সঙ্গে মাঠে লড়ে, ঝড়ঝাপটা, বন্যা-খরা-দুর্যোগ সামাল দিয়ে মাঠে ফসল ফলায়; সেসব খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের খবর আমরা কজনে জানি বা রাখি। যারা দেশ জাতি ও সমাজের মানুষের মুখে দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগান দেন, তারা আমাদের কৃষক জনগোষ্ঠী। বাংলা নববর্ষের এই লগ্নে একবারও কি ভাবা যায় না, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষকরা কেমন আছেন? উৎপাদন ব্যয় কতটুকু বেড়েছে? তবে এটা ঠিক বাংলা নববর্ষের ভেতর দিয়ে মূলত দেশের আপামর জনসাধারণ নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন করে চলেছে। পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্য দিয়ে এ দেশের নর-নারী এ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নতুবা আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলার ঐতিহ্য লোকসংস্কৃতির কিংবা বাংলা ঋতুর কথা ভুলেই যেত। করোনাভাইরাস মোকাবিলা করে বাংলা নতুন নববর্ষে অমিত সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। দেশ ও জাতির মঙ্গলে জনগণের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত দেশপ্রেম জাগ্রত হোক, খুলে যাক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। বাংলা নববর্ষে এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

বৈশাখের সঙ্গে অর্থনীতির যোগ তো সব সময়ে ছিল নিবিড়, বিশেষভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে তার প্রকাশ দেখি মেলায় এবং শহুরে অর্থনীতিতে হালখাতায়। বৈশাখের এই অর্থনীতির বিকাশ ঘটছে জাতীয় আর্থিক ্রপ্রবৃদ্ধির সঙ্গে মিল রেখে। বৈশাখি সজ্জা এক্ষেত্রে এক ইতিবাচক পরিবর্তন, যেখানে তরুণরাই এর রূপকার। বৈশাখের সাজ ও রঙের মধ্য দিয়ে তারা বাঙালিয়ানার রূপ খুঁজে ফিরছেন এবং তার নবউদ্ভাসন ঘটাচ্ছেন। আনন্দ শোভাযাত্রাও একেবারে হালের বিষয়, যা ক্রমেই সার্বজনীন আনন্দ-উৎসবে রূপ নিচ্ছে দেশব্যাপী বিস্তার ঘটিয়ে। সরকার বৈশাখি উৎসব-ভাতা প্রবর্তন করে এর অর্থনীতি আরো সচল করতে ভূমিকা পালন করছে, সেটাও সুলক্ষণ। বৈশাখি উৎসব বাঙালি জাতিকে যে গৌরবের প্রান্তরে দাঁড় করায় তা সার্থক করে তুলতে হলে এর অন্তরের দিকে আমাদের আরো গভীরভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। অন্তর্গতভাবে বৈশাখ হচ্ছে সার্বজনীন, সব ধর্ম ও মতের বাঙালির এক হওয়ার পণ ও পন্থাÑ যে বাঙালি স্বভাবগতভাবে মিলনে-মিশ্রণে গড়ে ওঠা অসাম্প্রদায়িক মানবসত্তা তথা জাতিসত্তা। এই সম্প্রীতি চেতনা ও সর্বধর্ম সমন্বয়ী ধারা বৈশাখের মর্মবাণী, আজকের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে যা হয়ে উঠেছে আরো গুরুত্ববহ। বৈশাখি উৎসবের শক্তিময়তা এখানেই নিহিত। এর বাস্তবায়নে বৈশাখ কতভাবে কতরূপে ভূমিকা পালন করতে পারে সেটাই বড়ো বিবেচ্য। আর সেজন্য প্রয়োজন বৈশাখি উৎসবের প্রতি আরো নিবিষ্ট মনোযোগ ও গভীর বিবেচনা প্রদান।
 

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)
মহাখালী, ঢাকা।

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status