ঢাকা, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

প্রিয় বন্ধু ইফতেখারুল ইসলাম

ফরিদুর রেজা সাগর
২৬ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার
mzamin

আমরা সাধারণত যাদের সম্পর্কে লেখালেখি করি তাদেরকে নিয়ে যুক্তিতর্ক থাকে। আমি যাকে নিয়ে কথা বলছি বা লিখছি তার সম্পর্কে কেউ জোর করে বলবে তেমনটি নয়। কিন্তু আমি আজ আমার যে প্রিয় বন্ধুটির কথা ভাবছি বা লেখা শুরু করছি তখন দেখছি এই জীবনে এখন পর্যন্ত সে যে কাজগুলো করেছে, সে যেভাবে তার জীবনযাপন করছে তার মতো যদি কেউ একটি কাজও করে থাকে তাহলে আমরা তাকে বাহবা দিচ্ছি। তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকি। অথচ আমাদের সমাজে অনেক মানুষ আছে যিনি নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন আমরা হয়তো সবার খবর জানার সুযোগ পাই না। আজ যার সম্পর্কে বলতে চাচ্ছি, সে অনেক প্রতিভাবান। আমার বাল্যবেলার বন্ধু। সে এত কাজ করেছে যে, সেগুলো স্মরণ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে যে, আমার এই বন্ধু ইফতেখারুল ইসলাম সম্পর্কে অনেক আগেই লেখা উচিত ছিল। ইফতেখারের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ বা পরিচয় দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে। ঢাকা স্টেডিয়াম মার্কেটে একটা বইয়ের দোকান ছিল। এই দোকানটির নাম ছিল ম্যারিয়েটা পরে এটার নাম হয় আইডিয়াস। সেই বইয়ের দোকানে আমরা যেতাম বিশেষ করে স্কুল- কলেজ ছুটির পরে। সেখানে দেশের বইয়ের পাশাপাশি প্রচুর বিদেশি বই আসতো। এই বইয়ের দোকানের পাশে আরেকটি বড় দোকান ছিল যেখানে রাশিয়ান বই রাখা হতো। আমরা বই কেনা ও নতুন বইয়ের খবর নেয়ার জন্য নিয়মিত যেতাম। এই দোকানটা তুলনামূলকভাবে একটু ছোট ছিল। প্রচুর ভারতীয় বই, ম্যাগাজিন, পূজা সংখ্যা পাওয়া যেতো। এই দোকানেই ইফতেখারের সঙ্গে আমার আলাপ। একদিন দেখলাম দেশ পত্রিকার একটি সংখ্যা নাড়াচাড়া করছে। কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে রেখে দিতো। কারণ তখন এইসব পত্রিকার যে দাম ছিল সেটা কেনার মতো সামর্থ্য আমার তো নেই-ই আমার অনেক বন্ধু-বান্ধবেরও ছিল না। ইফতেখার তখন থাকতো বঙ্গভবনে। তার বাবা সেখানে চাকরি করতেন সেই সুবাদে তারা বঙ্গভবনে থাকতো। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার আরেকটি কারণ ছিল এই বঙ্গভবন। ইফতেখারের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে সেই বয়সেই আমি বঙ্গভবন দেখেছি। ইফতেখার একদিন বললো, আমাদের কাছে যেহেতু পর্যাপ্ত টাকা নেই; তাই সবাই মিলে যদি পত্রিকা কেনা যেতো তাহলে কেমন হয়? 
আমি বললাম সেটা আবার কী রকম?

আমরা সবাই মিলে একটি পত্রিকা কিনবো সেটি পালাক্রমে পড়তে পারবো। 
ঠিক আছে কিন্তু সবার কাছে সবসময় টাকা থাকতো না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যেতো আমাদের চেয়ে অবস্থাসম্পন্ন পাঠকরা আগেই সব পত্রিকা কিনে নিয়ে যেতো। সে সময় পাওয়া যেতো হাতেগোনা চার পাঁচটি পত্রিকা। এই অল্প পত্রিকা বিক্রি হয়ে যেতো দ্রুতই। তাই দোকানদারদের বিক্রি করতে আর বেগ পেতে হতো না।  
দোকানের মালিক ছিলেন খালেদ। তিনি বলতেন পত্রিকা তো বিক্রি হয়ে গেছে। কিন্তু ইফতেখারের বুদ্ধির তো অভাব নেই। এটা পরবর্তী জীবনেও আমরা বুঝেছি। 

ইফতেখার বললো, চলো এক কাজ করি যিনি পত্রিকাটি কিনেছেন তার ঠিকানা নিয়ে তার বাসায় যাই। 
ভদ্রলোক পত্রিকা ধার চাওয়াতে খুব অবাক হলেন। তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, আপনি যদি আজ পত্রিকাটি দেন তাহলে আজ তো শনিবার আগামী শুক্রবারেই আপনাকে পত্রিকাটি ফেরত দিয়ে যাবো। তিনি আমাদেরকে আরও কিছু প্রশ্ন করলেন। আমাদের সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তিনি সম্মতি দিলেন। বললেন, নিয়ে যাও। পত্রিকা পেয়ে আমাদের আনন্দ আর কে দেখে! আমি, আলী ইমাম, ইফতেখার, শেলী, ইয়ামিন, আফজাল আর খুব সম্ভবত আমাদের আরেকজন বন্ধু রূপা সেও পড়ার জন্য আগ্রহী ছিল। আমরা চারজন মাত্র চারদিনে একটা বড় পত্রিকা পড়ে শেষ করতাম। দিন নেই, রাত নেই পত্রিকা নিয়ে পড়ে থাকতাম। 

এরমধ্যে ইফতেখারের এক দুঃসম্পর্কের ভাই বিয়ে করলেন এক বিখ্যাত গায়িকাকে। সেই বিয়েতে আমিও গিয়েছিলাম। আমরা মনে মনে ভেবেছিলাম এই বিয়ে যেন বেশিদিন না টেকে। আর সত্যি সত্যি তাই হলো। আমরা ইফতেখারের সেই ভাইয়ের কাছ থেকে প্রচুর বই নিয়ে এসেছিলাম। সেই বইয়ের কিছু বই আমার কাছে এখনো রয়ে গেছে। কিছু বই ইফতেখারের কাছে। আর আলী ইমামের কাছে তো বটেই। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বইকে ভালোবাসা, টেলিভিশনকে ভালোবাসা এসবের সঙ্গে আমরা জড়িয়ে পড়লাম। ইফতেখার বাংলা ভাষা শুধু নয় বিশ্বের অনেক বই পড়ে ফেলেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনে হয় আলী ইমামের চেয়েও সে বেশি বই পড়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিছুদিনের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। ইফতেখারের সঙ্গে তার আলাপ হলো, পরিচয় হলো। সুনীল সনাতন পাঠক নামে যে কলামটি দেশ পত্রিকায় লিখতেন সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘বাংলা ভাষায় সাহিত্য নিয়ে এই বয়সে এতকিছু জানে এবং ঢাকায় থাকতে পারে সে সম্পর্কে আমার ধারণাই ছিল না’। সুনীলের এই প্রশংসা ইফতেখারকে আরও বেশি পড়াশোনায় আগ্রহী করে তোলে। কিন্তু ইফতেখার শিক্ষাজীবনে পড়াশোনা করে ফার্মাসিতে। খুব ভালো ফলাফল সেখানেও। তার বন্ধুরা অনেকেই চলে গেল আমেরিকায়। তবে ইফতেখার বললো, না আমি দেশেই লেখাপড়া করবো। ফার্মাসিস্ট হয়ে ইফতেখার এমবিএ শেষ করলো। যোগ দিলো একটি বিদেশি কোম্পানিতে। আমার মনে আছে প্রথম দিন যখন অফিস করে দুপুরের খাবারের সময় খাবার দাবারে এসে বললো, আমি আর অফিসে যাবো না। কিন্তু কেন? 
আরে আর বলো না এই অফিসে কাজ করা সম্ভব না। সারাদিন ফুল হাতা শার্ট পরতে হবে। হাফহাতা পরা যাবে না। হাতা গোটানো যাবে না। স্যুট-টাই পরে থাকতে হবে। এসব আমার দ্বারা হবে না। আমি বাঙালি ছেলে পাঞ্জাবি পরে দিব্যি অফিসে যাবো। 

তুমি কি ভেবেছিলে পাঞ্জাবি পরে বিদেশি অফিস করবে? 
ইফতেখার চুপ থাকে এবং শেষ পর্যন্ত অফিসে যায়। তার নিত্য নতুন আইডিয়া বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ফার্মাসিস্ট হিসেবে অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করে। পরে বাংলাদেশি একটি কোম্পানিতে জয়েন করে। তার নতুন নতুন আইডিয়ায় কোম্পানি দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। উদাহরণ দেয়া যেতে পারে-স্যাভলনের ছোট ছোট বোতল হয় কিন্তু এই স্যাভলনের যে বড় বোতল ফ্যামিলি সাইজ হতে পারে সেটি ইফতেখার ও তার দল দেখিয়েছে। আমরা তিন বন্ধু-ইফতেখার, আমি এবং আমাদের আরেক বন্ধু মোক্তাদির যিনি আমাদের পার্টনার এবং ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান ও সিইও। আমরা সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। তাই ঠিক করলাম সপ্তাহে অন্তত একদিন আমরা কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে যাবো। একপর্যায়ে আমরা তিনজন তিনটি দামি মার্সিডিজ গাড়ি নিয়ে সেই রেস্টুরেন্টে খেতে যেতাম। আমরা নিয়মিত যাওয়ার কারণে রেস্টুরেন্টে আলাদা জায়গা করে দিতো। পছন্দের খাবার রান্না করে দিতো। সব রকমের সুবিধা দিতো রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ। একদিন ইফতেখার ফোন দিলো। তোমরা খেতে এসো, আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তোমাদের সঙ্গে। আমি আর মোক্তাদির গিয়ে হাজির। ইফতেখার বললো, আমি চাকরিটা ছেড়ে দেবো। 
মানে? এত ভালো চাকরি কেউ কি ছাড়ে? আমরা তাকে জিগ্যেস করলাম চাকরি ছেড়ে কী করবে?
কী আর করবো বই পড়বো, ঘুরে বেড়াবো- যদি আল্লাহ সুস্থ রাখেন। 
সুস্থ থাকবে যদি আল্লাহ চান। 
জীবন থেকে একটি বছর চলে যাওয়া মানে বয়স বেড়ে যাওয়া তখন তো বেড়ানোর সুযোগ নাও পেতে পারি। আমি যদি চাকরিটা ছেড়ে দিই তাহলে অনেক সময় পাবো ঘুরে বেড়ানোর। 
একদিন সে বললো, আমি হিমালয়ে উঠবো। কি বলো তুমি কি এভারেস্টে উঠবা?
না না আমি হিমালয়ে উঠবো যতদূর পারি। সে জিম করে স্বাস্থ্য ভালো রাখে। হাঁটাহাঁটি করে। তার জীবনযাত্রা আরেকদিকে চলে গেল। ৬৭ বছর বয়সে হিমালয়ের একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছলো। আরও উপরে যাওয়ার কথা ভাবছে। একটি দলও সে তৈরি করেছে হিমালয় জয় করার জন্য। সবসময়ই সে একটু ব্যতিক্রম। তার সঙ্গে এরকম অনেক স্মৃতি ছড়িয়ে আছে সেগুলো লিখে শেষ করা যাবে না। আজ আমি যেহেতু একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে ইফতেখারকে নিয়ে লেখাটি লিখছি; তাই আর বেশি বোরিং নাই বা করলাম।

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status