মত-মতান্তর
কে কাদঁবে কার জন্য?
যুক্তরাজ্য থেকে ডাঃ আলী জাহান
(৬ মাস আগে) ৩ মার্চ ২০২৪, রবিবার, ১০:২৬ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৩:২৯ অপরাহ্ন
১. ইংল্যান্ডের যে হাসপাতালে কাজ করি সেখানে প্রতি সপ্তাহে আমাকে একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় যা বাংলাদেশের রাজা বাদশাহরা করেন বলে মনে হয় না। এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কেন এবং কীভাবে করতে হয় তা হয়তো উনারা জানেন না। অথবা জানলেও ‘অন্য কাজে’ ব্যস্ত থাকায় তা করা হয় না।
২. যে দুটি হাসপাতাল আমার দায়িত্বে আছে তার ভেতরে বড়টিতে রোগী আছে ২২ জন। আমি সহ জুনিয়র ডাক্তার, নার্স, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট, সাপোর্ট ওয়ারকারসহ সব মিলিয়ে ডিউটি আওয়ারে ৬০-৭০ জন মহিলা-পুরুষ হাসপাতালে থাকেন। সংখ্যায় কম হলেও সবার নিরাপত্তা প্রদান করা হাসপাতালের অন্যতম দায়িত্ব।
৩. এ দায়িত্বের অংশ হিসেবে প্রতি বৃহস্পতিবার আমি যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই তা হচ্ছে ফায়ার অ্যালার্ম টেস্ট। অধিকাংশ সময়েই নিচের মিটিং রুমে সকালে ঘণ্টাখানেক ১২-১৫ জন নিয়ে হ্যান্ডওভার মিটিং করতে হয়। সে মিটিংয়ের মাঝখানেই জন এসে বলবে ঠিক কখন আজ ফায়ার অ্যালার্ম টেস্ট হবে। জন হচ্ছে হাসপাতালের maintenance staff দের প্রধান। হাসপাতালের ফায়ার অ্যালার্ম কাজ করছে কিনা তা তাকে সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন পরীক্ষা করতে হয়।
৪. প্রতিটি ফ্লোরে এবং করিডোরে স্পষ্টভাবে fire exit door কোথায় আছে তা লিখে দেয়া আছে। প্রতিটি ফ্লোরের বেশ কয়েকটি জায়গায় fire extinguisher বসানো আছে। কোথাও আগুন দেখলে কী করতে হবে তাও স্পষ্টভাবে বলা আছে। ফায়ার ব্রিগেডকে কল করার জন্য কী করতে হবে তা সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জানা থাকতেই হবে।
৫. তো আমি ধরে নিচ্ছি যে কাচ্চি ভাইয়ের খাবার দোকান যে বিল্ডিংয়ে সেখানে প্রতিটা ফ্লোরে ফায়ার এক্সিট ডোর আছে। ফায়ার অ্যালার্ম আছে। প্রচুর ফায়ার এক্সটিংগুইশার আছে। ফায়ার অ্যালার্ম কাজ করছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য লোকজন আছে। ওই বিল্ডিংয়ে যেহেতু বেশ কিছু খাবারের দোকান আছে এবং বিল্ডিংটি অভিজাত এলাকায়, সমাজের প্রতিষ্ঠিত, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ওখানে যাচ্ছিলেন। সে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ভেতর পুলিশ প্রশাসন এবং ফায়ার ব্রিগেডে লোকজনও নিশ্চয়ই গিয়েছেন। উনারা কি কখনো খেয়াল করেছেন যে ওই বিল্ডিংয়ে ফায়ার অ্যালার্ম, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, ফায়ার ডোর আছে কি-না?
৬. রাজউক বলছে যে, ওই অভিশপ্ত বিল্ডিংয়ে খাবার দোকান দেয়ার কোনো অনুমতি ছিল না। এ খবরটি কি উনারা আগে জানতেন না? কাচ্চি ভাইয়ের বিরিয়ানির দোকান ছাড়াও আরো কিছু খাবার দোকান এখানে ছিল। এ দোকানগুলো গত সপ্তাহে বা গতকাল হয়নি। অনেকদিন থেকেই আছে। দায়িত্বরতরা এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটার আগে কিছুই জানতেন না? নাকি জানার পরেও বিশেষ আয়োজনে রেস্তোরাঁগুলোকে চলতে দেয়া হয়েছিল?
৭. বেইলি রোডে গ্রীন কেজি কটেজে আগুন লেগে যে ৪৬ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার জন্য দায়ী কে? বিল্ডিংয়ের মালিক? যারা দোকানগুলো ভাড়া নিয়েছেন তারা? নাকি যারা সরকারের দায়িত্ব পালন করেননি তারা?
৮. ৪৬ জনের মৃত্যুর পর পুলিশ মামলা দায়ের করেছে। এ মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলায় ভবনটির ব্যবস্থাপক মুন্সি হামিমুল আলমসহ চারজনকে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। কপাল ভালো যে তাদের সাত দিনের রিমান্ড দেয়া হয়নি। তাদেরকে কী জিজ্ঞেস করা হবে? জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চয়ই তারা বিশেষ ব্যক্তিদের কিভাবে ম্যানেজ করা হয়েছে তা প্রকাশ করবেন। সেই বিশেষ ব্যক্তিদের নাম দেশের মানুষ জানতে পারবে? তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হবে? রিমান্ড দেয়া হবে? গ্রেপ্তার করার ইতিহাস আছে?
৯. যারা ভাই-বোন, বন্ধু, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান আত্মীয়-স্বজনকে হারিয়েছেন একমাত্র তারাই বুঝতে পারছেন যে এ ভয়াবহ জনপদে জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। ঘরে থাকেন, রাস্তায় থাকেন বা অফিস রেস্তোরাঁয় থাকেন সবখানেই আপনার নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। আপনাকে নিরাপদ রাখার দায়িত্বে যারা আছেন বা থাকার দাবি করেন তারা এখন অন্য কাজে ব্যস্ত। আগুনে জ্বলে আপনি ছাই হয়ে গেলেও আপনার জন্য রাষ্ট্র বা সমাজ থেমে থাকবে না। থেমে থাকেনি বলেই যেদিন ( বৃহস্পতিবার রাত) এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে এর পরের দিনই (শুক্রবার) ৭ জন মন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠান হয়েছে। মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়েছে বিপিএল নিয়ে।
১০. দেখতে শুনতে মানুষ মনে হলেও সবাই যে মানুষ তা কিন্তু নয়। অবয়বে একদম মানুষের মতো দেখলেও আমাদের অনেকের ভেতরেই যে মনুষ্যত্ব নেই তা বুঝার জন্য বৃহস্পতিবার রাতের অগ্নিকাণ্ড আর শুক্রবারের কিছু মানুষের বিপিএলের উল্লাস দেখে অবাক হবেন না। সমাজ এদেরকে এভাবেই সৃষ্টি করেছে। আর সেই সমাজকে সৃষ্টি করেছেন আপনি। মানুষ মরলে কাঁদার সময় আছে? কে কাঁদবে? নিকট আপনজন ছাড়া এ ভূখণ্ডে আপনার মৃত্যুতে কাঁদার জন্য কেউ নেই। মৃত্যু থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য কোনো সুযোগ নেই। যাদের দায়িত্ব ছিল আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তারা এখন অন্য কাজে ব্যস্ত। তবে মৃত্যু একদিন তাদেরকেও ধরবে। সেদিনের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া এখন আর কোনো গতি নেই।
ডাঃ আলী জাহান
কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট
এবং সাবেক Forensic Medical Examiner, UK police