মত-মতান্তর
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ও বাংলাদেশের বাস্তবতা
ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন
(১৮ ঘন্টা আগে) ২ জুলাই ২০২৫, বুধবার, ১০:০২ অপরাহ্ন

পৃথিবীতে নির্বাচন ব্যবস্থা অনেক রকম হয়ে থাকে। এই ব্যবস্থা দেশে দেশে ভিন্ন। প্রতিটি দেশ তার আর্থ-সামাজিক বৈশিষ্ট্য, সাংস্কৃতিক মান এবং দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততার উপর নির্ভর করে নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিকল্পনা করে।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা চলছে। কেউ কেউ জাতীয় নির্বাচনে বর্তমান ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে আবার কেউ কেউ সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনী ব্যবস্থার কথা বলছেন। আসলে আমাদের দেখতে হবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের মানুষ কোন ব্যবস্থায় স্বাচ্ছন্দ বোধ করবে এবং অধিক সংখ্যক ভোটারকে কোন পদ্ধতিতে ভোট প্রদানের প্রতি আগ্রহী করে তোলা যাবে।
বিশ্বে বর্তমানে নির্বাচন পদ্ধতি মূলত তিন প্রকারের -
প্রথম স্থানে আছে-
FPTP- First Past The Post (বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত )
এই পদ্ধতিতে যে প্রার্থী বেশি ভোট পাবে সে জয়ী হবেন এবং যে দলের প্রার্থী বেশি জয়ী হবে তা’রা সরকার গঠন করবে। এ পদ্ধতি ইউকে, ইউএসএ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মেনে চলছে।
দ্বিতীয় স্থানে আছে-
MMP- Mixed Member Proportional-এই পদ্ধতিতে একজন ভোটার একদিনে একই ব্যালটে দুইটা ভোট দিবেন একটা স্থানীয় প্রার্থীকে আর একটা তার পছন্দের দলকে, যে প্রার্থী যে আসনে জয় লাভ করবেন তিনি সেই আসনের এমপি নির্বাচিত হবেন এবং সর্বশেষ মোট আসন দলের ভোটের আনুপাতিক হারে বণ্ঠিত হবে। এ পদ্ধতি জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েল্সসহ বিশ্বের বেশ কিছু রাষ্ট্র এফপিটিপি থেকে এই পদ্ধতিতে স্থানান্তরিত হয়েছে।
তৃতীয় অবস্থানে আছে-
PR - Proportional Representation-
এ পদ্ধতিতে ভোটার শুধুমাত্র তার পছন্দের দলকে ভোট দিবেন, প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদীয় আসন বণ্ঠন হবে, এবং দল যাকে ইচ্ছে তাকে যে আসন খুসি সেই আসন দিতে পারবে, যা দল থেকে নির্বাচনের পূর্বেই প্রার্থীর একটা ক্রমানুসারে লিস্ট করা থাকবে, সেই লিস্ট থেকে পার্টি ক্রমানুসারেই এমপি নির্বাচিত করবেন। সুইডেন, বেলজিয়ামসহ কিছু রাষ্ট্র এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে বড় দলের নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা কমে যাবে এবং ছোট ছোট অনেক দলের সদস্য নির্বাচিত হবে। সেই ক্ষেত্রে অনেকগুলো দলের প্রতিনিধির সমন্বয়ে সরকার গঠন করতে হবে। এই পদ্ধতিতে ভোটারদের সাথে জনপ্রতিনিধির সংযোগ কম থাকে এবং দূর্বল সরকার গঠিত হয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মন-মানসিকতা ও অতীত অভিজ্ঞতা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে যায় না। এদেশে কোয়ালিশন করে সরকার গঠনের ইতিহাস বেদনাদায়ক। কিছুদিন পর পর কোন কোন দলের সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে এবং এক ঘোলাটে রাজনৈতিক অবস্থার জন্ম দেয় যা’ অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার দিকে জাতিকে নিয়ে যায়। এই অস্থিরতা আমরা যুক্তফ্রন্ট আমলে প্রত্যক্ষ করছিলাম। তখন সকালে এক সরকার আর বিকালে গঠিত হতো আরেক সরকার ফলশ্রুতিতে ইস্কান্দার মির্জা-আইয়ুব খান ও এহিয়া খানের শাসন আসে।
নৃতাত্ত্বিক জাতিগতভাবে আমরা অস্থির চিত্তের। আমরা কখনও দীর্ঘদিন এক জায়গায় স্থির থাকতে পারিনা, তাই আমাদেরকে কোর্ট পরিবর্তন করার সুযোগ দেয়া বিপজ্জনক। তাছাড়া সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে যেহেতু এলাকা ভিত্তিক প্রার্থী থাকবে না সেহেতু সাধারণ ও নিরপেক্ষ ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ তেমন থাকবে না, ফলে ভোট প্রদানের হার কম হবে। এরকম পরিস্থিতিতে কট্টরপন্থি ও উগ্রপন্থী দলসমূহ তা’দের কর্মী সমর্থকদের তৎপরতার মাধ্যমে ভোট সংগ্রহ করবে এবং সেই ক্ষেত্রে উদার গণতান্ত্রিক দলসমূহের কোণঠাসা অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং দেশ তা’র জনগণতান্ত্রিক চরিত্র হারাতে বাধ্য হবে।
এছাড়া পি আর পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তাই হয় সাংবিধানিক এসেম্বলি অথবা গণভোট দিতে হবে যা’ সময় সাপেক্ষ। এছাড়াও পিআর পদ্ধতির নির্বাচন পতিত স্বৈরাচারকে পূনর্বাসনের সুযোগ করে দিবে। কিছু রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে স্থানীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবি তুলছেন এতে জাতীয় নির্বাচন শুধু বিলম্বিত হবে না অনিশ্চিতও হয়ে পরবে।
দীর্ঘদিন যাবত এদেশের মানুষ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত। অতএব দ্রুততার সাথে তাদের সেই আকাঙ্খার বাস্তবায়নের সুযোগ দিতে হবে এবং জাতীয় নির্বাচন কেবল বিদ্যমান পদ্ধতিতেই আয়োজন করতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে দেশে এক অনাকাঙ্খিত অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
লেখক: বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা