মত-মতান্তর
গণতন্ত্রকে ট্র্যাকে রাখতে সুশীল সমাজের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আবার দেখতে চায় জাতি
ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
(১১ মাস আগে) ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:০৯ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৪:১২ অপরাহ্ন
সুশীল সমাজ তথা নাগরিক সমাজ শব্দটি ইংরেজি Civil Society শব্দের বাংলা পারিভাষিক শব্দ। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় Civil Society শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টোটলের Politics গ্রন্থে। নাগরিক সমাজকে সমাজের ‘তৃতীয় বিভাগ’ হিসেবেও বোঝা হয় এই অর্থে যে তারা সরকারের অংশ নয়, আবার ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য বাণিজ্যিক কোনো প্রতিষ্ঠানও নয়। লেখক ও গবেষকদের লেখা থেকে নাগরিক সমাজের দুটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়:
(১) নাগরিক সমাজকে বেসরকারী সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি হিসেবে বুঝানো হয় যা নাগরিকদের স্বার্থ ও অধিকারের ব্যাপারে আগ্রহী
(২) সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বা সংগঠনের সমষ্টি যারা সরকার-নিরপেক্ষ হয়ে থাকেন।
‘নাগরিক সমাজ’ শব্দ দুটি আক্ষরিক অর্থ দিয়ে দেশের সকল সাধারণ নাগরিকদেরকে বুঝালেও প্রকৃত, বাস্তব ও প্রায়োগিক অর্থে সমাজ ও দেশের প্রতিষ্ঠিত ও বিশিষ্ট নাগরিকদের বুঝানো হয় যারা দল নিরপেক্ষভাবে দেশ ও নাগরিকদের স্বার্থ ও অধিকার নিয়ে কথা বলেন, কাজ করেন ও সোচ্চার থাকেন। এই প্রতিষ্ঠিত ও বিশিষ্ট নাগরিকদের আবার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বলা হয় বা ডাকা হয়। আধুনিক সভ্য (Civilised) ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক সমাজের ভূমিকা ক্রমশ: জেরালো হয়ে উঠেছে। যে সমাজে নাগরিক সমাজ সক্রিয় ও সোচ্চার সে সমাজে গণতন্ত্র হয় টেকসই (Durable) ও লাগসই (Sustainable), কেননা এমন সমাজে নিরাপত্তার জাল (Safety Net) হিসেবে কাজ করেন নাগরিক সমাজ। কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদি সমাজ ও রাষ্ট্রে নাগরিক সমাজের কোনো ভূমিকাই থাকে না। তারা থাকেন নীরব দর্শক, তাদের কণ্ঠ হয় ম্রিয়মান।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে সঠিক ট্র্যাকে রাখতে ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা বা উপাদানের মধ্যে অন্যতম হলো নাগরিক সমাজের জোরালো ভূমিকা। অন্যান্য পন্থা বা উপাদানগুলো হলো-
প্রথমত: নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রকৃত অর্থে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যেখানে জনগণ ক্ষমতাসীন সরকারকে কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় রাখতে পারে। দ্বিতীয়ত: শক্তিশালী বিরোধী দল যারা সরকারের যথাযথ (to the point) সমালোচনার পাশাপাশি বিকল্প নীতি ও কর্মসূচি জাতির সামনে উপস্থাপন করে ভবিষ্যতে সরকার গঠন করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
তৃতীয়ত: স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত যাতে জনগণের সহজ একসেস থাকবে এবং যারা সরকার ও রাষ্ট্র নামক শক্তিশালী পক্ষ এবং সাধারণ জনগণের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সুবিচার নিশ্চিত করবে।
চতুর্থত: নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যম যা সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পন হিসেবে কাজ করত: দেশ ও জাতির প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে সরকারকে সতর্ক করবে এবং জবাবদিহিতার মধ্যে রাখবে। পঞ্চমত: বিভিন্ন নিরপেক্ষ সংগঠন ও সংস্থার মাধ্যমে দেশের প্রকৃত তথ্য, উপাত্ত ও পরিসংখ্যান তুলে ধরে সরকারকে রাইট ট্র্যাকে রাখবে।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় রাখতে উপরের উপাদানগুলো কোনোটা অনেকটা অকেজো, কোনোটা বিকল, কোনোটাতে ঘুণে ধরেছে, আবার কোনো কোনোটা অকেজো বা বিকল হওয়ার পথে। এক সময় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো ফলে ক্ষমতাসীন সরকার জনগণকে সত্যিকার অর্থে ভয় পেত। সেই দিন আর নেই। একাধিকবার বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল ছিল যার ভয়ে ক্ষমতাসীন সরকার থাকতেন তটস্থ। এগুলো এখন ইতিহাস।
হাল আমলে সংসদে কী ধরনের বিরোধী দল আছে তা তো জাতি দেখছে। সরকারের জবাবদিহিতা তো দূরের কথা তারা বরং নিজেরাই সরকারের উপর পুরো নির্ভরশীল। সরকারের রাডারের বাহিরে তারা যেতে পারেন না। নিকট অতীতে বাংলাদেশে দেখা গেল আজগুবি টাইপের বিরোধী দল - সরকারের মন্ত্রী আবার বিরোধী দলেরও নেতা - যা পৃথিবীর সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিরল!
গণমাধ্যমের অবস্থা তো জাতি স্বচক্ষে দেখছে। প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের স্তুতি, গুনগান ও প্রশ্নের ধরন দেখে বুঝা যায় তাদের দ্বারা আর যাই হোক সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ব্যাপকহারে দলীয়করণ ও ভয়ের সংস্কৃতি চালু হওয়ার কারণে দেশে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা গড়ে উঠেনি যারা প্রকৃত তথ্য, উপাত্ত ও পরিসংখ্যান সঠিকভাবে প্রকাশ করে সরকারকে জবাবদিহিতার মধ্যে রাখতে পারে। আইন-আদালতের অবস্থা জাতির সামনে দৃশ্যমান। এ নিয়ে কোনো কথা এখানে না বলাই শ্রেয়। শুধু ইতিহাস স্বরণ করছি আর ভাবছি। সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বাতিল মামলার রায় ছিল তৎকালীন মহা প্রতাপশালী রাষ্ট্রপতি এরশাদের প্রতি সরাসরি আঘাত। এরশাদের বিরুদ্ধে রায় দেয়া বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে ডিঙ্গানের সাহস করেন নি এরশাদ, তাকে এক মাসের জন্য হলেও প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিতে হয়েছিল। ঐ মামলার লিডিং জাজমেন্ট দেয়া বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকেও প্রধান বিচারপতি বানাতে হয়েছে, ডিঙ্গানোর সাহস পান নি এরশাদ। হাল আমলে এগুলো চিন্তা করা যায়!
নাগরিক সমাজ জাতির এই ক্রান্তিকালে এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারতেন। অতীতে রেখেছেনও একাধিকবার। মহান মুক্তিযুদ্ধে, আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ও নব্বই দশকে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নাগরিক সমাজের জোরালো ভূমিকা সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভাবিত শক্তি যুগিয়েছে। এমনকি ১/১১ আনয়নে নাগরিক সমাজের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। ১/১১ দেশের জন্য কতটুকু কল্যাণ বয়ে নিয়ে এসেছিল সেটা অন্য বিতর্ক। হাল আমলে নাগরিক সমাজের তেমন কোনো ভূমিকাই দেখা যাচ্ছে না, জোরালো ভূমিকাতো দূরের কথা। তারা অনেকটা কবরের নীরবতা পালন করছেন।
দু:খের বিষয় যে রাজনৈতিকভাবে জাতি আজ গভীরভাবে বিভক্ত। এর ধাক্কা লেগেছে নাগরিক সমাজেও। ফলে নাগরিক সমাজ আজ দেশ ও জাতির স্বার্থে রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছেন না। নাগরিক সমাজের সিংহভাগ আজ সরকারের সুবিধাভোগী ও অনুগ্রহপ্রাপ্ত। ফলে তারা নিজেদের স্বার্থ নামক বৃত্তের বাহিরে বের হতে পারেন না। অন্য অংশটি বিরোধী দলের সমর্থিত এবং মিডিয়ায় সেভাবেই চিত্রিত করা হয়। এই দুই বলয়ের বাহিরে নাগরিক সমাজের কিছু প্রতিনিধি নিরপেক্ষভাবে কথা বলছেন তাদের স্বীকৃতি না দিলে তাদের প্রতি সুবিচার করা হবে না, তবে এই অংশটি খুবই ছোট এবং ছোট বলে তারা তেমন ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারছে না। অতীতে জাতির স্বার্থের ক্ষেত্রে একটু এদিক-সেদিক হলে (এমনকি চুন থেকে পান খসলে) যেখানে নাগরিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সোচ্চার দেখা যেত (এমনটি দরকারও ছিল) এবং জনমত গঠন করতে দেশব্যাপী তারা চষে বেড়াতেন, এখন জাতি ও জনগণের অধিকার ও স্বার্থের ক্ষেত্রে অনেক সময় পুকুর চুরি হলেও তারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকাকে তারা নিরাপদ মনে করছেন। এটা জাতির জন্য অশনি সংকেত।
গণতন্ত্রের সুতিকাগার বৃটেনে নাগরিক সমাজ অত্যন্ত সজিব ও সক্রিয়। দেশ ও জাতির স্বার্থে তারা নিরপেক্ষভাবে জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করেন। ক্ষমতাসীন সরকার বিরোধী দলকে যত না ভয় করে তার চেয়ে বেশি ভয় করে নাগরিক সমাজকে। গত অর্ধ শতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে - যত মন্ত্রী শপথ ও মন্ত্রীদের আচরণ বিধি (Ministerial Code) ভঙ্গ এবং বিতর্কিত মন্তব্য ও কাজের জন্য পদত্যাগ করেছেন বা তাদেরকে বরখাস্ত করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে বিরোধী দলের সমালোচনার কারণে নয় বরং জনগণের তুপের মুখে পড়ার জন্য এবং সর্বোপরি নাগরিক সমাজের জোরালো ও সোচ্চার ভূমিকার কারণে।
বাংলাদেশ এক ক্রান্তকাল অতিক্রম করছে। গোটা দেশ রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত, বিভক্ত মূলত: দুটি শিবিরে। এক শিবির ডানে বললে আরেক শিবির যায় বামে অথবা চলে উল্টো দিকে। তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে গঠিত সরকার উপহার দেয়া সংসদে কার্যত: বিরোধী দল নেই। প্রকৃত চেক এন্ড ব্যালেন্স ছাড়া দীর্ঘদিন এক দল ক্ষমতায় থাকলে কর্তৃত্ববাদ স্বাভাবিকভাবে মাথা ছাড়া দিয়ে উঠে। এজন্য সরকারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্চতা নিশ্চিত করা দরকার সরকারের নিজের স্বার্থে। আর এ কাজটি অন্তত: করতে পারেন নাগরিক সমাজ। তাই গণতন্ত্রকে সঠিক ট্র্যাকে রাখতে ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের অতীতের গৌরবোজ্জল ভূমিকা আবার দেখতে চায় জাতি।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রচিন্তক এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
Email: [email protected]
আমাদের দেশে দুইটি সুশীল সমাজ আছে , একটি রাষ্ট্রীয় মানে সরকারের সমস্ত সুবিধা প্রাপ্ত সুশীল সমাজ আরেকটি বিরোধী দলীয় সুশীল সমাজ । যখন যে সুশীল সমাজের দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকে নগ্ন ভাবে তার পা চাটতে থাকে।
গনতন্ত্র মারমার মত।
সুশীল সমাজ! নিবন্ধে যে সুশীল সমাজের কথা বলা হয়েছে তা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে,আবার কিছু মানুষ সুশীলের ভেক ধরে অন্ধ হয়ে ওপারের দাদাদের কথায় জ্বি হুজুর জাঁহাপনার রাজত্ব কায়েম করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে, হ্যাঁ, তবে সত্যিকারের সুশীল সমাজের বাসিন্দারা আমাদের চারপাশে রয়েছে, যাদেরকে আমরা সুশীল বা নাপিত বলে ডাকি বা চিনি,উনারা উনাদের কর্ম নিবিষ্ট মনে করে যাচ্ছে।