ঢাকা, ২ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

সাম্প্রতিক

একতরফা নির্বাচন হলে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে

শহীদুল্লাহ ফরায়জী
১৬ নভেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবারmzamin

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের প্রকৃতি, সরকারের ধরন, কার্যাবলী, ক্ষমতা, রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক নির্ধারণসহ তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন যেভাবে উল্লেখ করা আছে, সেভাবে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে না।  

একটি দেশের আইন দু’ভাগে ভাগ করা যায়:- 

১) সরকার সম্পর্কিত আইন (Public Law) এবং 

২) ব্যক্তি সংক্রান্ত আইন (Private Law) সরকার সম্পর্কিত আইনে সরকারের ক্ষমতাকাঠামো, বিভিন্ন বিভাগের প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব ও কার্যাবলী নিয়ে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ভাগ আছে- 

ক) সাংবিধানিক আইন (Constitutional Law)  এবং 

২) প্রশাসনিক আইন (Administrative Law)

সাংবিধানিক আইনকে সাংবিধানিক নৈতিকতার একটি বুনিয়াদের উপর নির্ভর করতে হয়। সংবিধানে যত কিছু লেখা হোক না কেন সাংবিধানিক নৈতিকতার অভাবে সকল কিছুই অযৌক্তিক স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে। সাংবিধানিক নৈতিকতা যত শক্তিশালী হবে তত লিখিত রাখার প্রয়োজন কমে যাবে। ডক্টর আম্বেদকর সাংবিধানিক নৈতিকতার প্রশ্নে গভীরভাবে চিন্তিত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন- সাংবিধানিক নৈতিকতা একটি স্বাভাবিক অনুভূতি নয়, এটা চর্চার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। আইন প্রণেতা, বিচারক, আইনজীবী, মন্ত্রীসহ আমলাদের মাঝে সাংবিধানিক নৈতিকতার অনুপ্রবেশ না ঘটলে সংবিধানটি ক্ষমতার দালালদের হাতের খেলনা হয়ে দাঁড়ায়। সাংবিধানিক আইন সরকারের ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ধরন-গঠনে সামগ্রিকভাবে এর দায় দায়িত্ব নির্ধারণ করা থাকে। এটা দেশের মৌলিক বা সর্বোচ্চ আইন, যা রাষ্ট্রের মধ্যে সার্বভৌম শক্তির অবস্থান নির্ণয় করে। অন্য কোনো আইন সাংবিধানিক আইনের তুলনায় মর্যাদাসম্পন্ন হতে পারে না। একটি দেশের পদ্ধতিগত বা প্রশাসনিক আইনের কোনো বিধান সাংবিধানিক আইনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। এই জন্য সাধারণ আইন জাতীয় সংসদে পাস করতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হয় কিন্তু সাংবিধানিক আইন পাস করা ও পরিবর্তন করার জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হয়। 

বাংলাদেশ হচ্ছে প্রজাতন্ত্র যা রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল। এই দেশ কারও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানের সীমাবদ্ধতা, ক্ষমতা কাঠামোর বণ্টন, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা বা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন উপযোগী সংবিধান কিনা ইত্যাদি আলোচনার বিষয় নয়। সংবিধানে যা নির্ধারণ করে দেয়া আছে সে ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে না- এই প্রেক্ষাপটে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। সংবিধানের প্রস্তাবনায় দিকনির্দেশনা দেয়া থাকে। 

বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে-  ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে- গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’। এই যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, জনগণের সম্মতি ও সমর্থনের ভিত্তিতে সাংবিধানিক সরকার গঠন, নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, সকল ধরনের দমনমূলক পথ পরিহার করে গণতান্ত্রিক পন্থায় সকল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান, শক্তিশালী বিরোধী দলগুলোর মতামতকে শ্রদ্ধা করা, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করা, উৎসাহ দেয়া-সহ সব কিছুকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। বিদ্যমান সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে 

১০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত, ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার-উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে এবং ১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে, মেহনতি মানুষকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশ-সমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা’। 

কিন্তু গত ৫০ বছরে কোনো সরকার মানুষের ওপর মানুষের শোষণ মুক্ত করার কোনো আইন প্রণয়ন করেনি বা সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কোনো একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি। বিগত কয়েক বছরে রাষ্ট্রের ভেতর বিপজ্জনক অসাম্য সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুততম সময়ে ধনী হওয়ার তালিকায় বাংলাদেশ প্রথম। সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবে’। অথচ পাবলিক সার্ভিস কমিশনে মেধা প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও কোনো প্রার্থীর পরিবার বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, এই রিপোর্ট আসার পর- তিনি যোগ্য এবং উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও চাকরি লাভে অযোগ্য বিবেচিত হোন। এই সম্পর্কে সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- সরকারি দল না করলে নাগরিক হয় না, চাকরি লাভ করা যায় না। এটা কি রাষ্ট্র? এটা কি সংবিধান মান্য করার নজির? সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘কেবল ধর্ম-গুষ্ঠি-বর্ণ, নারী- পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না’। 

কিন্তু গোপালগঞ্জ এবং বগুড়া বাড়ি- এই  কারণে চাকরির পদায়ন এবং পোস্টিং প্রদানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কি বৈষম্য প্রদর্শন করছে না? যদিও ২৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে এবং ২৯ (২) বলা হয়েছে-‘কেবল ধর্ম-গোষ্ঠী-বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না’। কিন্তু প্রতিনিয়ত এমন বৈষম্যই প্রত্যক্ষ করছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র। 

আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার ৩১ অনুচ্ছেদে এবং জীবন ও ব্যক্তির স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণে ৩২ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু যেকোনো ঘটনায় নাগরিকের ব্যক্তিজীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম ও সম্পত্তির হানি ঘটছে যখন তখন। সাংবিধানিকভাবে আইনের দৃষ্টিতে সমতা বা আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার থাকলেও প্রয়োগ ক্ষেত্রে সবার জন্য তা সমান নয়। যেমন সরকারি দলের নেতাকর্মী হাতে অস্ত্রসহ মিছিল করছে আর বিরোধী দলের নেতা  বা সমর্থক বহুবছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করার পরও নাশকতা মামলার আসামি হচ্ছে! এইসব গায়েবি মামলার কথা পত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে, মৃতব্যক্তি কতো নম্বর আসামি তাও উল্লেখ করা হচ্ছে, কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো কর্তৃপক্ষ জানতে চাইছে না- কোন তদন্তের ভিত্তিতে মৃত ব্যক্তিকে আসামি হিসেবে চিহ্নিত করা হলো? কিংবা বহুদিন যাবৎ যে ব্যক্তি বিদেশে অবস্থান করছে সে কীভাবে যানবাহনে আগুন দেয়ার আসামি হতে পারে! পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রে নিরপরাধ মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করার লক্ষ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মামলার আসামি করা হয় না। নির্বাচনকে সামনে রেখে শুধু সরকারি দল বিরাট বিরাট জনসভা করছে আর বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সংগঠক নির্বিচারে গ্রেপ্তার হচ্ছে। নেতাকর্মীদের না পাওয়া গেলে তাদের সন্তান-সহ স্বজনদের গ্রেপ্তার করে আনা হচ্ছে। মুখোশধারীদের দ্বারা হামলা হচ্ছে, সাদা পোশাকে কাউকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, কারও লাশ পাওয়া যাচ্ছে। সংবিধান বিদ্যমান থাকা অবস্থায়। আইনের দৃষ্টিতে সমতা এবং সকলের জন্য সমানভাবে আইনের সুরক্ষা ভেঙে পড়েছে। রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান-  জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা বা নির্দেশনাকে প্রতিফলিত করার জন্য সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করছে না। নৈতিকভাবে সংবিধানের পর্যালোচনা থাকলেই সংবিধান জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমাদের সংবিধান এখন আর জীবন্ত সংবিধান নয়, গতিশীল সংবিধান নয়। 

জনগণের অভিপ্রায় হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রাথমিক ভিত্তি এবং সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। ভোটাধিকার না থাকলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক চরিত্র বিনষ্ট হয়ে যায়। দলীয় সরকারের অধীনে জনগণ ভোট দিতে পারে না, ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে একদলের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার উপায় হিসেবে নির্বাচনকে ব্যবহার করা হয় মাত্র। এতে জনগণ রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এখন এটা প্রমাণিত যে- পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, সংবিধানের গণপ্রজাতন্ত্রী চরিত্র ক্ষুণ্ন করেছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, সমতা নির্বাসনে গিয়েছে। নির্বাচনবিহীন সরকার, রাতের ভোটের সরকার-  আমাদের সংবিধানের মূল কাঠামো বা স্তম্ভের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচন অর্থাৎ অর্থ, শক্তি, নিপীড়ন মুক্ত অবস্থায় ভোট প্রদানের কল্পনাও করা যায় না। ফলে গত কয়েকটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে নির্বাচন কমিশন বারবার ব্যর্থ হয়েছে। সংবিধানের ১১৮ (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী- 

‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন থাকিবেন’। কিন্তু প্রমাণ হয়েছে নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন নয় বরং দলীয় সরকারের অধীনস্থ থেকে সংবিধান লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন। রাতের ভোটের পর সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত করে কোনো নির্বাচন কমিশনকে শাস্তির মুখোমুখি করা হয়নি। এ ছাড়া সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক-  ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে’। কিন্তু নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা না করে সরকারের পক্ষে দায়িত্ব পালন করে। অথচ কোনো নির্বাচন কমিশন প্রকাশ্য অভিযোগ উত্থাপন করে নির্বাহী বিভাগের গাফিলতি বা সংবিধান-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত করার কোনো বিধান সংবিধানে নেই এবং নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় সহায়তা না দিয়ে নির্বাহী বিভাগ সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবেন-  এমন ব্যবস্থা নেই। নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাহী বিভাগের অদৃশ্য আঁতাতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও পাঁয়তারা চলছে। বিরোধী দলের অসংখ্য নেতা-সহ হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করে, রাজনৈতিক অফিস তালাবদ্ধ করে, সারা দেশে আন্দোলন-সংঘাত-সংঘর্ষ বিস্তার লাভ করার পরও নির্বাচন কমিশনের কাছে নির্বাচনের পরিবেশ বিরাজমান রয়েছে বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে। এই যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সকল ধরনের অবিচারকেই কর্তব্য বলে মেনে নিয়েছে, রাষ্ট্রের প্রতি সংবিধানের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য উপেক্ষা করে যাচ্ছে- এসব কি সংবিধানকে মান্য না করা নয়? 

 শুধু একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের অভাবে রাষ্ট্রীয় রাজনীতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, জাতীয় অর্থনীতি কী ভয়ঙ্কর অবস্থায় নিপতিত হয়েছে, জনগণের সার্বভৌমত্ব, সংবিধানের প্রাধান্য, নাগরিক স্বাধীনতা ও অধিকার কীভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে- তা কোনো সভ্যতার মাপকাঠিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। বলপ্রয়োগ করেই যদি রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হতো তাহলে আর মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন হতো না, অগণিত মানুষের আত্মদানের প্রয়োজন পড়তো না। সরকারের কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা নেই; ভোটের মাধ্যমে জনগণের প্রদত্ত ক্ষমতাই হলো রাষ্ট্রক্ষমতা। জনগণের সম্মতি ব্যতিরেকে কোনো স্থিতিশীল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। জনগণের সম্মতি ও সমর্থন ছাড়া কোনো সরকার বৈধতা পেতে পারে না। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। 

আরেকটা একতরফা নির্বাচন রাষ্ট্রের জনমানুষের সার্বভৌমত্বকে ভূলুন্ঠিত করবে, রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝে চুক্তি অগ্রাহ্য হয়ে পড়বে, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে এবং ভূ-রাজনীতিতে রাষ্ট্র দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হবে। সর্বোপরি রাষ্ট্র চরম বিপর্যয়ে পড়বে। সরকার গণমানুষের মৌলিক অধিকার, ভোটাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা-সহ জীবন রক্ষার অধিকারকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ। এমনকি বৈশ্বিক ক্ষেত্রেও যারা আমাদের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার, তাদের সঙ্গেও চরম বৈরী সম্পর্ক গড়ে তুলবে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ-সহ অনেক মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে সরকার ইতিমধ্যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্কে জড়িয়েছে। এর অবশ্যই অবসান হওয়া প্রয়োজন। নতুবা ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়াই একমাত্র বিকল্প থাকবে বাংলাদেশের। যে দেশের জনগণ বুকের তাজা রক্ত উপহার দিয়ে স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করলো, সেই স্বাধীন দেশেই জনগণের নিজেদের ভোটাধিকার নেই, এটা অগণিত শহীদদের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা। 

’৭২ সাল থেকেই কী দলীয় সরকার, কী সামরিক সরকার- সবাই সংবিধানকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে। কেউ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের উদ্যোগ নেয়নি। এখন গণতন্ত্র ও আইনের শাসন বিভীষিকাময় চিত্র নিয়ে সমাজে বিরাজমান। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল মুখ আমাদের বিবেকের আয়নায় চেনা মুশকিল। রাষ্ট্র ক্ষমতা চিরস্থায়ী হবে- এই আজগুবি ধারণা থেকে বর্তমান সরকারকে সরে আসতে হবে, নতুবা চরম বিপর্যয় থেকে আমাদের পরিত্রাণ মিলবে না। 

বিদ্যমান বাস্তবতায় নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলাদেশ এখন সংবিধান অমান্যকারী রাষ্ট্র। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসছে- আমরা কী স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবো নাকি হারাবো? 

লেখক: গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক 

[email protected]

 

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status