ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

হারবার থেকে মাওয়া

পদ্মা সেতু নিয়ে নানা মিথস্ক্রিয়া

কাজল ঘোষ
২৯ জুন ২০২২, বুধবার
mzamin

সময় ১৯৩২ সাল। দৃশ্যপট অস্ট্রেলিয়ার সিডনি। ঘটনাক্রম হারবার ব্রিজ। সালটি এই ব্রিজের সূচনার। উদ্বোধনী দিনে এই ব্রিজ ঘিরে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। চারপাশে কেবল মানুষ আর মানুষ। নতুন স্থাপনা নিয়ে মানুষের সে কি আগ্রহ। অন্তত গুগল প্রকাশিত ছবি তাই বলে। এরপর ফিরি দেশে। ১৯৭৭ সালের একটি ছবি।

বিজ্ঞাপন
ঢাকা নিয়ে আর্কাইভ প্রকাশিত এই ছবিতে দেখা যায় ফার্মগেট ওভারব্রিজের শুরুর দিনটি কেমন ছিল? তৎকালীন সামরিক প্রশাসক জেনারেল এরশাদ এটি উদ্বোধনের পর পরই হাজার হাজার মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে ওভারব্রিজ দেখার জন্য। ছবিটি দেখলে মনে হবে সেই ওভারব্রিজটি বোধকরি একটি মানবঢাল। ঢাকার শুরুর দিকে এমন একটি স্থাপনা ঘিরে মানুষের ঔৎসুক্য বা কৌতূহল থাকাটা কি খুব বেশি অস্বাভাবিক। দেশের বৃহৎ প্রকল্প কেবল নয় আমাদের প্রত্যন্ত এলাকায় ছোটবড় যেকোনো প্রকল্প নিয়ে শুরুতে মানুষ এভাবেই মাতামাতি করে। আমার মনে আছে, এরশাদ আমলের শুরুর দিকে আমাদের গ্রামে প্রথম যেদিন বিদ্যুৎ আসে বা বিজলি বাতি রাস্তায় জ্বলে সেদিন কি হয়েছিল? গভীর রাত পর্যন্ত একটি অজপাড়াগাঁয়ের মানুষ মেঠো রাস্তায় দাঁড়িয়ে তা অবাক হয়ে দেখেছিল। সেই প্রথম সড়কবাতি। খাম্বার ওপর লম্বা সাদা লাইট। 

এর নাম এই প্রথম জানলো সবাই, টিউবলাইট। কি আজব এক দৃশ্য! চারপাশ ফকফকা। বাবা-দাদার আমলের টর্চ লাইট বুঝি আর লাগবে না। এর রেশ কাটতে খুব একটা সময় লাগেনি। ঢাকার সঙ্গে চীন মৈত্রী সেতু, মেঘনা গোমতী সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতুর উদ্বোধনেও এমন ভিড় হয়েছিল। নিশ্চয়, আপনাদের মনে আছে, বঙ্গবন্ধু সেতুর শুরুতে ছাদখোলা ডাবল ডেকার বাস সেতুতে পর্যটকদের নিয়ে ঘুরে বেড়াত। ব্যক্তিগতভাবে সেই সুযোগ নিয়েছিলাম যমুনার বুক চিরে তৈরি সেতুটি দেখতে। পদ্মা সেতু নিয়ে মানুষের মাতামাতি হোক এটি সেতু নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ না চাওয়ার পক্ষে কোনো যুক্তি আছে বলে মনে হয় না। কারণ, ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশই ছিল মানুষকে এই বিশাল স্থাপনা নিয়ে আগ্রহী করা। এর জন্য প্রচারমাধ্যমে বহুরকম সচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে হাজার হাজার কনটেন্ট তৈরি করা হয়েছে। এই যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় পদ্মা সেতুর প্রচারে করা হয়েছে, তার সুফল হচ্ছে, কিছুটা হলেও সাধারণ মানুষের এই মাতামাতি। কর্তৃপক্ষের প্রচার-প্রচারণা ঠিকমতো মানুষের মধ্যে পৌঁছেছে।  কি কি ঘটেছে? সরকারের একজন এমপি যিনি পদ্মার অপর প্রান্তের শরীয়তপুর এলাকার, তিনি সেতুতে চুমু খেয়েছেন। একা নন সঙ্গী-সাথীদের নিয়েই তিনি তা করেছেন। একজন সংসদ সদস্য যখন তা করেন তখন সাধারণ মানুষ বহুরকম হুজুক নিয়ে হাজির হবেন- এটাই স্বভাবিক।

 

 

তারপর আমরা সামাজিক মাধ্যমে একের পর এক ছবি ভাইরাল হতে দেখলাম। একদল লোক পদ্মা সেতুতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছেন। একজন প্রথম পদ্মায় বসে সিগারেট সেবন করে নিজেকে রেকর্ডের তালিকায় রেখেছেন। সেলফি, গ্রুপ ছবি এগুলোর বাইরে অতিমাত্রায় গিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারার ছবি বা নাটবল্টু খুলে নেয়ার দৃশ্য টিকটক করে বাড়াবাড়ি করার কিছু নমুনাও অনেকে উপহার দিয়েছেন। পক্ষে বিপক্ষে এসব নিয়ে মানুষ ট্রল করছে। প্রথমদিনেই দু’জনের মৃত্যু ঘটেছে। মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপর মোটরসাইকেল পিকআপে করে অপর প্রান্তে নেয়ার ছবিও হাতে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  উদ্বোধনী দিন সেতু কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে একুশে পদক প্রাপ্ত একজন সিনিয়র নাগরিক যোগ দিয়েছিলেন অনুষ্ঠানে। ঐতিহাসিক মুহূর্তের অংশ হতে পেরে তিনি তৃপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এ-ও বললেন, মানুষের সেতু দেখার অদম্য আকাঙ্ক্ষা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কেমন? এমন প্রশ্নে বললেন, সেতুতে ওঠার যে বাউন্ডারি ঘেরা কাঁটাতারের বেড়া তার নিচ দিয়ে সিঁদ কেটে মানুষ স্রোতের মতো সেতুতে উঠছে তা-ও দেখেছি। এটি হয়তো ক’দিনের মধ্যেই থেমে যাবে- এমন প্রত্যাশাও ব্যক্ত করলেন তিনি।  

 

 

কথা হচ্ছে, এটি আমাদের গৌরবের প্রকল্প বিধায় মানুষের আগ্রহ অন্য যেকোনো অবকাঠামোর চেয়ে বেশি থাকবে এটিই সঙ্গত। আর এই প্রকল্প উদ্বোধনের আগের দিনই দু’প্রান্তে দু’টি থানারও উদ্বোধন হয়েছে। আলোচনা হচ্ছে সর্বত্র কি কি করা যেতে পারে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে? ১. সেতুটি নিয়ে যেহেতু সাধারণ মানুষের গগনচুম্বী আগ্রহ তাই এটি দেখার জন্য অন্তত তিন দিন উন্মুক্ত করে দেয়া যেত।  ২. দেশের সর্ববৃহৎ স্থাপনার নিরাপত্তা নিয়ে আরও ভাবা যেতে পারে- বিশেষত কেউ যেন নাটবল্টু খুলে ফেলার মতো পরিস্থিতির জন্ম দিতে না পারে।  ৩. বঙ্গবন্ধু সেতুর মতো হুড খোলা ডাবল ডেকার বা সিঙ্গেল ডেকার যাই হোক না কেন তা শিগগিরই চালু করা। মানুষ নির্দিষ্ট দর্শনীর বিনিময়ে এই স্থাপনা ভিজিট করতে পারেন।  ৪. সেতুতে ছুটির দিনগুলোতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মানুষকে ছবি তোলার অনুমতি দেয়া যেতে পারে। এতে তারা এই গৌরবের অংশ হতে পারেন। ৫. সেতুতে দুর্ঘটনাসহ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধে উদ্বোধনের একদিন পরই মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ কি সমাধান? তাহলে ২১ জেলার বাইকাররা কি এই সেতু ব্যবহার করতে পারবেন না? বিষয়টি নিয়ে আরও ভাবনার অবকাশ আছে বলেই মনে করি। 

৬. সেতুর নিরাপত্তায় সিসিটিভির নজরদারি বা মোবাইল কোর্টের গতি আরও বাড়ানো যায় কিনা?  ৭. হংকং থেকে ম্যাকাও যেতে চীন সরকার একটি বৃহৎ সেতু নির্মাণ করেছে যা করোনা শুরুর আগে উদ্বোধন হয়। এই সেতুর মধ্যবর্তীস্থানে দর্শনার্থীদের জন্য একটি কফিশপও রয়েছে। পদ্মা সেতুতেও তেমন ব্যবস্থা থাকলে বোধকরি মন্দ হতো না। তবে সেতুর দু’প্রান্তে পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে দু’টি কফিশপ হতেই পারে। এতে পর্যটনের বিকাশ ঘটবে।  ১৯৩২ সাল থেকে ২০২২। পরিস্থিতি একই রকম। মানুষের নতুন যেকেনো বিষয় নিয়েই অদম্য আগ্রহ থাকে। অনেকেই বলে থাকেন হুজুগে বাঙালি। এটা শুধুই কি বাঙালির সমস্যা? তা নয়, পদ্মা সেতু নিয়ে বর্তমানে যা ঘটছে তা নতুন যেকোনো স্থাপনার ক্ষেত্রেই ঘটে খাকে। এই কৌতূহলের নিভৃতি ঘটতে হয়তো বেশ কিছুটা সময় লাগবে। দেশের অন্যান্য স্থাপনার চেয়ে এই স্থাপনা অনেক বেশি আলোচিত। আমার টাকায় আমার সেতু, বাংলাদেশের পদ্মা সেতু। সরকারের এই স্লোগানের বাস্তব প্রতিফলন হচ্ছে মানুষের সেতুমুখী স্রোত। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনায় এই সেতুর যে নান্দনিক সৌন্দর্য তা থেকে দেশের আম-মানুষ যেন বঞ্চিত না হন সেদিকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আরও অধিকতর মনোযোগ দাবি করছি।  

লেখাটির ইতি টানতে চাই সিনিয়র সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজার একটি স্ট্যাটাসের উল্লেখ করে। তিনি লিখেছেন, ‘পদ্মা সেতু কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, পদ্মা সেতু কারও ব্যক্তিগত অর্থে হয়নি, তবে পদ্মা সেতু শতভাগ ব্যক্তিগত উদ্যোগ-উদ্যমে হয়েছে। পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান পিলার ৪২টি। আসলে পদ্মা সেতুর পিলার ৪২টি নয়, পিলার মূলত ১টি। সেই পিলারটির নাম শেখ হাসিনা। পৃথিবীতে পদ্মা সেতুর চেয়ে বড় এবং অভিনব সেতু বহু আছে। তা সত্ত্বেও উদ্যোগ আর উদ্যমের কারণে পদ্মা সেতু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকবেন।’ পদ্মা সেতুর বিরোধিতা কেউ করেনি, দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কথা হয়েছে। বাংলাদেশের সব প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে এবং তা অসত্য না। পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে আসা দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। এটা খুব ভালো একটা ব্যাপার। এর অর্থ এই নয় যে, কোনো প্রকল্পে দুর্নীতি হয় না। বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিলের দায়ে যাদের অভিযুক্ত করে অপমান-অসম্মান করা হয়, তার সামান্যতম কোনো প্রমাণ বা ভিত্তি নেই। পুরোটাই বিদ্বেষপ্রসূত-মনগড়া। পদ্মা সেতুর মতো এত বড় একটি উদ্যোগ সফল করার পরে, সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের অসম্মান করার ধারা থেকে বের হয়ে আসা দরকার। 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status